১৯৮১ সালের ৩০শে মে ভোররাতে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হন একদল সেনা সদস্যের হাতে। হত্যা করে তার মরদেহ গোপন স্থানে দাফন করে ফেলেন সেনা কর্মকর্তারা। তারপর জিয়াউর রহমানের মৃতদেহের খোঁজ মিলেছিল চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ে।
কিভাবে দুর্গম পাহাড়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃতদেহের খোঁজ মিলে আজকে আমরা জানবো সে ইতিহাস সম্পর্কে।
যেদিন সাবেক রাষ্টপতি খুন হয়েছিলো সেই ঘটনার আগের দিন তিনি চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন তাঁর প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপির স্থানীয় নেতাদের মধ্যে বিরোধ মেটাতে।
চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত তৎকালীন বিএনপি নেতাদের সঙ্গে বৈঠক শেষ করে ২৯শে মে রাতে স্থানীয় সার্কিট হাউজে ঘুমিয়ে ছিলেন জিয়াউর রহমান।
হত্যাকণ্ডের পর ৩০শে মে সকালে ঘটনাস্থল সার্কিট হাউজে গিয়েছিলেন তৎকালীন সেনাবাহিনী মেজর রেজাউল করিম রেজা।
মি. রেজা বলছিলেন তাকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে সার্কিট হাউজে পাঠানো হয়েছিল। কারণ সেখানে আগে থেকে অবস্থান নিয়ে থাকা কেছু সৈন্য ছিলো, তাদের নিরাপদে সরিয়ে নেবার উদ্দেশ্যে।
“কর্নেল মতিউর রহমান আমাকে ডেকে নিয়ে যান। তিনি বলেন যে জিয়াউর রহমানের ডেডবডিটা কিছু ট্রুপস সঙ্গে নিয়ে সার্কিট হাউজ থেকে নিয়ে গিয়ে পাহাড়ের ভেতরের কোন স্থানে কবর দেবার জন্য। আমি তখন তাকে বললাম আমি অপারগ,আমাকে অন্য কাজ দেন। তারপর তিনি মেজর শওকত আলীকে ডেকে সেই দায়িত্ব দিলেন।”
“তখন তিনি আবার আমাকে ডেকে বললেন যে তুমি এদের সাথে থাক এবং সাথে যাও। গিয়ে সার্কিট হাউজে প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্ট এর সব সৈন্যদের নিয়ে আসবে। সেদিন সার্কিট হাউজে যাবার পর আমি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠি। উঠে দেখি সিঁড়ির বারান্দায় একটা ডেডবডি কম্বল দিয়ে ঢেখে রাখা আছে। পাশে একজন পুলিশ দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছিলো। আমি তাকে জিজ্ঞাস করলাম, এটা কার ডেডবডি? উত্তরে সে বলল, এটা রাষ্ট্রপতির। আমি তাকে বললাম কম্বলটা খোল। সেটা খোলার পর আমি দেখলাম সেখানে তাঁর মাথাটা।”
তার কাছাকাছি দূরত্বেই পড়ে ছিল কর্নেল এহসান এবং ক্যাপ্টেন হাফিজের মৃতদেহ।
অতঃপর ঘটনাস্থল থেকে মেজর রেজাউল করিম রেজা চট্টগ্রাম সেনানিবাসে চলে যান । আর অপরদিকে মেজর শওকত আলী তার দলবল নিয়ে চলে যায় জিয়াউর রহমানের মৃতদেহ কবর দিতে।
মেজর রেজাউল করিম রেজা সার্কিট হাউজ থেকে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট ফিরে গিয়ে দেখেছিলেন সেখানে যুদ্ধের পরিবেশ বিরাজমান।
মেজর রেজার মতোনই যেসব সেনা কর্মকর্তা হয়তো ছুটিতে ছিলেন নতুবা অন্য কোন কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তাদের সকলকে ডেকে এনে বিভিন্ন দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।
মেজর রেজার কাঁধে নতুন করে চাপে মেজর জেনারেল এ মঞ্জুরের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তার দায়িত্বের ভার।
চট্টগ্রাম সেনানিবাসের তৎকালীন জিওসি মেজর জেনারেল এ মঞ্জুর ৩০শে মে সারাদিন কর্মকর্তা ও সৈন্যদের বিভিন্ন ব্যারাকে ঘুরে-ঘুরে বক্তব্য রেখেছেন।
আর প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তার দায়িত্ব থাকায় সারাদিন জেনারেল মঞ্জুরের সাথে থাকতে হয়েছে মেজর রেজাউল করিম রেজাকে।
