কেশর গাছ – যে গাছ থেকে পাওয়া যায় বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল মসলা জাফরান

কেশর গাছ – যে গাছ থেকে পাওয়া যায় বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল মসলা জাফরান
কেশর গাছ – যে গাছ থেকে পাওয়া যায় বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল মসলা জাফরান

বিশ্বের সবচেয়ে দামি ফসলের তালিকায় রয়েছে জাফরান এবং কফি। আর তাদের মধ্যে জাফরানই হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে দামি মসলা। যা কেশর গাছ নামক এক উদ্ভিদের ফুল থেকে পাওয়া যায়।

কেশর হচ্ছে এক ধরণের ফুল। এই ফুল থেকেই পাওয়া যায় জাফরান। যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এবং মিষ্টি খাবারে এর ব্যবহার হয় বেশি। খাবারের স্বাদ এবং রঙ আনতে এটি ব্যবহার করা হয়।

নামকরণ:

জাফরানের ইংরেজি নাম হচ্ছে স্যাফরন বা saffron. জাফরান একটি আরবি শব্দ। এর আরও একটি নাম রয়েছে কুম কুম।

এছাড়াও এর অন্যান্য স্থানীয় নাম saffron Za’afaran, Zaafaran Kesar, Zafran.

অত্যন্ত মূল্যবান মসলা হওয়ায় বাণিজ্যিক অঙ্গনে জাফরান কে লাল সোনা বা রেড গোল্ড নামে অবিহিত করা হয়।

বৈজ্ঞানিক নাম:

জাফরানের বৈজ্ঞানিক নাম – Crocus sativus.

পরিবার:

কেশর গাছ অটাম ক্রকাস (autumn crocus) নামক আইরিশ গোত্রের উদ্ভিদ।

এই উদ্ভিদের একটি ফুলের পরাগ বা গর্ভদন্ড (Stigmata) থেকে উৎপাদন করা হয় জাফরান।

উৎপত্তির আদিস্থান:

জাফরান সর্বপ্রথম চাষ হয় প্রাচীন গ্রীসে।

প্রাপ্তিস্থান:

বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারতের জম্বু ও কাশ্মীরে জাফরানের চাষ হয়। সেখান থেকে এনে আমরা এটা ব্যবহার করি।

এছাড়াও পা‌কিস্তান, তুরস্ক, ইতা‌লি, ইরান, স্পেনসহ ইউ‌রোপ এবং এশিয়ার অন্তত ২০ টি দে‌শে জাফরানের চাষ হয়।

ইরান এবং মিশর দেশগুলি শীতকালীন হওয়ায় সেখানে প্রচুর পরিমাণে জাফরানের চাষ হয়।

বাংলাদেশে জাফরান চাষের সুযোগ্য উপায় থাকলেও এর চাষ কেওই করে না।

আকার-আকৃতি:

জাফরান গাছ লম্বায় প্রায় ৩০ সেমি. পর্যন্ত হয়।

গঠন ও বৈশিষ্ট্য:

জাফরান বা কেশর গাছ একটি সপুষ্পক উদ্ভিদ। এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই গাছের ফুল হয়, কিন্তু ফল জন্মায় না।

পাতাগুলো লম্বাটে অনেকটা লম্বা ঘাসের মতো।

ফুল: জাফরান ফুল দেখতে যেমন আকর্ষণীয় তেমনি সুন্দর এর ঘ্রাণ। প্রাচীন কালে এই ফুলের নির্যাস থেকে তেল তৈরি করা হতো। যা সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষরা ব্যবহার করতো।

কেশর ফুল এবং মাঝের লাল পরাগ দন্ড
কেশর ফুল এবং মাঝের লাল পরাগ দন্ড

একটি কেশর গাছ সর্বমোট ৩-৪ বার কেশর ফুল দেয়। তাও মাত্র ১ সপ্তাহের জন্য।

কেশর গাছের কেশর ফুল হালকা বেগুনী রঙের হয়ে থাকে।  ফুলগুলি ৬ পাপড়ি বিশিষ্ট এবং প্রতিটি ফুলে ৩টি করে গর্ভদন্ড বা পুংকেশর থাকে।

ফল: কোন এক অজানা কারণে কেশর গাছে কোন ফল বা বীজ উৎপন্ন হয় না।

মূল জাফরান:

কেশর গাছের বেগুনী কেশর ফুল থেকে জাফরান পাওয়া যায়। প্রতিটি ফুলে ৩টি করে পুংকেশর বা পরাগ দন্ড এগুলোকে ইংরেজিতে বলে স্টিগমা।

এই পরাগ দন্ডই হচ্ছে আসল জাফরান। যা হলুদ এবং কমলার মিশ্রণে লাল বর্ণের হয়; একে জাফরানী রঙও বলা হয়ে থাকে। এই পরাগ দন্ড শুকিয়ে গেলে এগুলো মসলায় পরিণত হয়।

