বাবুই পাখি তার সুনিপুণ বাসার জন্য সবখানে বিখ্যাত এবং সমাদৃত। শিল্পের অদ্ভুদ কারুকার্য খচিত এদের বাসা।
কেন বাবুই পাখিরা এত সুন্দর বাসা বানায়? এই বাসা বুনার পেছনে কি কোন বিশেষ কারণ রয়েছে?
হ্যা আছে। গবেষকরা বহুদিন ধরে গবেষণা করে এর পেছনের রহস্য খুঁজে বের করেছে।
চলুন চমকপ্রদ এই তথ্য জানার সঙ্গে সঙ্গে জেনে নিই বাবুই পাখির জীবন সম্পর্কে নানা তথ্য।
নামকরণ:
বাবুই পাখির ইংরেজি নাম Weaver বা বায়া উইভার (Baya weaver).
অঞ্চলভেদে ছোট্ট এই পাখিটি ‘বাউই’ নামেও পরিচিত।
বৈজ্ঞানিক নাম:
পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Ploceidae benghalensis
পরিবার:
বাবুই পাখি Ploceidae গোত্রের অন্তর্ভুক্ত একদল প্যাসারাইন প্রজাতির পাখি।
প্রজাতি:
বাংলাদেশে ৩ প্রজাতির বাবুই দেখা যায়।
যথা- দেশি বাবুই, দাগি বাবুই এবং বাংলা বাবুই পাখি।
তবে বাংলা বাবুই এবং দাগি বাবুই বর্তমানে বিলুপ্তির পথে।
আদিনিবাস:
অধিকাংশ বাবুই পাখি প্রজাতির আবাসস্থল সাব-সাহারান আফ্রিকায়। তবে কয়েকটি প্রজাতির বাবুই এশিয়ায়ও স্থায়ী।
এদের মধ্যে অল্প কয়েকটি প্রজাতিকে বিভিন্ন দেশে অবমুক্ত করা হয়েছে।
প্রাপ্তিস্থান:
বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে কিংবা মফস্বল এলাকায় এদের ব্যাপক দেখা যায়। এরা দলবদ্ধভাবে বসবাস করে।
আকার-আকৃতি:
লম্বায় বাবুই পাখি ১৩ থেকে ১৪ সেন্টিমিটার।
গঠন ও বৈশিষ্ট্য:
স্ত্রী এবং পুরুষ পাখি উভয়ই হলুদাভ বাদামি রঙয়ের হয়। দেখেতেও প্রায় একই রকম। কিছু প্রজাতি তাদের প্রজনন মৌসুমে বর্ণের ভিন্নতা প্রদর্শন করে।
সাধারণত স্ত্রী এবং পুরুষ বাবুই দেখতে একই রকম। তবে প্রজননের সময় ঘনিয়ে এলে প্রতিটি বাবুয়ের দেহের রঙ পরিবর্তন হতে থাকে।
পাখি নয়, যেন ধ্রুপদী এক শিল্পী বাবুই পাখি
তখন পুরুষ বাবুই পাখির মাথার অংশ হলুদ রঙ ধারণ করে। এবং ঘাড়ের ওপরের অংশ থেকে বন্ধনী তৈরি হয়ে তা বুকে গিয়ে ছড়িয়ে যায়। কপাল, কান, থুতনি ও গলার বর্ণ হয়ে যায় কালচে-বাদামি রঙের।
আর অপরদিকে প্রজননের সময় স্ত্রী পাখির ওপরের দিক হলুদাভ-বাদামি বর্ণ ধারণ করে। এবং তার ওপর থাকে বেশ কিছু গাঢ় বাদামি রঙের রেখা। এসময় পাখির ভ্রু, ঘাড়ের পাশ এবং বুক হলুদাভ-বাদামি হয়ে যায় আর নিচের দিকে হলুদ আভাযুক্ত রুপ নেয়।
বাবুই পাখিরা একত্রে সারাদিন কিচিরমিচির করে বেরায়। এবং অল্পতেই পাখিগুলো রেগে যায়।
খাদ্যাভ্যাস:
বাবুই পাখিগুলো সাধারণত বিভিন্ন ধরনের শষ্য বীজ, পোকা, ধান, ভাত, ঘাস, ছোট উদ্ভিদের পাতা, ফুলের মধু এবং রেণু ইত্যাদি খেয়ে জীবন যাপন করে থাকে।
