কালোজিরা কিংবা কালিজিরা, যে নামেই ডাকা হোক না কেন এ কালো বীজের গুণাগুণ এবং তার স্বাস্থ্য উপকারিতা অপরিসীম, অসাধারণ এবং কালজয়ী। কালোজিরা গাছ এর ছোট্ট এই বীজগুলি অসাধারণ ক্ষমতাধর।
ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা কালোজিরাকে একটি অব্যর্থ রোগ নিরাময়ের উপাদান হিসেবে বিশ্বাস করে। হাদিসে বর্ণিত রয়েছে কালোজিরা মৃত্যু ব্যতীত অন্য সমস্ত রোগ নিরাময় করতে পারদর্শী। একারণে কালোজিরাকে পৃথিবীর সকল রোগের ওষুধ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
ধর্মীয় বিধান মতে নিয়মিত এবং পরিমিত পরিমাণ কালোজিরা সেবন শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে সতেজ করে ও সার্বিকভাবে স্বাস্থ্যের উন্নতি সমৃদ্ধি সাধন করে।
আজ আমরা জানতে চলেছি সেই কালোজিরা সম্পর্কে। কালোজিরা গাছ দেখতে কেমন? কীভাবে এর চাষ করা হয়। এবং এর গুণাগুণ সম্পর্কে।
নামকরণ:
কালোজিরার ইংরেজি Nigella.
বাংলায় কালোজিরা ছাড়াও এর আরও অনেক নাম রয়েছে। কালিজিরা, কালো কেওড়া, রোমান ধনে, নিজেলা, কালঞ্জি এসব অন্যান্য বাংলা নাম।
বৈজ্ঞানিক নাম:
কালোজিরার বৈজ্ঞানিক নাম Nigella Sativa Linn.
পরিবার:
কালিজিরা গাছ Ranunculaceae নামক পরিবারের সদস্য।
প্রজাতি:
দেশে তিন প্রজাতির কালোজিরা চাষ করা হয়। যেমন-
এন.এস-৪৪
এন.এস-৩২
বারি কালিজিরা
উৎপত্তির আদিস্থান:
কালোজিরা গাছের আদি নিবাস হচ্ছে দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়া। অনেকে আবার বলে থাকেন ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল এর উৎপত্তিস্থল।
আকার-আকৃতি:
কালোজিরা গাছ লম্বায় ২০ থেকে ৫০ সেমি পর্যন্ত হয়।
গাছের পাতা সরু ও চিকন হয়। আকারে ২-৩ সেমি। জোড়া ধরে সোজা হয়ে পাতাগুলো জন্মায়।
গঠন ও বৈশিষ্ট্য:
কালোজিরা গাছ একটি মাঝারি আকৃতির মৌসুমী উদ্ভিদ।
এই গাছে মাত্র একবার ফুল এবং ফল আসে। এরপর গাছ মরে যায়।
কালোজিরা গাছে স্ত্রী, পুরুষ উভয় ধরণের ফুলই জন্মায়। ফুলের রং সাধারণত হয় নীলচে, সাদা এবং জাত বিশেষে হলুদাভ, গোলাপী, বেগুনী রঙের হয়ে থাকে।
বাংলা কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে কালোজিরার ফুল ফোটে। তারপর শীতকালে গাছে ফল ধরে, এবং শীতের শেষে ফল পাকে।
প্রতিটি ফুল ৫টি পাঁপড়ি বিশিষ্ট । ফুলের কিনারায় একটি বাড়তি অংশ থাকে। তাতে ৩ কোণা আকৃতির কালো রং এর বীজ উৎপন্ন হয় ।
এরপর গোলাকার একধরণের ফল উৎপন্ন হয়। কিনারে আঁকর্শির মত বাড়তি অংশ থাকে। প্রত্যেকটি ফলে ২০-২৫ টি বীজ থাকে। এই বীজগুলোই মূলত কালোজিরা।
কালোজিরার এই বীজ পরিপক্ব হতে ১৩০ থেকে ১৪৫ দিন সময় লাগে।
আয়ুষ্কাল:
কালোজিরা গাছ এক বর্ষজীবি উদ্ভিদ। তাইে একে মৌসুমি উদ্ভিদও বলা হয়ে থাকে।
চাষের উদ্দেশ্যে বছরে ১ বারই রোপন করা হয়। একবারেই ফসল গ্রহণ করা হয়। এরপর প্রাকৃতিক ভাবেই গাছ মারা যায়।
চাষ পদ্ধতি:
কালোজিরা গাছের বীজ বপন করা হয় অগ্রহায়ণের শেষের দিক থেকেই। তবে বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকলে পৌষের প্রথমেই গাছ লাগানো ভালো।
প্রতিটি কালোজিরা গাছ ১ ফুট বা ৩০ সেমি. দূরে দূরে ১-৪ ইঞ্চি গর্ত করে প্রতি গর্তে ২-৩ টি করে বীজ খুব সাবধানে পুতা হয়। বীজ বপনের ১২-১৬ দিন অর্থাৎ ০-২ সপ্তাহের মধ্যে চারা গাছ গজাবে।
এরপর পরিমাণমতো পানি সেচ, সার, যত্ন দিয়ে গাছ বড় করে তোলা হয় এবং পরিচর্যা করা হয়।
কালোজিরা গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ এবং সংরক্ষণকরণ:
ফাল্গুন-চৈত্র মাসে কালোজিরা গাছ মরে যায়। তখন গাছ থেকে ফল সংগ্রহ করা হয়।