কৃষকরা এই পরাগ দন্ড বা পুংকেশর সংগ্রহ করে শুকিয়ে জাফরান প্রস্তুত করে।

ব্যয়বহুল মসলা জাফরান
ব্যয়বহুল মসলা জাফরান‘

বংশবিস্তার:

কেশর গাছে কোন ফল হয় না। যার ফলে বীজও পাওয়া যায় না। তাই এই উদ্ভিদের বংশ বিস্তারের জন্য মানুষের সাহয্য প্রয়োজন হয়।

কেশর গাছের ক্রোমগুলি মাত্র ১ বছর পর্যন্ত জীবিত থাকে। একারণে এই ১ বছরের মধ্যেই এই ক্রোমগুলিকে মাটিতে রোপন করে ফেলতে হয়।

উৎপাদনের সময়:

কেশর গাছ একটি শীতকালীন উদ্ভিদ। তাই এটি শীত কালেই বেশি চাষ করা হয়।

উপকারিতা বা ব্যবহার:

জাফরান অতি প্রাচীনকাল থেকেই পৃথিবীতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। খাওয়া সহ রূপচর্চা, ভেষজ ওষুধ উৎপাদনে এমনকি সুগন্ধী হিসেবেও এর ব্যবহার খুব একটা কম নয়। তবে অত্যন্ত দামী হওয়ায় তখন কেবল সম্ভ্রান্ত মানুষরা জাফরান ব্যবহার করতো।

এখন এর ব্যবহার বিস্তৃতি বহুগুণ বেড়েছে।

  • বিরিয়ানীতে জাফরান ব্যবহার করা হয়। যা বিরিয়ানীর সুন্দর রঙ তৈরি করার সাথে সাথে এর স্বাদ ও গন্ধ দুটিই বদলে দেয়।

  • দামী প্রসাধনী সামগ্রীতে জাফরান ব্যবহার করা হয়।

  • ত্বকের লাবন্য বৃদ্ধি করতে জাফরান ব্যবহার করা হয়। জাফরান ত্বককে উজ্জল করে। এবং ত্বককে সজীব ও সতেজ করে তোলে।

  • দুধের সাথে জাফরান মিশিয়ে খাওয়া হয়।

  • নিয়মিত পরিমিত পরিমাণে জাফরান খেলে ফুসফুসের বিভিন্ন রোগ দূর হয়।

  • জাফরান থেকে এক ধরণের কালি তৈরি করা হয় যা জাফরান কালি নামে পরিচিত। আরবী লিখার ক্ষেত্রে এই কালি ব্যবহৃত হয়।

জাফরানের বাজার দর:

ভীনদেশী বলে জাফরান দামে কিন্তু অন্যান্য মসলার তুলনায় অনেকটা বেশি। ১ কেজি জাফরানের দাম আড়াই থেকে ৩ লাখ টাকা। এজন্য পৃথিবীর সবচেয়ে দামি মসলা জাফরানকে বলা হয়।

অবশ্য এর এত দামের পেছনে যথেষ্ট কারণও রয়েছে। জাফরান চাষ অনেক জমি জুড়ে করা হলেও, অনেক শ্রম-শক্তি কিংবা অর্থ ব্যয় হলেও তার থেকে কিন্তু সেই পরিমাণ জাফরান পাওয়া যায় না।

আরো পড়ুন:
ফ্যাক্টরিতে কীভাবে বিভিন্ন মসলা প্রকৃয়াজাত করা হয়? 
অপরূপ সৌন্দর্য্যের আধার নিশিকমল বা ব্রহ্ম কমল ফুল

১ পাউন্ড বা ৪৫০ গ্রাম শুকনো জাফরান পেতে হলে তার জন্য ৫০-৭৫ হাজারটি ফুল প্রয়োজন হয়। এবং ১ কিলোর জন্য ১ লক্ষ ১০- ১ লক্ষ ৭০ হাজার ফুল দরকার হয়।

আর খুবই দ্রুত এই ফুল সংগ্রহ করে ফেলতে হয়। প্রায় ৪০ ঘণ্টা সময় লাগে ১ লক্ষ ৫০ হাজার ফুল তুলতে। কিন্তু কৃষকরা এই সময় আরও কমিয়ে আনার চেষ্টা করে। যার কারণে এটি অত্যন্ত কষ্টসাধ্যও।

তাই এই মসলার এত দাম।

তবে দাম বেশি হলেও গুণের কিন্তু কোন কমতি নেই। জাফরানের ছোঁয়ায় যেকোন খাবারের স্বাদ, গন্ধ এবং বিশেষ করে রঙ আমুল পাল্টে যায়। স্বাস্থের জন্য এটি খুব ভালো। একারণে দামে বেশি হলেও দিন দিন এর ব্যবহার বেড়েই চলেছে।

subscribe to our youtube channel 2

শেয়ার করুন -

উত্তর দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার নাম লিখুন