স্পেস পেন বা মহাকাশে ব্যবহারিত কলম সম্পর্কে আমরা কি জানি ?

স্পেস পেন বা মহাকাশে ব্যবহারিত কলম সম্পর্কে আমরা কি জানি ?
ফিশার কোম্পানির স্পেস পেন

স্পেস পেন এর পরিচয় হয়তো আমরা অনেক আগেই পেয়ে গেছি। যদি বলেন কিভাবে? তাহলে মনে করিয়ে দিচ্ছি!

হিন্দি সিনেমা ‘থ্রি ইডিয়টস’ এর কাহিনী মনে পড়ে? মনে পড়ে আমির খানের সেই বিশেষ কলমের কথা?প্রফেসর যেটা দেখে দাবি করতো যে ওই কলম দিয়ে মহাশূণ্যেও অনায়াসে লিখা যাবে।

শুধু সিনেমাতেই নয়। বাস্তবেও কিন্তু এমন কলম রয়েছে।আজ আমরা জানবো এই বিশেষ কলম স্পেস পেন সম্পর্কে, যাকে জিরো মাধ্যাকর্ষণ কলমও বলা হয়।

স্পেস পেন:

স্পেস পেন ফিশার পেন কোম্পানির বাজারজাতকৃত, একটি কলম যেটা বায়ুর চাপের মাধ্যমে কালি cartridges বের করে ব্যবহার করা হয়। এটি দিয়ে শূন্য মাধ্যাকর্ষণেও লিখা সম্ভব।

তাছাড়া ভিজা এবং চর্বিযুক্ত কাগজেও এর মাধ্যমে যেকোনো কিছু লিখা যায়। এই কলম যেকোনো কোণ বা সময়ে লিখতে সক্ষম।

স্পেস পেন তৈরির ইতিহাস:

মহাশূণ্য এমন একটি স্থান যেখানে গ্রাভেটি থাকে না। এখন প্রশ্ন হলো যেখানে গ্রাভেটি থাকবে না সেখানে লেখা কি আদৌ সম্ভব?

ঠিক এই প্রশ্নটিই জেগেছিল পেড্রো ডুকুর মনেও।

পেড্রো ডুকু হচ্ছেন একজন স্প্যানিশ নভোচারী, তিনি ১৯৯২ সাল থেকে স্পেস প্রোগ্রামগুলোর সাথে সংযুক্ত ছিলেন। এই মিথটার সত্যতা যাচাই করতে তিনি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে একটা সাধারণ বলপেন নিয়ে যাবেন বলে মনস্থির করেন। আর যেই ভাবা সেই কাজ।

ইসার স্প্যানিশ এই নভোচারী ১৮ অক্টোবর২০০৩ সালে মহাকাশ স্টেশনে নিয়ে হাজির হলেন সস্তা একটি বলপেন।

অন্যদের মত পেড্রোরেরও ধারণা ছিল মহাকাশে বোধহয় বলপেন দিয়ে লেখা আসলেই সম্ভবনয়,অর্থাৎ এটি প্রায় অসম্ভব একটি কাজ। কিন্তু পরের ফলাফল দেখে তিনি নিজেই অবাক হয়ে গেলেন, তিনি দেখলেন যে মহাকাশেও বলপেন কাজ করছে।এবং তা বেশ ভালভাবেই।

আসলে বলপেনের মাধ্যমে ওজন শূন্য পরিবেশে কাজ চালানো যেতে পারে।কিন্তু এটা তখনই কাজ করা বন্ধ করবে যখন মহাকর্ষ শক্তি কলমের কালিকে ভুল দিকে টেনে নিয়ে যাবে।

আর তাই স্পেস পেন সেভাবেই তৈরি হয়েছে। পেড্রোর তার এই এক্সপেরিমেন্ট সম্পর্কে বিস্তারিত লিখেছিলেন “পেড্রো ডুকু’স ডায়েরী ফ্রম স্পেস” শীর্ষক প্রবন্ধটিতে!

প্রথম প্রথম নাসা যখন মহাশূণ্যে মহাকাশযান পাঠানো আরম্ভ করলো, তখন তারা বুঝলো যে বলপয়েন্ট কলম অভিকর্ষ শক্তি ছাড়া কাজ করবে না।

তখন মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হলো, এমন এক বিশেষ কলম তৈরি করার জন্য যেটা পৃথিবী বা মহাশূণ্যের যেকোনো পৃষ্ঠে, যে কোনো কোণে, শূন্যের নিচে থেকে শুরু করে ৩০০ ডিগ্রী সেণ্টিগ্রেড তাপমাত্রা পর্যন্ত কাজ করবে।

উল্লেখ্য, মহাকাশযাত্রার প্রথম দিকে, রাশিয়া এবং আমেরিকা, ২টি দেশই মহাকাশে গিয়ে পেন্সিল ব্যবহার করতো।

কিন্ত তাতে উদ্বেগের কারণ দেখা দিল, কারণ দুর্ভাগ্যজনকভাবে, পেন্সিলের নিব বানানো হয় গ্রাফাইট দিয়ে।

যেটা একইসঙ্গে তাপ ও বিদ্যুৎ ‍উভয়েরই অত্যন্ত ভালো মানের পরিবাহক।আর তাই পেন্সিলের ভাঙ্গা নিবের টুকরো অভিকর্ষহীন মহাকাশে বেশ ভালোরকম সমস্যার জন্ম দিতে পারে।