জেনারেল মঞ্জুর যেসময় সেনানিবাসের ভেতরে বিভিন্ন জায়গায় বক্তব্য দিচ্ছিলেন সেসময় একপর্যায়ে তাঁর কাছে ঢাকা সেনানিবাস থেকে একটি টেলিফোন আসে।
টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে বলা হয় যে জেনারেল এরশাদ মেজর জেনারেল মঞ্জুরের সঙ্গে কথা বলতে চান।
কিন্তু জেনারেল এরশাদের সাথে কথা বলার ব্যাপারে একদমই আগ্রহী ছিলেন না জেনারেল মঞ্জুর।
জেনারেল এরশাদ ২ বার ফোন করার পরও সে টেলিফোন রিসিভ করেননি জেনারেল মঞ্জুর।
এ সময় জেনারেল মঞ্জুর এর সঙ্গে থাকা তার প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা মেজর রেজাউল করিম রেজা সম্পূর্ণ ঘটনাটি একেবারে কাছ থেকেই দেখেছেন।
মি. রেজা বলছিলেন, “আর্মি হেডকোয়ার্টার থেকে একটা ফোন কল এসেছিল। জেনারেল মঞ্জুর সে ফোন রিসিভ করলেন। অপর প্রান্ত থেকে বলছে, জেনারেল এরশাদের সঙ্গে কথা বলেন। তখন জেনারেল মঞ্জুর বললেন, আই ক্যান নট টক টু এরশাদ। এ কথা বলেই সাথে সাথে তিনি টেলিফোনটা রেখে দিলেন। এরপর আবার টেলিফোন আসল। টেলিফোনে বলা হলো, ফর গড সেক স্যার, ফর গড সেক- ইউ টক টু জেনারেল এরশাদ। জেনারেল মঞ্জুর টেলিফোনটা এমনভাবে ধরেছিলেন যে সব কথা আমি ক্লিয়ার শুনতে পাচ্ছিলাম। জেনারেল মঞ্জুর আবারও বললেন, আই ক্যান নট টক টু হিম। এ কথা বলে তিনি টেলিফোনটা রেখে দিলেন।”
মি. রেজার কাছে মনে হচ্ছিল মেজর জেনারেল মঞ্জুরের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে জেনারেল এরশাদ হয়তো ক্ষমতায় আসীন হতে চাচ্ছেন।
কিন্তু জেনারেল মঞ্জুর হয়তো জেনারেল এরশাদকে ক্ষমতায় মেনে নিতে চাননি।
জিয়া হত্যার পটভূমি:
জিয়াউর রহমানকে হত্যা করার পটভূমি সাজানো হয়েছিল আরও আগে থেকেই।
বিএনপি’র প্রয়াত সিনিয়র নেতা ও ব্রিগেডিয়ার (অব.) হান্নান শাহ মনে করেন সম্পূর্ণ বিষয়টি পূর্বপরিকল্পিত। মৃত্যুর বেশ কয়েক বছর আগে সংবাদ মাধ্যমের এক সাক্ষাৎকারে মি. শাহ একথা উল্লেখ করেছিলেন।
জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সময় মি. হান্নান শাহ ব্রিগেডিয়ার পদমর্যাদায় চট্টগ্রাম মিলিটারি একাডেমিতে কর্মরত ছিলেন।
সাক্ষাৎকারে হান্নান শাহ বলেছিলেন, জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের বছর দু’য়েক আগ থেকেই সেনাবাহিনীর কতিপয় সিনিয়র অফিসারদের ভেতরে প্রবল দ্বন্দ্ব চলছিল। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এ দ্বন্দ্ব সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন। সেজন্য দ্বন্দ্বে লিপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের তিনি পরস্পরের কাছ থেকে বেশ দূরের দূরের স্থানগুলোতে পোস্টিং দিয়ে রেখেছিলেন।
হান্নান শাহ আরও বলেন, “সেনাবাহিনীর একদল অফিসার জিয়াউর রহমানের এসব কর্মকাণ্ডে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাদের মনে হয়েছিল, যে সব অফিসার এবং সৈনিক মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে আটকা ছিলেন এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরবর্তীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন, জিয়াউর রহমান তাদের প্রতি বেশি সহানুভূতিশীল এবং তাদেরকে বেশি সুযোগ-সুবিধা প্রদান করছেন।”
এ ব্যাপারটি নিয়ে ক্ষোভ থেকেই একদল সৈনিক এবং সেনা কর্মকর্তা একত্রে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে হত্যা করেছিল বলে হান্নান শাহ’র ধারণা।
