ফ্যাক্টরিতে কীভাবে বিভিন্ন মসলা প্রকৃয়াজাত করা হয়?

ফ্যাক্টরিতে কীভাবে বিভিন্ন মসলা প্রকৃয়াজাত করা হয়?
ফ্যাক্টরিতে কীভাবে বিভিন্ন মসলা প্রকৃয়াজাত করা হয়?

আমাদের খাবারকে মুখরোচক, সুস্বাদু এবং সুগন্ধময় করে তুলতে আমরা বিভিন্ন ধরনের মসলা ব্যবহার করি। যেমন- দারুচিনি, এলাচ, লবঙ্গ, তেজপাতা, গোলমরিচ, জাফরান, স্টার মসলা, জায়ফল, জয়ত্রী ইত্যাদি। ফ্যাক্টরিতে এসব মসলা প্রকৃয়াজাত করার পর আমরা এগুলো ব্যবহার করতে পারি। কিন্তু কেন?

খাবার প্রস্তুতে মসলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। মসলা ব্যবহার না করলে খাবারে কোন সুগন্ধী আর স্বাদই আসে না।

তাছাড়া কিছু কিছু মসলা রয়েছে যেগুলো শক্ত খাবারকে নরম করতেও সাহায্য করে। যেমন- দারুচিনি, জায়ফল। একারণে যেকোন গোশত রান্না করার সময় মাংসকে নরম করতেও এসব মসলা ব্যবহার করা হয়।

প্রতিটি মসলাই কিন্তু আসলে প্রাকৃতিকভাবে প্রদত্ত। কিন্তু এগুলো সরাসরি ব্যবহার করা যায় না।

গুণ, মান বৃদ্ধি এবং স্থায়িত্ব ধরে রাখতে ফ্যাক্টরিতে নিয়ে সবধরণের মসলা প্রকৃয়াজাত করতে হয়। তারপর পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নিশ্চিন্তে এগুলো পাঠিয়ে দেওয়া হয়। নষ্ট হওয়ার কোন ভয়ই আর থাকে না।

আজ আমরা জানবো ফ্যাক্টরিতে কীভাবে বিভিন্ন ধরণের মসলা প্রকৃয়াজাত করা হয়।

দারুচিনি প্রকৃয়াজাতকরণ পদ্ধতি:

আমরা সবাই জানি দারুচিনি সংগ্রহ করা হয় এক ধরণের গাছের ছাল থেকে। আর এগুলো সংগ্রহ করার জন্য দারুচিনি গাছ আবাদ করা হয়।

অধিকাংশ দারুচিনি গাছ ভারতের দক্ষিণে পাহাড়ি এলাকায় আবাদ করা হয়।

এই গাছগুলো দেখতে অনেকটা রবার গাছের মতোন। গাছ যখন বড় হয়ে যায় তখন অনেক ঝোপ-ঝাড় থাকার কারণে পুরো জঙ্গলের মতো হয়ে যায়। একারণে গাছগুলোকে গুছিয়ে এক জায়গায় বেধে রাখে।

বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আস্তে আস্তে গাছের ছালগুলো শক্ত হয়ে যায়।

তখন গোড়া থেকে গাছগুলো কেটে নেওয়া হয়। এবং ডালগুলো কেটে ছোট ছোট করে ফ্যাক্টরিতে নিয়ে আসা হয়।

তারপর বাড়তি ডালগুলো ছেটে ফেলা হয়। এভাবে কাটার দরুণ দারুচিনি পরিমাপ একই হয়ে থাকে।

এরপর ডালের উপর থেকে ধূসড় রঙের অংশগুলো চেঁছে তুলে ফেলা হয়।

আপনার হয়তো জানলে অবাক হবেন, এই কাজ করার জন্য কিন্তু বড় ধরণের কোন ফ্যাক্টরি নেই। সম্পূর্ণ কাজটাই কৃষকদের দক্ষ হাত দিয়ে করতে হয়।