এই যেমন – বাতাসের ভেন্টিলেশন সিস্টেম অথবা ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রপাতির ভেতরে ঢুকে যেতে পারে। তখন সেখানে শর্ট সার্কিট হতে পারে, এমনকি ক্যাপসুলের বিশুদ্ধ অক্সিজেনযুক্ত পরিবেশে আগুনও লেগে যেতে পারে।

এছাড়াও আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, পেন্সিল কাটার দিয়ে কাটার সময় তার থেকে বের হওয়া বর্জ্য ভেসে ভেসে মহাকাশচারীদের চোখে মুখে প্রবেশ করতে পারে।

আর পেন্সিলের কাঠ দাহ্য পদার্থ হওয়ার দরুণ অগ্নিসংযোগের সম্ভাবনা থাকে খুব বেশি।

একারণেই সেখানে বিশেষ স্পেস পেন ব্যবহার করার প্রচলণ আরম্ভ হয়।

স্পেস পেন উদ্ভাবন:

অ্যাপোলো-১ এর সকল নভোচারী আগুনে পুড়ে মৃত্যুবরণ করার পর, নাসা এমন একটা লেখার উপকরণ খুঁজছিলো, যেটায় আগুনের কোনো ঝুঁকি নেই।

তখন আমেরিকান শিল্পপতি এবং কলম প্রস্তুতকারক Paul C Fisher এর কলম তৈরির প্রতিষ্ঠান Fisher Space Pen Company স্পেস পেন উদ্ভাবনের জন্য বাজেট করলো মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার।

স্পেস পেনের কার্যপদ্ধতি
স্পেস পেনের কার্যপদ্ধতি

১৯৬৫ সালে পল সি ফিশার এই কলম বাজারে আনেন। এবং প্রায় একই সময়ে আরও কিছু প্রতিষ্ঠান যেমন- বোল্ডার সিটি, নেভাদা, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রও এমন ধরণের কলম উদ্ভাবন করে।

তবে প্রচলিত হতে থাকে যে সব কোম্পানির কলমের মধ্যে ফিশার পেন কোম্পানির কলমই শ্রেষ্ঠ। যার নাম AG7 – মহাকাশচারী কলম বা AG7 – ORIGINAL ASTRONAUT SPACE PEN.

নাসা সেই স্পেস পেনগুলোর প্রতিটি কলম কিনে নিলো মাত্র ২ ডলার ৯৫ সেন্টের বিনিময়ে।

তার অল্প কয়েক দিনের মধ্যে রাশিয়ানরাও পেন্সিলকে বাদ দিয়ে মহাশূণ্যে ব্যবহার্য এই বিশেষ কলম ব্যবহার করতে আরম্ভ করলো।

প্রযুক্তি:

এই কলম সাধারণ বলপয়েন্ট কলমের মতো নয়, দুষ্প্রাপ্য ধাতু কারবাইড থেকে এটি তৈরি করা হয়। যা প্রস্তুতের সঠিক তথ্য ফাঁস করা হয় না।

এটি একটি দীর্ঘ পাতলা সঙ্কোচনীয় কলম যেটি সাধারণ কলমের মতই আকৃতির। কিন্তু পার্থক্য হলো এটি “বুলেট কলম” যা অসঙ্কোচনীয়।

এই কলম একটি ছোট প্লাস্টিকের অ্যাডাপ্টারের সাহায্যে প্রতিটি রিফিলসহ সরবরাহ করা হয়।

মজার ব্যপার হলো লিখার পর এই কলমের কালি নীল বর্ণ ধারণ করে। এবং শত চেষ্টার পরেও এটা পরিবর্তন করা যায় না।

স্পেস পেন দিয়ে সাধারণ বলপয়েন্ট কলমের চেয়ে ৩ গুণ বেশি সময় যাবৎ লিখা সম্ভব। এই কলমের কালি দিয়ে প্রায় ১২,৫০০ ফুট বা ৩৮০০ মিটার সমপরিমাণ উচ্চতায় লিখা যায়।

আরো পড়ুন:
ফেস রিকগনিশন প্রযুক্তি কতটা নির্ভরযোগ্য? 
কৃত্রিমভাবে আবহাওয়া বদল এর প্রচেষ্টায় চীন 
টেলিস্কোপ আবিষ্কারের ইতিহাস – বিভিন্ন ধরনের টেলিস্কোপ

ধারণা করা হয় এক একটি স্পেস পেন দিয়ে একজন মানুষের পক্ষে প্রায় ১০০ বছর পর্যন্ত লেখা সম্ভব।

এই কলমের প্রথম পেটেন্ট হচ্ছে US3285228, যেটি ১৯৬৫ সালে প্রাপ্ত হয়েছিল।

স্পেস পেনের মূল্য:

মজার ব্যাপার হচ্ছে, মহাকাশে ব্যবহার্য বিশেষ কলম আবিষ্কারের জন্য মোটেই এত ডলার খরচা হয় নি। এমনকি এই কলম তৈরীর সঙ্গে নাসা’র কোন সংযুক্তিও নেই।

সকল মহাকাশ যাত্রার আগে অ্যাস্ট্রোনটদের জন্য ফিশার পেন কোম্পানি থেকে কলম কেনা হয় যার প্রতিটির মূল্য $২.৯৫, বাংলাদেশী মুদ্রায় যার পরিমাণ মাত্র ২৫০ টাকার কাছাকাছি।

subscribe to our youtube channel 2

শেয়ার করুন -

উত্তর দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার নাম লিখুন