মেজর রেজাউল করিম রেজাও একই অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি বলছিলেন, চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ডেকে নিয়ে যাওয়ার পর কর্নেল মতিউরের কথা-বার্তায় তার সেটি মনে হয়েছে।
ঐদিন কর্নেল মতিউর মেজর রেজাকে বলেন, “রেজা তুমি কোথায় ছিলে? তোমাকে তো সময়মতো পাওয়া যায় না। আমি বললাম, কী হয়েছে? তখন তিনি বললেন, তুমি জানো না? প্রেসিডেন্ট ইজ কিল্ড। এখন আমাদের সব ফ্রিডম ফাইটারদের ইউনাইটেড থাকতে হবে।”
জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের সময়টায় সেনাবাহিনী প্রধান ছিলেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। এ বিষয়টি নিয়ে তিনি কোন কিছুই বলতে রাজী হননি। আর সে সময় বাংলাদেশের ভাইস-প্রেসিডেন্ট ছিলেন বিচারপতি আব্দুস সাত্তার।
তখন মি. সাত্তার দায়িত্ব নিয়ে ৩০শে মে দুপুর নাগাদ রেডিও-টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছিলেন।
বিচারপতি সাত্তার সরকারের যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী ছিলেন কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ।
যিনি পরবর্তী কালে ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকারের পূর্ণ মন্ত্রী পদে নিযুক্ত ছিলেন।
২০০৬ সালের দিকে কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ বিএনপি ত্যাগ করে এলডিপি গঠন করেন।
৩০শে মে সকাল ৮:৩০ এর দিকে বঙ্গভবন থেকে রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব অলি আহমেদকে হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জানিয়েছেন।
তখনই মি. আহমেদ দ্রুত বঙ্গভবনের দিকে যান। সে সময় সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ, বিমান এবং নৌ বাহিনীর প্রধানসহ আরো কয়েকজন ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তারা একসঙ্গে বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন।
তারা সকলেই বিচারপতি আব্দুস সাত্তার এর সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।
জিয়াউর রহমানকে হত্যাকাণ্ডের দিন অর্থ্যাৎ ৩০শে মে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে যে যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজমান ছিল সেটি তার পরের দিন থেকেই দ্রুত পাল্টাতে থাকে।
৩০শে মে অন্যান্য সেনা কর্মকর্তাদের মতো হান্নান শাহকেও মিলিটারি একাডেমি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বিদ্রোহের পক্ষে সমর্থন চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু হান্নান শাহ তার অপারগতা প্রকাশ করেন।
তবে ৩১শে মে ঢাকার সাথে সমঝোতার জন্য মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অংশগ্রহণ করতে অনুরোধ করা হয় হান্নান শাহকে। ৩১শে মে পুরোদিন হান্নান শাহ ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন।
সেদিন রাতে তিনি যখন চট্টগ্রাম সেনানিবাসে বৈঠকে বসেছিলেন, তখন সেই বৈঠক থেকে বের হয়ে জেনারেল মঞ্জুরসহ আরও কয়েকজন পালিয়ে গিয়েছিলেন।
হান্নান শাহ বলছিলেন, ৩১শে মে বিদ্রোহের সাথে জড়িত সৈনিক এবং অফিসারদের ভেতর কোন কারণে বিভক্তি পরিলক্ষিত হল।
এরই মধ্যে বিদ্রোহীদের পক্ষ ছেড়ে দিয়ে অনেকেই বিচারপতি সাত্তার সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। এসকল সংবাদ পেয়ে জেনারেল মঞ্জুর বেশ বিচলিত হয়ে পড়েন।
পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে চট্টগ্রাম ক্যান্টনম্যান্ট ছেড়ে পালিয়ে যান জেনারেল মঞ্জুরসহ আরো বেশ কয়েকজন উর্ধতন সেনা কর্মকর্তা।
সে রাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে হান্নান শাহ ব্যক্ত করেন, “৩১শে মে রাত ১১টার দিকে জেনারেল মঞ্জুরের বাসা থেকে হঠাৎ একটি ফোন এলো। তিনি আমাকে এবং আরো কয়েকজন কর্মকর্তাকে বসিয়ে রেখে ওনার অফিস থেকে বাসায় গেলেন। কিন্তু ঘণ্টা-খানেক পরেও তিনি ফিরে এলেন না।
এমন অবস্থায় অন্য অফিসারদের তাদের কর্মস্থলে পাঠিয়ে দিয়ে আমি আমার কর্মস্থল মিলিটারি একাডেমিতে ফিরে আসলাম। ইতোমধ্যে আমি জানতে পারলাম, জেনারেল মঞ্জুর তাঁর পরিবার নিয়ে এবং অন্যান্য বিদ্রোহী অফিসাররা পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে পালিয়ে গেছে।”
মেজর জেনারেল মঞ্জুর ও কর্নেল মতিউর রহমান যে গাড়ির বহরে করে পালিয়েছিলেন, সেখানে মেজর রেজাউল করিম রেজা উপস্থিত ছিলেন।
গাড়িটি কিছুদূর অগ্রসর হয়ে একটি পাহাড়ি এলাকায় পৌঁছানোর পর সামনে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান তারা। তখন তারা লক্ষ্য করেন যে সামনে কিছু সংখ্যক সৈন্য পাহাড়ের দিকে ছুটোছুটি করছে। সে সময় জেনারেল মঞ্জুর গাড়ি অন্যদিকে ঘুরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেন। কিন্তু সেসময় তাদের বহনকারী গাড়িটি হঠাৎ বিকল হয়ে পড়ে।
তাৎক্ষণাত তারা অন্য একটি গাড়িতে করে পেছনের দিকে চলে আসেন পেছনের দিকে চলে আসেন।
সেখানে একটি গ্রামে পৌছে তারা গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করেন। এলাকাটি চা বাগান ছিল। জেনারেল মঞ্জুর তখন সেই চা বাগানের এক কুলির বাড়িতে আশ্রয় নেন। কারণ তখন তার সন্তানরা ছিল ক্ষুধার্ত। সেখানে জেনারেল মঞ্জুরের সন্তানদের জন্য আহারের ব্যবস্থা করা হয়। আর তার সঙ্গে ছিলেন জেনারেল মঞ্জুরের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা মেজর রেজাউল করিম রেজা।
মি. রেজা বলছিলেন, “তারা যখন খাবার খেতে বসেছিলেন. তখন ওইখানে হঠাৎ কুকুরের ঘেউ-ঘেউ শব্দ শুনতে পাই। তখন আমরা লক্ষ্য করলাম বেশ খানিকটা দূরে পাহাড়ি এলাকায় খাকি পোশাকের পুলিশ দেখা যাচ্ছে। তখন জেনারেল মঞ্জুর বললেন যে আমি পুলিশের কাছে সারেন্ডার করবো।”
পুলিশ সদস্যরা যখন সামনের দিকে অগ্রসর হয়েছিল তখন জেনারেল মঞ্জুর জঙ্গলের ভেতরে দাঁড়িয়ে যান।
মেজর রেজার বর্ণনা অনুসারে জেনারেল মঞ্জুর তখন পুলিশের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, “এই যে বাবারা তোমরা ঐখানে থাক। সামনে আসিবে না। সামনে আসিলে তোমাদের অসুবিধা হইবে। আমি আসিতেছি। এ কথা বলে হনহন করে হেঁটে গিয়ে পুলিশের কাছে সারেন্ডার করলেন। এবং তারপর আমিও গিয়ে সারেন্ডার করলাম।”
আত্মসমর্পণের পর তাদের নিয়ে যাওয়া হয় হাটহাজারী থানায়। সেখানে জেনারেল মঞ্জুর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পুলিশ তাকে বাধা দিল। কর্মকর্তারা তাকে জানায় যে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলা যাবে না।
এরপর তাদের দু’জনকে পুলিশের একটি ট্রাকে ওঠানো হলো। ঐ সময় একদল সেনা সদস্য এসেছিলো সেখানে।
একজন সেনা সদস্য জেনারেল মঞ্জুরের স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বললো, ভাবী আমরা আপনাদের নিতে এসেছি। কিন্তু জেনারেল মঞ্জুরের স্ত্রী জানালেন তারা পুলিশের নিকট আত্মসমর্পণ করেছেন এবং এখন চট্টগ্রাম জেলে যাবেন। তিনি সৈন্যদের সঙ্গে সেনানিবাসে ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানান।