এরপর ২ দিন রোদে শুকিয়ে নিয়ে হাতের সাহায্যে সাবধানে আঘাত করে মাড়াই করে বা লাঠি দিয়ে আঘাত করে ফল থেকে বীজ সংগ্রহ করা যায়।
তারপর মানসম্মত বীজ সংরক্ষণ করতে বায়ুশূণ্য শুকনো পাত্রে রেখে তা ঠাণ্ডা, অন্ধকার জায়গায় রাখা হয়।
পুষ্টিগুণ:
কালোজিরাতে রয়েছে ফসফেট,লৌহ এবং ফসফরাসের মত পুষ্টি উপাদান। এছাড়া আরও আছে ক্যানসার প্রতিরোধক কেরটিন এবং বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধকারী উপাদান ও অম্ল রোগের প্রতিষেধক।
কালোজিরা এবং কালোজিরার তেল
কালোজিরার প্রধান পুষ্টি উপাদানের মধ্যে আরও রয়েছে-
আমিষ ২১ শতাংশ,
শর্করা ৩৮ শতাংশ,
স্নেহ বা ভেষজ তেল ও চর্বি ৩৫ শতাংশ,
ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ
প্রতি গ্রাম কালিজিরা পুষ্টি উপাদান হলো-প্রোটিন ২০৮ মাইক্রোগ্রাম;
ভিটামিন বি১ ১৫ মাইক্রোগ্রাম;
নিয়াসিন ৫৭ মাইক্রোগ্রাম;
ক্যালসিয়াম ১.৮৫ মাইক্রোগ্রাম;
আয়রন ১০৫ মাইক্রোগ্রাম;
ফসফরাস ৫.২৬ মিলিগ্রাম;
কপার ১৮ মাইক্রোগ্রাম;
জিংক ৬০ মাইক্রোগ্রাম;
ফোলাসিন ৬১০ আইউ।
কালোজিরার মধ্যে আরও আছে নাইজেলোন, থাইমোকিনোন ও স্থায়ী তেল।
পাশাপাশি কালোজিরার তেলে রয়েছে
লিনোলিক এসিড,
অলিক এসিড,
ফসফেট,
লৌহ,
ফসফরাস,
কার্বোহাইড্রেট,
ক্যালসিয়াম,
পটাশিয়াম,
আয়রন,
জিংক,
ম্যাগনেশিয়াম,
সেলেনিয়াম,
ভিটামিন-এ, বি এবং বি২, সি
নিয়াসিন, এছাড়াও
জীবাণুনাশক বিভিন্ন উপাদান যা হাজারও উপকার করে।
উপকারিতা:
ছোট্ট বীজ কালোজিরার গুণের শেষ নেই। এটি মরণ ব্যাতীত অন্য সকল রোগের ওষুধ।
ভেষজ গুণ: আয়ুর্বেদীয় , ইউনানী, কবিরাজী ও লোকজ চিকিৎসায় ব্যবহার হয়।
জ্বর, সর্দি, কাশি-কফ, খাবরে অরুচি, উদরাময়, শরীর ব্যথা, গলা ব্যথা ও দাঁতের ব্যথা, বাতের ব্যথা, পেটের বাথা, মাথাব্যথা কমাতে, মাথা ঝিমঝিম করা, মাইগ্রেন কিংবা সাইনাস নিরাময়ে যথেষ্ট উপকারী বন্ধু হিসেবে কাজ করে কালোজিরা।
এছাড়াও পেটফাঁফা, চামড়ার ফুসকুরি, ব্রঙ্কাইটিস, এলার্জি, একজিমা, এজমা, শ্বাসকষ্ট বা হাঁপানি রোগ; ডায়রিয়া, আমাশয়, গ্যাসট্রিক আলসার, জন্ডিস, খোসপাঁচড়া, দাদে কালোজিরা অব্যর্থ ওষুধের মতোন কাজ করে।
হার্টের বিভিন্ন রকম সমস্যা, হাইপারটেনশন এবং নিম্ন রক্তচাপকে বাড়িয়ে তুলে। এবং অন্যদিকে উচ্চ রক্তচাপকে কমিয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি কমিয়ে রক্তের স্বাভাবিকতা বজায় রাখে।
তাছাড়া মস্তিষ্কের রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করার মাধ্যমে স্মরণশক্তি বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে।
কালোজিরা শরীরের জন্য খুবই উপকারি। এটি পেটের যাবতীয় রোগ-জীবাণু এবং গ্যাস দূর করে।
তরিতরকারিতে ব্যবহার: মশলা হিসাবে কালোজিরার ব্যাপক ব্যবহার হয়ে থাকে। এটি পাঁচ ফোড়নের একটি উপাদান।
অন্যান্য:
কালোজিরার বীজ থেকে পাওয়া যায় কালোজিরা তেল। যার নানাবিধ ব্যবহার রয়েছে।
ওষুধ শিল্প, কনফেকশনারি শিল্প পাশাপাশি রন্ধনশালায় নিত্যদিনের ব্যঞ্জরিত খাবার তৈরিতেও কালোজিরা ব্যবহারের জুড়ি নেই।
বিভিন্ন পানীয় দ্রব্যকে রুচিকর ও সুগন্ধি করার জন্য কালোজিরা ব্যবহার করা হয়।
কালোজিরা ফুলের মধু উৎকৃষ্ট মানের মধু হিসেবে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত।
বর্তমানে কালিজিরা ক্যাপসুলও বাজারে পাওয়া যায়।
রূপচর্চায়ও ব্যবহার করা হয় কালোজিরার তেল।
এটি চুল পড়া রোধ করে এবং নতুন চুল গজাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে
কালোজিরা বিভিন্ন গুণে গুণাণ্বিত। এটি শুধু রোগ নিরাময়েই নয়, আশ্চর্য এই বীজ কালোজিরার উপকারিতা বহুমুখী।ভেষজ থেকে শুরু করে রান্না, রপচর্চায় এর ব্যবহারের অন্ত নেই।