গাছের উপরের অংশ চেঁছে পুরোপুরি ফেলে দেওয়ার পর গাছ থেকে ছালগুলো কেটে, তুলে আলাদা করা হয়।

তবে গাছ বেশি বড় হলে এরকম না করে কেটে শুধুমাত্র ছাল সংগ্রহ করা হয়।

এরপর এই গাছের ছালগুলোকে ভালো করে কয়েকদিন রোদে শুকিয়ে নেওয়া হয়।

দারুচিনি
দারুচিনি

ভালোভাবে রোদে শুকানোর পর এগুলো ঘরে মাচা বেঁধে তার উপর আরও কয়েকদিন রাখা হয়। তারপর দারুচিনিগুলো স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে দেওয়া হয়।

বাজারে ব্যবসায়ীরা ছোট-বড়-মাঝারি বিভিন্ন মাপের দারুচিনি আলাদা করে। এবং বেশি কচি বা ছোটগুলো গুঁড়ো করে ফেলে। এরফলে যার যেমন সুবিধা তেমন ভাবে দারুচিনি ব্যবহার করতে পারে।

তারপর সেখান থেকে দারুচিনিগুলো চলে যায় দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে।

এলাচ প্রকৃয়াজাতকরণ:

এলাচ বহুল ব্যবহৃত দামী একটি মসলা। এর ঘ্রাণ অত্যন্ত সুন্দর। একারণে তরকারি রান্নার পাশাপাশি এলাচ চা, পায়েশ, ফিরনি, রসগোল্লা ইত্যাদি মিষ্টিজাতীয় খাবারেও এটি ব্যপক ভাবে ব্যবহৃত হয়।

এলাচ মূলত একপ্রকারের ফল। এলাচ গাছে ফুল হবার পর সেখানে ছোট ছোট ফল জন্মায়।

এলাচ গাছ দেখেতে একেবারে হলুদ গাছের মত। পার্থক্য শুধু, এলাচ গাছ হলুদ গাছের চেয়ে একটু বেশি লম্বা।

চারা থেকে পূর্ণাঙ্গ এলাচ গাছে রূপান্তর হতে গাছগুলোর ১ বছর সময় লাগে। এলাচ গাছ থেকেও এলাচের সুন্দর সুগন্ধী বের হয়।

এলাচের ফুল গাছের গোড়ায় জন্মায়। আর নির্দিষ্ট সময়ে সবগুলো ফুল একত্রে এলাচে পরিণত হয়ে যায়।

এলাচ
এলাচ

প্রতিটি গাছ থেকে প্রায় ২০০-৩০০ গ্রাম এলাচ পাওয়া যায়। একারণে এলাচের মূল্য তুলনামূলক বেশি।

গাছের সবগুলো এলাচ যখন পেকে যায় তখন এগুলো সংগ্রহ করা হয়। তারপর ফলগুলো রৌদ্রে ভালো করে শুকানো হয়।

এরপর বড়-ছোট ভেদে এলাচগুলো আলাদা করা হয়। সাধারণত হাতেই এলাচগুলো আলাদা করা হয়। তবে অনেকেই আবার এই কাজের জন্য মেশিনও ব্যবহার করে থাকে।

এলাচ মসলা প্রকৃয়াজাত হয়ে গেলে এবার এগুলো ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত।

লবঙ্গ প্রকৃয়াজাতকরণ:

লবঙ্গ গাছ দেখতে অনেকটা লিচু গাছের মতো। আর এগুলো প্রথমে ফুল থাকে। তারপর ফুল ঝড়ে গিয়ে তা ধীরে ধীরে লবঙ্গে রূপান্তরিত হয়।