মেজর রেজার বর্ণনানুযায়ী তখন জেনারেল মঞ্জুর সেনা সদস্যদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন , “তোমাদের লজ্জা করে না? তোমরা সব ঘটনা ঘটাইলা, তোমরা আবার সারেন্ডার করলা। তোমরা আইছো আমাকে ধইরা নিতে। যাও, আমি তোমাদের সাথে যাব না।”
সে সময় মুহুর্তেই একজন নায়েব সুবেদার এসে জেনারেল মঞ্জুরের হাত ধরে টেনে পুলিশের গাড়ি থেকে নামিয়ে আনে এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর হাত এবং চোখ বেঁধে ফেলে।
জেনারেল মঞ্জুরকে ধরে নেওয়র পর তাকে হত্যা করার অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে একটি হত্যা মামলা এখনো বিচারাধীন রয়েছে। হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সেই হত্যা মামলার অন্যতম আসামী।
আর অন্যদিকে সেসময় পালানোর চেষ্টা করেছিল কর্নেল মতিউর রহমান। পালানোর সময় গুলিতে নিহত হয়েছিলেন তিনি।
সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান
অবশেষে জিয়াউর রহমানের মৃতদেহের খোঁজ এবং কবরের সন্ধান প্রাপ্তি
নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে পহেলা জুন জিয়াউর রহমানের মৃতদেহ খুঁজতে বের হয়েছিলেন ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহ। তাঁর সঙ্গে ছিল কতিপয় সিপাহী, একটি ওয়্যারলেস সেট এবং একটি স্ট্রেচার।
প্রথমে তারা কাপ্তাই রাস্তার অভিমুখে রওনা হয়েছিলেন। তারা একটি অনুমানের উপর নির্ভর করে নতুন কোন কবরের সন্ধান করছিলেন। তখন স্থানীয় এক গ্রামবাসী এসে তাদের জিজ্ঞাস করেন যে তারা কীসের খোঁজ করছেন?
ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহ এস সেই গ্রামবাসীকে জিজ্ঞাস করেন যে, সেনাবাহিনীর সৈন্যরা সেখানে কোন ব্যক্তিকে খুব সম্প্রতি দাফন করেছে কি না?
তখন সেই গ্রামবাসী একটি ছোট্ট পাহাড় দেখিয়ে তাদের জানালেন কয়েকদিন আগে সৈন্যরা সেই পাহাড়ে একজনকে কবর দিয়েছিল। তবে গ্রামবাসীরা জানতেন না যে কাকে সেখানে কবর দেয়া হয়েছিল।
গ্রামবাসীর খেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, হান্নান শাহ সৈন্যদের সঙ্গে করে নিয়ে সেখানে গিয়ে দেখেন নতুন মাটিতে চাপা দেওয়া একটি কবর।
আর তখনই সেখানকার মাটি খুঁড়তে শুরু করেন তারা। কবর খুঁড়ে সেখানে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃতদেহসহ আরো ২ সেনা কর্মকর্তার মরদেহ দেখতে পান তারা।
পুণঃরায় দাফন:
সেই গ্রাম থেকে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃতদেহ তুলে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে নিয়ে আসা হয়। আর সেখান থেকে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে জিয়াউর রহমানের মরদেহ ঢাকায় পাঠানো হয়।
ঢাকায় সংসদ ভবন এলাকার চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়াউর রহমানের মৃতদেহ পুণঃরায় দাফন করা হয়।
জিয়া হত্যার বিচার:
বিএনপি নেতা হান্নান শাহর ধারণা, সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের সঠিক বিচার না হওয়ায় সেই ঘটনা নিয়ে প্রচুর রহস্য রয়ে গেছে।
তৎকালীন সময়ে বিদ্রোহের অভিযোগে ১৮ জন সামরিক কর্মকর্তাদের বিচারের আওতায় আনা হয়েছিল। এবং শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। এদের মধ্যে ১৩ জন সেনা কর্মকর্তার ফাঁসি এবং বাকিদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়েছিল।