স্তানিস্লাভ পেত্রভ – দ্য ম্যান হু সেভড দ্য ওয়ার্ল্ড
স্তানিস্লাভ পেত্রভ - দ্য ম্যান হু সেভড দ্য ওয়ার্ল্ড
স্তানিস্লাভ পেত্রভ ছিলেন সোভিয়েত এয়ার ডিফেন্স ফোর্সের একজন লেফটেন্যান্ট কর্ণেল। তার বুদ্ধিমত্তা এবং তাৎক্ষণাত নেওয়া সঠিক সিদ্ধান্তের কারণে আজকে সম্পূর্ণ পৃথিবী এখনো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
কীভাবে? চলুন জেনে আসি-
সোভিয়েত ইউনিয়ন আর আমেরিকার মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধের কথা আমরা সকলেই জানি। এটি ইতিহাস বিখ্যাত এক ঘটনা। দুটি দেশের মধ্যে তখন শীতল স্নায়ুযুদ্ধ চলছে।
২ দেশই হন্যে হয়ে নিউক্লিয়ার বোমা বানানোয় ব্যস্ত সময় পার করছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে কোনো পক্ষই চাইছিল না যে একটা সত্যিকারের যুদ্ধ বেধে যাক।
কিন্ত তারপরও যেকোন সময় যদি যুদ্ধ লেগে যায়, তারই প্রস্তুতি নিয়ে রাখা আরকি।
এমনই টান টান উত্তেজনার সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন সন্দেহ করে, তাদের এয়ারবেইজের ওপর দিয়ে একটা স্পাই বিমান উড়ে গেছে। বস্তুত, তা ছিল কোরিয়ান এয়ার কমার্শিয়াল ফ্লাইট।
সন্দেহবশত কোরিয়ান এয়ার কমার্শিয়াল ফ্লাইট গুলি করে উড়িয়ে দিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। বিমানে থাকা ২৬৯ জন যাত্রী সাথে সাথেই মারা গেল এবং সেদিনে ফ্লাইটে যাত্রীদের মধ্যে একজন ছিলেন জর্জিয়ার কংগ্রেসম্যান। এই ঘটনার পর তিনি আমেরিকা সোভিয়েত ইউনিয়নকে সরাসরি ‘শয়তানের আস্তানা’ নামক আখ্যা দিয়ে দিল।
আমেরিকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে শীতল এই স্নায়ুযুদ্ধ বেশ জটিল একটা অবস্থায় ছিল। কোন পক্ষ যে সঠিক, আর কে ভুল তা নির্ধারণ করা ছিল ভয়াবহ মুশকিল।
সোভিয়েত ইউনিয়নের সংসদ নেতা ইউরি ভি আন্দ্রোপভ এবং আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান উভয়েই ছিলেন একই রকমেরই উন্মাদ। কিন্তু মূল সমস্যা হচ্ছে উন্মাদনার মতো ব্যাপারগুলো আসলে ভাইরাসের মতো। খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
তেমনি এই ২টি দেশের প্রধানদের সেই উন্মাদনা ছড়িয়ে গিয়েছিল সেনাবাহিনীর প্রধানদের মধ্যেও। ২ পক্ষের সেনাপ্রধানেরা আকাশ, জল কিংবা স্থলের কোথাও অস্বাভাবিক কিছু ঘটছে কি না, এবং আক্রমণের মতো কোনো লক্ষণ বোঝা যাচ্ছে কি না—তা পরীক্ষা করার জন্য দেশজুড়ে অসংখ্য ওয়াচ স্টেশন বানিয়ে প্রত্যেকটিতে অফিসার বসিয়ে দিয়েছিলেন।
যদিও এদিক থেকে এগিয়ে ছিল বেশি সোভিয়েত ইউনিয়ন। হঠাৎ একদিন সোভিয়েত ইউনিয়নের এক ওয়াচ স্টেশনে প্রথম একটি অস্বাভাবিক ঘটনা ধরা পড়ল। স্টেশনে তখন ছিলেন স্তানিস্লাভ পেত্রভ।