লবঙ্গ মসলা প্রকৃয়াজাত করতে বেশি কাজের প্রয়োজন হয় না।

লবঙ্গে পরিণত হয়ে গেলে এগুলো গাছ থেকে পেড়ে রোদে শুকানো হয়। ভালোভাবে শুকিয়ে গেলেই এগুলো ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়।

লবঙ্গ
লবঙ্গ

তারপর কৃষকরা শুকানো লবঙ্গ বাজারজাত করেন। অথবা ফ্যাক্টরিতে পাঠিয়ে দেন। সেখান থেকে প্যাকেজিং করে এগুলো বিক্রয়ের জন্য প্রস্তুত করা হয়।

আমরা সবাই জানি যে লবঙ্গ মসলা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু জানলে অবাক হবেন ওষুধ তৈরিতেও লবঙ্গ ব্যবহার করা হয়।

লবঙ্গ দাঁতের জন্য ভাল। এজন্য দাঁত ব্যাথার ঔষধ তৈরিতে এটি ব্যবহার করা হয়।

গোলমরিচ প্রকৃয়াজাতকরণ:

গোলমরিচ গাছ লাতানো গাছ। অনেকেই এই গাছ বাড়িতে টবে লাগিয়ে রাখে।

আর যারা চাষ করে তারা বড় গাছের গোড়ায় এই গাছের চারা লাগায়। কিংবা বড় বড় কাঠের বা লোহার খাম্বা পুঁতে তার গোড়ায় গাছ লাগায়।

 

বিভিন্ন প্রকার গোলমরিচ
বিভিন্ন প্রকার গোলমরিচ

গাছ লতানো বিধায় সম্পূর্ণ খাম্বাগুলোকেই একেকটি গাছ মনে হয়। এভাবে গাছ লাগানোর ফলে গোলমরিচের ফলন অনেক বেশি হয়।

গোলমরিচ থোকায় থোকায় ফলে। একেকটি থোকায় ১৫-২০ টি ফল ধরে।

গাছে ফল আসার পর সেই ফল নির্দিষ্ট সময়ে পেকে লাল রঙ ধারণ করে। তখন এগুলো গাছ থেকে পেড়ে নেওয়া হয়।

তারপর মসলা প্রকৃয়াজাত করার জন্য এগুলো রোদে শুকানো হয়। এরপর ফ্যাক্টরিতে নিয়ে এগুলো বাজারজাত করা হয়।

তেচপাতা প্রকৃয়াজাতকরণ:

তেচপাতা খাবারকে সুস্বাদু ও সুগন্ধীময় করে তোলে।

তেচপাতা মূলত একটি গাছের পাতা। এইগাছের পাতাই মসলা হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

পাতাগুলো গাছ থেকে পেড়ে কাঁচা অবস্থায়ও সরাসরি ব্যবহার করা যায়। গ্রামে একটি তেচপাতা গাছ থাকলে গ্রামবাসীরা সাধারণত গাছ থেকে পাতা ছিঁড়ে সরাসরিই তা রান্নায় ব্যবহার করে থাকে।

তবে যারা গ্রামে থাকে না তারা কিভাবে ব্যবহার করবে? কারণ পাতা তো পঁচনশীল। তাছাড়া এটা সংরক্ষণ করারই বা কি উপায়?

এজন্য তেচপাতাগুলো গাছ থেকে ছিড়ে এগুলো রোদে খুব ভালোভাবে শুকানো হয়। যতক্ষণ না পর্যন্ত পাতাগুলো একদম শুকনো খড়খড়ে না হয়ে যায়।

তেচপাতা
তেচপাতা

তেচপাতা গাছ বৃক্ষ প্রজাতির উদ্ভিদ। খুবই বড় এই গাছে সারাবছরই মসলা পাওয়া যায়। কারণ গাছের পাতা তো সারাবছরই জন্মায়।

তবে এই পাতা সংরক্ষণের জন্য শুকানো হয়। এবং তারপর তা একদম প্রস্তুত হয়ে যায়। চাষীরা এই শুকনো পাতা স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে এবং সেখান থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