বাসস্থান:
বাবুই পাখিরা দলবদ্ধ হয়ে জীবন যাপন করতে ভালোবাসে।
এরা নিজেদের বাসা নিজেরাই তৈরি করে সেখানে বাস করে।
তবে পুরুষ বাবুই পাখিই শুধুমাত্র বাসা বানায়।
বংশবিস্তার:
গ্রীষ্মকাল হচ্ছে বাবুই পাখিদের প্রজনন ঋতু।
একবারে এরা ২-৪টি ডিম পাড়ে।
ডিমগুলো থেকে ১৫-১৭ দিনের মধ্যে বাচ্চা ফুঁটে বের হয়।
কিছুদিন বাচ্চা বাবুইগুলো বাবা-মা বাবুইদের সঙ্গে ঘুরাঘুরি করে পরে ধীরে ধীরে নিজেরাই অন্যত্র চলে যায়।
বাবুই পাখির সুনিপুণ বাসা তৈরির কারণ:
বাবুই পাখির বাসা আসলেই অন্যান্য পাখির বাসা থেকে ভিন্ন। সকল পাখি গাছের ডালে/কোটরে, বাড়ির কার্ণিশে, পাহাড়েসহ আরও বিভিন্ন স্থানে বাসা বাঁধে।
কিন্তু বাবুই তাল, নারিকেল, খেজুর গাছের পাতায় নিজেই বাসা বুনে। এজন্য বাবুই পাখিকে তাঁতী পাখি বা বুননী পাখিও বলা হয়।
কিন্তু কেন এত সুন্দর, নিপুণ বাসা বানায় বাবুই?
পরম ধৈর্য্য ও নিপুণ বুননে একেকটা বাসা বানায় বাবুই পাখিরা
আসলে বাসা তৈরির মাধ্যমে নারী বাবুইদের কাছে নিজেদের যোগ্যতার পরীক্ষা দেয় পুরুষ বাবুই।
কারণ একটি নিখুঁত বাসার মাধ্যমেই বাবুই তার জীবনে সঙ্গিনীটি পায়। আর বাসা পছন্দ না হলে নারী সঙ্গিনীটি তাকে ছেড়ে চলে যাবে।
হোগলা পাতা, নলখাগড়া কিংবা নারিকেল পাতা চিকন করে চিঁড়ে একেকটি বাসা বানায় বাবুইরা। তাদের একেকটি বাসা বুনতে সময় লাগে ১৬-২০ দিন।
বাবুই পাখিরা খুবই নিপুণতা এবং দক্ষতার সাথে তাদের বাসাগুলো বানায়। গাছের এমন জায়গায় বাসাগুলো বানায় যাতে ঝড়-বৃষ্টি এলে তা ভেঙ্গে না যায়।
বাসা তৈরির জন্য তারা এমন স্থান নির্বাচন করে যাতে ঝড়-বাতাস আসলেও গাছের ডালকে তারা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।
বৃষ্টি ও ঝড়-বাদল থেকে বাঁচতে বাসার দেওয়ালে লেপ্টে দেওয়া হবে কাদামাটি। যাতে হালকা এই বাসাটিও বাতাসের শক্তিশালী ঝাপটায় দুমড়ে-মুচড়ে না যায়।
বাবুই পাখির বাসায় সাধারণত দুইটি ফাঁকা অংশ থাকে। এটা যেমন তারা যাওয়া-আসার জন্য তৈরি করে আবার এর পেছনে রয়েছে অন্য উদ্দেশ্যও। বেশি বাতাস করলে যাতে সহজেই বাসার ভেতর থেকে বাতাস আসা-যাওয়া করতে পারে, তার জন্যই এই কৌশল।
বাসার ভেতরে একটি অংশ থাকে ডিম বা ছানাদের জন্য। অন্য অংশ যাওয়া-আসার জন্য সরু পথ।
বাসা বানানো শেষ হলেই সে সঙ্গীর খোজ করে। আমন্ত্রণ জানায় নারী পাখিদের। এবং বাসার উপরে নেচে-গেয়ে নারী বাবুইকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে।
অবশেষে সাড়া দেয় নারী বাবুই। এবার পুরুষ বাবুই পাখিটি পরীক্ষার মুখোমুখি।