স্তানিস্লাভ পেত্রভ ছিলেন তৎকালীন সোভিয়েত এয়ার ডিফেন্স ফোর্সের একজন লেফটেন্যান্ট কর্ণেল। তিনি তখন কর্মরত ছিলেন আমেরিকানদের কোনো নিউক্লিয়ার আক্রমণ অথবা মিসাইল লঞ্চিংয়ের সোভিয়েত আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেমে।
সিস্টেমটির কোড নেম ছিল ‘ওকো’, সোজা বাংলায় যার অর্থ হলো চোখ।
পেত্রভ সেসময় সারপুখভ-১৫ নামক এক গোপন কমান্ড সেন্টারে বসা। এই গোপন কমান্ড সেন্টারগুলো তখন ছিল শহরের নিচে এবং বিশালাকারের, আক্ষরিক অর্থেই সেগুলো ছিল বিশাল বাংকার।
সারপুখভ-১৫ নামক সেই গোপন কমান্ড সেন্টারটি তৈরি করতে স্তানিস্লাভ পেত্রভ নিজেও কাজ করেছিলেন।
দিনটি ১৯৮৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর। সেদিন পেত্রভ ছিলেন স্টেশন কন্ট্রোল রুম ডিউটিতে। হঠাৎ করেই অ্যালার্ম বেজে উঠল। বাংকারের ভেতরের সবগুলো কম্পিউটার সিগন্যাল দিচ্ছে যে, আমেরিকান বেইজ থেকে ৫টা মিনিটম্যান ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইল ছোড়া হয়েছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ৪টা মিসাইল চিহ্নিত করা হয়ে গেল।
নিউক্লিয়ার বোমা বিস্ফোরণ
স্তানিস্লাভ পেত্রভের ডিউটি ছিল এই ঘটনার কথা তাঁর সুপিরিয়র বসকে জানানো, তিনি এই ম্যাসেজটি পাঠাবেন মিলিটারির জেনারেল স্টাফকে এবং তারপর তাঁরা ইউরি আন্দ্রোপভের সঙ্গে আলোচনা করে কাউন্টার অ্যাটাকের সিদ্ধান্ত নেবেন।
কিন্তু দুঃখের ব্যাপারটি হলো মিসাইল লঞ্চ থেকে ডিটোনেশন পর্যন্ত যেতে সময় লাগবে মাত্র ২৫ মিনিট! এটা বুঝতে পারার পর পেত্রভ মোটামুটি জায়গাতেই জমে ঠান্ডা হয়ে গেলেন।
২০১৩ সালে এক সাক্ষাৎকারে পেত্রভ বলেছিলেন, ‘স্ট্রাইক হয়েছে- এটা কিছুক্ষণের মধ্যেই সুপিরিয়র বসকে জানাতে হবে। এর জন্য কোনো সময় তখন আসলে নির্ধারিত ছিল না। কিন্তু আমি জানতাম, তখনকার প্রতিটি সেকেন্ড অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ, সোভিয়েত ইউনিয়নের পলিটিক্যাল লিডারশিপ এবং মিলিটারিদের খবরটা কোনো রকম দেরি না করে খুবই দ্রুত জানানো উচিত। সেই সময় আমার কর্তব্য ছিল শুধু এটুকুই, পাশে থাকা ফোনটা তুলে আমাদের টপ কমান্ডারদের বিষয়টির ব্যাপারে জানানো। কিন্তু আমার সমস্যা হচ্ছে এতটা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম যে আমি নড়তেই পারছিলাম না, মনে হচ্ছিল আমি যেন একটা গরম কড়াইয়ের ওপর বসে আছি।’
তো যা–ই হোক, এরপর স্তানিস্লাভ পেত্রভ সিদ্ধান্ত নিলেন যে অ্যালার্টটাকে কম্পিউটার ম্যালফাংশন হিসেবে রিপোর্ট করবেন।
১৯৯৯ সালের দিকে ওয়াশিংটন পোস্টকে দেওয়া এক ইন্টারভিউতে পেত্রভ বলেছিলেন, ‘আমার পেটের ভেতর তখন বিচিত্র একটা অনুভূতি হচ্ছিল। কিন্তু আমি ওই সময় কোনোরূপ ভুল করতে চাইনি। তাই আমি আমার নেওয়া সিদ্ধান্তেই অবিচল ছিলাম।’