কেশর থেকে জাফরান প্রস্তুতকরণ:

জাফরান হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম দামী একটি মসলা। জাফরান এতটাই দামী যে একে সোনার সঙ্গে তুলনা করা হয়।

জাফরান খাবারের রঙ এবং সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য ব্যবহার করা হয়।

তবে জাফরানের ব্যবহার শুধুমাত্র রান্নাতেই সীমাবদ্ধ নয়। আরও বিভিন্ন কাজেও এটি ব্যবহার করা হয়।

জাফরান
জাফরান

আসলে বেগুনী কেশর ফুলের পুংকেশর। এটি প্রস্তুত করতে হাজার হাজার ফুলের প্রয়োজন হয়।

কেশর ফুল চাষের জন্য জমিতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। কেশরের চারাগুলোকে এমন ভাবে রোপন এবং যত্ন নেওয়া হয় যাতে এগুলো ভালো ফল দান করতে পারে।

কেশরের চাষ করা হয় শীত কালে। কেশর চাষ করতে প্রচুর পরিমাণে পানির প্রয়োজন হয়।

কেশর গাছে কেশর ফুল আসতে ৬ মাসের মতন সময় লাগে। ফুল ফুটে যাওয়ার পর কৃষকরা সেই ফুল দ্রুত গাছ থেকে সংগ্রহ করে।

কেশর সংগ্রহ করা অন্যান্য যেকোন ফসল সংগ্রহ করা থেকে একেবারেই ভিন্ন।

এগুলো তোলার সবচেয়ে ভিন্নতর প্রকৃয়াটি হলো যতক্ষণ সূর্যের আলো ফসলের গায়ে পরবে ততক্ষণ কেশর ফুল গাছ থেকে তোলা যায় না। তাই সূর্য ডুবে গেলেই এই ফুল তুলতে হয়।

ভুলক্রমে যদি চাষীরা এই পদ্ধতি অবলম্বন না করে তাহলে এই দামী মসলা হারিয়ে ফেলতে পারেন।

এক্ষেত্রে আরেকটি কাজ খেয়াল রাখা হয়, যাতে সূর্য উঠার আগেই সব কাজ শেষ হয়ে যায়।

এরপর ফুল থেকে তাদের পুংকেশর গুলি ছিড়ে ফেলা হয়। কৃষক এবং তার পরিবারের সকল সদস্যরা একত্রে এই কাজ করে থাকেন।

এরপর পুংকেশরগুলিকে সম্পূর্ণ ১২ ঘন্টা রোদে শুকানোর জন্য রেখে দেওয়া হয়।

যখন এগুলো সঠিকভাবে শুকিয়ে যায় এগুলো সিল করে বাজারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

সবচেয়ে বেশি কেশর উৎপদিত হয় ভারতের কাশ্মীরে।

জায়ফল এবং জয়ত্রী মসলা প্রকৃয়াজাতকরণ:

জায়ফল এবং জয়ত্রী দুটি মসলা হলেও এর ফলন কিন্তু এক গাছেই হয়। এমনকি একই ফল থেকেই জায়ফল এবং জয়ত্রী দুটি মসলাই পাওয়া যায়।

জায়ফল মসলার উদ্ভিদটির বোটানিকাল নাম হচ্ছে নাটমেগ। এটি একটি বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ। গাছটি অনেক লম্বা এবং পুরোবিশিষ্ট হয়।

স্ত্রী নাটমেগ গাছের ফুল থেকে ফল হয়। যা আমরা পরবর্তীতে জায়ফল এবং জয়ত্রী হিসেবে ব্যবহার করি।

গাছে ফল আসতে বেশ দীর্ঘদিন লেগে যায়। চারাগাছ রোপনের ৮-৯ বছর পর গাছে ফল জন্মায়।

ফুল আসার পর ফুল থেকে ফল এবং তা পাকতে প্রায় ১৫০ দিন সময় লেগে যায়। একটি পরিপূর্ণ গাছে বছরে প্রায় ১০০০টি ফল হয়।