আমাদের আজকের এই পৃথিবী কেমন হতো, তা আমরা জানতেই পারতাম না, যদি স্তানিস্লাভ পেত্রভ ওই দুর্যোগের সময় নিজের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের ওপর ভরসা না করতেন। আসলে পেত্রভের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ঠিকই ধারণা করেছিল, পরে তা প্রমাণিত হয়েছে।
সিগন্যালগুলো ছিল মূলত হাই-অলটিটিউড স্তরে থাকা মেঘে সূর্যরশ্মির প্রতিফলন। আর সেই প্রতিফলনগুলোকেই স্যাটেলাইট ভুলে মিসাইল লঞ্চ হিসেবে ধরে নিয়েছিল।
এভাবেই স্তানিস্লেভ পেত্রভ একটা পারমাণবিক যুদ্ধের হাত থেকে নিজের দেশ ও আমেরিকা তথা হিসাব করলে আসলে পুরো পৃথিবীকেই রক্ষা করেছিলেন।
পেত্রভের এই অ্যালার্ম ম্যালফাংশনের কথা সর্বপ্রথম পৌঁছে ইউরি ভোটিন্টসেভের কাছে। তারপর পৌছে সোভিয়েত এয়ার ডিফেন্সের মিসাইল ডিফেন্স ইউনিট কমান্ডারের কাছে।
পেত্রভের এই সিদ্ধান্ত গ্রহণে ইউরি ভোটিন্টসেভ তার বেশ প্রশংসা করলেও পেত্রভকে সামরিক বাহিনীতে খুব ভালোভাবেই লাঞ্ছিত হতে হয়েছিল, ওয়ার ডায়েরির কাগজপত্র সঠিকভাবে পূরণ না করার জন্য।
এই ঘটনার ১ বছর পর, ১৯৮৪ সালে স্তানিস্লাভ পেত্রভ মিলিটারি থেকে অবসর গ্রহণ করে সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে রিসার্চ ইউনিটে যোগদান করেন। সেই রিসার্চ ইউনিটটির কাজই হলো ওয়ার্নিং সিস্টেমটাকে ক্রমাগত উন্নত করা।
১৯৮৩ সালে ঘটে এই ঘটনা কিন্তু সেই ঘটনায় স্তানিস্লাভ পেত্রভের ভূমিকা প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৯৮ সালে। কর্ণেল জেনারেল ইউরি ভোটিন্টসেভ তাঁর অবসরের সময় পুরোনো দিনের কথা স্মরণ করতে গিয়ে প্রথম এই ঘটনার কথা উল্লেখ করেন। হঠাৎ করেই পৃথিবী জেনে গেল, ‘স্তানিস্লাভ পেত্রভ নামক একজন মানুষের জন্য সমস্ত পৃথিবী সম্ভাব্য একটা পারমাণবিক যুদ্ধের হাত থেকে বেঁচে গেছে।’
২০০৬ সালে ‘অ্যাসোসিয়েশন অব ওয়ার্ল্ড সিটিজেনস’ হতে স্তানিস্লাভ পেত্রভকে সম্মানণাসূচক পুরস্কৃত করা হয়।
২০১৩ সালে পেত্রভকে ‘ড্রেসডেন পিস প্রাইজ’ দিয়ে সম্মানণা জানানো হয়।
পেত্রভকে নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি ড্রামাও নির্মাণ করা হয়েছে, যার নাম দ্য ম্যান হু সেইভড দ্য ওয়ার্ল্ড। নাটকটির পরিচালক ছিলেন পিটার অ্যান্থনি।
২০১৭ সালের মে মাসে পেত্রভ মৃত্যুবরণ করেন যখন তিনি ছিলেন ৭৭ বছর বয়সী। কিন্তু তার মৃত্যুর সংবাদটি ফলাও করে প্রচার করা হয়েছিল ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে।
এত পুরস্কার, প্রশংসার পরও বিখ্যাত এই কর্ণেল স্তানিস্লাভ পেত্রভ ১৯৮৩ সালে ঘটে যাওয়া ঘটনাটিকে নিয়ে ‘স্রেফ নিজের ডিউটি করেছি’ ছাড়া কখনোই গর্ব করে কোনো কিছু কোথাও বলেননি।
এমন মানুষগুলোর জন্যই তো এখনো আমরা সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে বেঁচেবর্তে আছি…