নাটমেগ ফলের বীজকে বলা হয় জায়ফল। এবং এই বীজের আধার এরিলকে বলা হয় জয়ত্রী। অর্থ্যাৎ জয়ত্রী আসলে জায়ফলের বীজের উপরের আবৃত একটি অংশ।

জায়ফল ও জয়ত্রী
জায়ফল ও জয়ত্রী

নাটমেগ ফল প্রথমে শুকানো হয়। এরপর সেই ফল থেকে বীজ এবং বীজের বহিরাংশে আবৃত থাকা আস্তরণটি আলাদা করা হয়।

ভারতের কেরলায় নীলগিরি অঞ্চলে জায়ফলের চাষ বেশি হয়। সবচেয়ে বেশি এবং উৎকৃষ্ট মানের জায়ফল চাষ হয় ইন্দোনেশিয়ায়।

এ মসলাটি সাধারণত মাংসজাতীয় খাবার রান্নার করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। এটি গুণাগুণ ঠিক রেখে মাংসকে দ্রুত নরম করতে সাহায্য করে। তাই গরুর গোশত, খাসীর মাংস, বিরিয়ানি তৈরিতে এর ব্যবহার বেশি হয়।

এছাড়াও এটি খাবারকে খুবই সুস্বাদু করে তুলে। তাই বিভিন্ন মিষ্টান্ন, কেক, পেস্ট্রি, পুডিং ইত্যাদি তৈরিতে এটি ব্যবহৃত হয়।

জায়ফল, জয়ত্রী শুধুমাত্র মসলাই নয়। এর আরও বহুবিধ ব্যবহারও রয়েছে। সাবান শিল্পে, ওষুধ শিল্পে এর ব্যবহার রয়েছে।

তবে একটি বিষয় লক্ষনীয়। জায়ফল, জয়ত্রীর সুগন্ধী উদ্বায়ী। যেকোন জায়গায় খোলা অবস্থায় রেখে দিলে এর উদ্বায়ী উপাদানগুলি কিছুদিনের মধ্যেই মসলা থেকে বের হয়ে যায়।

তাই জায়ফল, জয়ত্রী ভাল করে সংরক্ষণ করে রাখতে হয়। মুখবন্ধ কৌটায় রেখে ঠান্ডা স্থানে রেখে দিলে খুব ভাল। তাহলে এর গুণাগুণ এবং সুগন্ধী দীর্ঘদিন বজায় থাকবে।

স্টার মশলা প্রক্রিয়াজাতকরণ:

স্টার অ্যানিস বা স্টার মসলা তারা আকৃতির একটি সুগন্ধি মশলা। এটি একটি স্বাদবর্ধক মসল্লা। খাবারকে সুস্বাদু ও সুগন্ধীময় করতে এই মসলার ব্যবহার হয়।

মসলা জাতীয় বিভিন্ন রান্নায় এর ব্যবহার বেশি হয়। মাংস, বিরিয়ানি, রোস্ট, স্যুপ, ‍নুডুলস এছাড়াও বিভিন্ন বিদেশী খাবার যেমন- ইটালিয়ান, কোরিয়ান, চাইনিজ ডিশে স্টার মশলা অনেক ব্যবহৃত হয়। সুস্বাদু পানীয় তৈরিতেও এটি ব্যবহারের প্রচলণ রয়েছে।

স্টার মসলা আসলে একটি বীজযুক্ত ফল। গভীর বাদামী রঙের মসলা। তবে এই রঙ ধারণ করে মসলাটি শুকানোর পর। এর আগে সবুজ রঙের হয়ে থাকে।

প্রতিটি স্টার মসলায় ৬-৮ প্রস্থ থাকে। যেগুলোর জন্য মসলাটিকে দেখতে তারার মত মনে হয়। আর একারণে এই মসলার নাম স্টার মসলা।

গাছে ফুল আসার পর ফল আসে। এবং ফলের ভিতরে বীজ পাওয়া যায়। ফল এবং বীজ উভয়টিই মসলা হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

স্টার মসলা বা তারা মশলা
স্টার মসলা বা তারা মশলা

স্টার মসলার প্রতিটি প্রস্থতে একটি একটি করে একক বীজ রয়েছে। ফল এবং বীজ উভয়ই মিষ্টি এবং প্রখর অ্যানিস গন্ধযুক্ত হয়।

ফল পরিপক্ক হলে নির্দিষ্ট সময় পর গাছ থেকে স্টার ফলগুলো পাড়া হয়। এরপর এগুলো ভালোকরে রোদে শুকানো হয়। ভালোকরে মসলা প্রকৃয়াজাত এর জন্য যতদিন পর্যন্ত গাঢ় বাদামী রঙ ধারণ না করে ততদিন পর্যন্ত এগুলো শুকানো হয়। চাষীরা দক্ষতার মাধ্যমে বুঝতে পারে এগুলো উপযুক্ত হওয়ার জন্য কতদিন শুকানোর প্রয়োজন।

শুকানোর পর মসলাটি অনেক শক্ত হয়ে যায়। তাই এগুলো তখন দীর্ঘদিন সংরক্ষণ এবং ব্যবহারপযোগী হয়ে যায়।

ঠিকমতো শুকিয়ে গেলেই এগুলো সংরক্ষণ এবং বাজারজাতের জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। এরপর স্থানীয় বাজার কিংবা ব্যবসায়ীদের কাছে স্টার মসলা বিক্রি করে দেওয়া হয়।

জেনে রাখা ভালো, স্টার অ্যানিস মসলাটির স্বাদ কিন্তু খুব শক্তিশালী, তাই এটি যেকোন রান্নায় পরিমাণে খুব অল্প ব্যবহার করা উচিত।

মৌরি প্রকৃয়াজাতকরণ:

মৌরিকে আমাদের দেশে অনেকে মিষ্টি জিরা হিসেবে চিনে। বিভিন্ন তরকারি, মিষ্টিজাতীয় রান্না কিংবা নোনতা জাতীয় খাবারে বিশেষত পানের সাথে এটি প্রচুর খাওয়া হয়।

জেনে রাখা ভাল, মৌরির বীজ বা ফলই শুধু ব্যবহারর্য অংশ নয়। একই সঙ্গে এর গাছ এবং শেকড়ও উপকারী উপাদান। মৌরি গাছের পাতা ও কান্ড খুবই নরম হয়। তাই এগুলো দিয়ে সস্ তৈরি করা হয় এবং স্যালাড হিসেবে খাওয়া হয়। আর শেকড় আয়ুর্বেদিক বিভিন্ন ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

মৌরি মূলত গুল্মজাতীয় একপ্রকার উদ্ভিদ। এটি খুবই নরম। মৌরি গাছে হলুদ ফুল ফোটে। এবং তারপর গাছে সবুজ রঙের ছোট ছোট বীজ আসে। এগুলোই ‍মূলত মৌরি বা মিষ্টি জিরা।

মৌরি বা মিষ্টি জিরা
মৌরি বা মিষ্টি জিরা

মৌরি গাছের ফল ৭-৮ মাস হলে তারপর তোলার উপযোগী হয়। ফলের রঙ হলুদাভ হয়ে গেলেই গাছ কেটে ফেলা হয়। তবে খেয়াল রাখা উচিত মাঠেই যদি ফল পুরোপুরি পেকে যায় তাহলে ফল ঝরে নষ্ট হয়ে যাবে এবং বীজের গুণমান খারাপ হয়ে যাবে।

তুলে আনার পর সম্পূর্ণ গাছগুলোই ৪-৫ দিন ভালো করে রোদে শুকানো হয়। তারপর লাঠি দিয়ে পিটিয়ে বা মেশিনের সাহায্যে বীজ আলাদা করা হয়।

তারপর ঝাড়াই বাছাইয়ের পরও আরও ৪ থেকে ৫ দিন রোদে শুকানোর পর বীজগুলো স্থানীয় বাজারে বিক্রি করা হয় নয়তো গুদামজাত করা হয়।

আলুবোখরা প্রক্রিয়াজাতকরণ:

আলুবোখরা টক-মিষ্টি রসালো, স্বাদযুক্ত একটি ফল। ফলটি পাকলে খাওয়া হয়। অথবা একে শুকিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে ব্যবহার করা হয়। সাধারণত পোলাও, বিরিয়ানি, কাচ্চিতে এটি বেশি ব্যবহার হয়। এছাড়া চাটনি রান্না করেও খাওয়া হয়।

আলুবোখারার গাছ বিরুৎ জাতীয় উদ্ভিদ। গাছে ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে সাদা ফুল এবং মার্চ-এপ্রিল মাসে গাছে ফল আসে। আলুবোখরা পাকার আগে গাছ থেকে নিলে ভাল ফল পাওয়া যায় না। সেই ফলের স্বাদ তিতকুটে হয়।

তাই ফল গাছেই ভালোভাবে পাকলে তারপর পাড়তে হয়। আলুবোখরা পাকলে গাঢ় লাল বা হালকা খয়েরী রং ধারণ করে এবং ফল নরম হয়ে যায়।

তখনই আলুবোখরা সংগ্রহ করার উপযুক্ত সময়। হালকা লাল বা হলুদ আবস্থায় যদি আলুবোখরা সংগ্রহ করা হলয় তাহলে তার স্বাদ অত্যন্ত টক বা হালকা তেতো স্বাদেরও হতে পারে।

আলুবোখরা
আলুবোখরা

আলুবোখারার প্রতিটি পুর্ণবয়স্ক (১০-২০ বছর) গাছ থেকে দেড় থেকে তিন হাজার পর্যন্ত ফল পাওয়া যেতে পারে।

পাকা ফলকে রোদ্রের তাপে ভালোভাবে শুকানো হয়। যাতে তা দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়। এবং মসলা হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

তবে খুব গুরুত্বের সাথে খেয়াল রাখতে হয় যাতে আলুবোখরা ফলে পোকা-মাকড়ের উপদ্রব না হয়। এবং ফলগুলো যাতে পঁচে যেতে শুরু না করে।

রোদের তাপে ভালভাবে শুকিয়ে নিলে ৭-৮ মাস পর্যন্ত আলুবোখরা সংরক্ষণ করা যায়। তবে বায়ুরোধী পাত্রে রেখে ঠান্ডা জায়গায় সংরক্ষণ করে রাখলে দীর্ঘদিন আলুবোখরা ভালো থাকে।

মেথি প্রক্রিয়াজাতকরণ:

মেথি একপ্রকার ছোট দানাদার মসলা। পাঁচ ফোঁড়নের একটি ফোঁড়ন বা মসলা হচ্ছে মেথি। ছোট্ট খয়েরী রঙের মসলা এটি। খেতে তিতা স্বাদযুক্ত হলেও রান্নায় ব্যবহারের পর খাবারের সুগন্ধী বাড়িয়ে অনন্য মাত্রা দেয় মেথি।

মেথি খুবই উপকারী একটি মসলা। শুধুমাত্র মসলাই নয় পথ্য হিসেবেও মেথির খুব ব্যবহার রয়েছে।

মেথি
মেথি

মেথি মসলার গাছটি একটি বর্ষজীবী উদ্ভিদ। গাছে ১ বার মাত্র ফুল এবং ফল হয়। গাছে ৩টি করে পাতা একসাথে জন্মায়। এবং এর প্রতিটি ফুলেও ৩টা করে পাপড়ি থাকে। উদ্ভিদে স্ত্রী এবং পুরুষ উভয় ধরণের ফুল হয়। ফুলের রঙ সাধারণত সাদা এবং হলুদ হয়ে থাকে। এরপর গাছে বাদামি-হলুদ বর্ণের প্রায় চারকোনা আকৃতির ছোট ছোট বীজ হয়।

এগুলোই মূলত মেথি। তবে কাঁচা অবস্থায় এই বীজ ব্যবহার করা যায় না। ব্যবহারের আগে একেও অন্যান্য মসলাদের মতো ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে নিতে হয়। তারপরই এগুলো ব্যবহারপযোগী হয়। এবং দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করে রাখা যায়।

কালোজিরা প্রক্রিয়াজাতকরণ:

পাঁচফোঁড়নের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মসলা হচ্ছে কালোজিরা। তবে এটি এককভাবেও ব্যবহার করা যায়। ডাল, সবজি, চাটনি জাতীয় খাবার রান্নার ক্ষেত্রে কালোজিরা ব্যবহার করা হয়। অনেকেই আবার বিস্কুট, লুচি, পাউরুটি তৈরিতেও এর ব্যবহার করে।

কালোজিরার তেলও খুবই উপকারী। তাই শুধু মসলাই নয় পথ্য হিসাবেও এর ব্যপক ব্যবহার রয়েছে।

কালোজিরার গাছ খুবই কম দিন বাঁচে। এটি গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ।

বপনের পর সর্বমোট ১৩৫-১৪৫ দিন বাঁচে এই উদ্ভিদটি। এরমধ্যেই গাছ হলদে বর্ণ ধারণ করে মরে যায়। গাছের ফল ১৫-২০ সপ্তাহের মধ্যে পেকে যায় এবং তার ভেতরেই ফসল তুলে ফেলতে হয়।

কালোজিরার গাছ ফাল্গুন-চৈত্র মাসে মরে গেলে গাছ থেকে ফল সংগ্রহ করা হয়। এরপর ২ দিন রোদে শুকিয়ে নিতে হয়। তারপর হাতে সাবধানে আঘাত করে মাড়াই করে বা লাঠি দিয়ে ফল থেকে বীজ সংগ্রহ করা হয়।

কালোজিরা
কালোজিরা

কিন্তু এই ফল সংগ্রহ করতে হয় অত্যন্ত সাবধানে। মরে যাবার পরেও পুরোপুরি শুকানোর আগে গাছে সামান্য রস থাকতেই ফল সংগ্রহ করে ফেলতে হয় কৃষকদের। তা নাহলে বীজ জমিতেই ঝরে পড়তে পারে।

সংগৃহীত বীজ রোদে পর্যাপ্ত পরিমাণে শুকিয়ে ঠাণ্ডা করে কুলা দিয়ে পরিষ্কার করে চটের বস্তায় বা মাটির পাত্রে বীজ সংরক্ষণ করা হয়।

আরো পড়ুন:
কেশর গাছ – যে গাছ থেকে পাওয়া যায় বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল মসলা জাফরান 
কালোজিরা গাছ – মহৌষধী গুণ সমৃদ্ধ এক উদ্ভিদ 

এভাবে কালোজিরা মসলা প্রক্রিয়াজাত করলে এগুলো অন্তত ১ বছর পর্যন্ত ভালোভাবে সংরক্ষণ করা যায়। আর মানসম্মত বীজ সংরক্ষণকরার জন্য শুকনো পাত্রতে নিয়ে তা ঠাণ্ডা, অন্ধকার জায়গায় রাখতে হবে।

  subscribe to our youtube channel 2

শেয়ার করুন -

১ মন্তব্য

উত্তর দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার নাম লিখুন