সাবান আবিষ্কার এর ইতিহাস

সাবান আবিষ্কার এর ইতিহাস
সাবান আবিষ্কার এর ইতিহাস

সাবান সে যেরকমই হোক, শক্ত কিংবা তরল, সুগন্ধীযুক্ত কিংবা সুগন্ধী ছাড়া এর কাজ কিন্তু একটাই, তা হলো পরিষ্কার করা। বর্তমান করোনা পরিস্থিতির মধ্যে সাবান খুবই পরিচিত এক ব্যবহার্য বস্তুতে পরিণত হয়েছে। তবে অদ্ভুদ বিষয় হচ্ছে সাবান আবিষ্কার ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজে এর ব্যবহারের ইতিহাস প্রায় ৫ হাজার বছরের পুরোনো।

আজকে আমাদের আলোচনা অতি ব্যবহার্য এই বস্তু সাবান আবিষ্কার এর ইতিহাস সম্পর্কে।

সাবান আবিষ্কার এর ইতিহাস:

সাবান আবিষ্কার এর ইতিহাস বহু পুরানো।  ইতিহাস ঘেটে জানা যায় মেসোপটেমিয়ায় সর্বপ্রথম সাবান ব্যবহারের প্রচলন শুরু হয়। তবে তখনকার সাবানে এখনকার মতন এত সুন্দর গন্ধ বা রূপ ছিল না।

সেইসব সাবান তৈরি করা হতো গরু, ছাগল, ভেড়ার চর্বি থেকে। এসকল পশুর চর্বি ক্ষারযুক্ত পানির সাথে মিশ্রণ করে এক ধরনের মন্ড তৈরি করা হতো। সেই আদি সাবান ঘষলে শরীরের ময়লা দূর হতো।

রোমান পন্ডিত প্লিনি দ্য এল্ডার তার ‘ন্যাচারালিস হিস্টোরিয়া’ বইটিতে সাবান তৈরির বর্ণনা দিয়েছেন। সেই বই থেকে যে তথ্য পাওয়া যায় তা হচ্ছে প্রাচীন কালের মানুষ এই সাবান ব্যবহার করে উলের কাপড়-চোপড় পরিষ্কারের কাজে ব্যবহার করতো। আবার তখনকার পুরুষরা চুল-দাড়িতে লালচে আভা আনার জন্য এই সাবান ব্যবহার করতেন।

প্রাচীনকালের মানুষজন এই সাবান দিয়ে নিজেদের শরীর পরিষ্কার কিংবা সুগন্ধীযুক্ত করতো না। কারণ তখন সাবানে কোন সুগন্ধী ব্যবহার হতো না আর এসবের চলও ছিল না।

এমনকি গ্রীক এবং রোমানদের সময়েও বাথটাবে গোসলে রেওয়াজ শুরু করার সময়কালে সাবান ছিল ব্রাত্য। শরীর পরিষ্কার আর সুগন্ধিযুক্ত করার জন্য তখন পুরুষ-নারী ‍উভয়েরই পছন্দ ছিল সুগন্ধী তেল।

মধ্যযুগে এসে ইউরোপে ভোজ্য তেল মূলত অলিভ ওয়েল হতে সাবান উৎপাদন শুরু হয়। সিরিয়ায় তৈরি করা হতো এই সাবান। সেসময় ধনী ব্যাক্তিরাই সাবান ব্যবহার করতো। এই সাবান ছিল বেশ সুন্দর গন্ধ যুক্ত।

এরপর ইউরোপীয় ব্যবসায়ী ও কিছু ধর্মীয় সংগঠনের হাত ধরে সাবান ছড়িয়ে পড়তে আরম্ভ করে ইউরোপের বিভিন্ন অংশে।

বিস্তৃতির কারণে পরবর্তীতে ফ্রান্স, স্পেন এবং ইতালির লোকেরাও সাবান ব্যবহার করতে শুরু করে। এবং তারাও তৈরি করতে থাকে বিভিন্ন প্রকারের সাবান।

এরমধ্যে স্পেনে তৈরি করা জ্যবোন দ্যা ক্যাস্টিলো সাবানের জনপ্রিয়তা খুব বেড়ে যায়। যার রেশ এখনো পাওয়া যায়। এখনো কিছু কিছু অনলাইন শপিং পোর্টালে ক্যাস্টিলা সাবান পাওয়া যায়। এই সাবানটির রং ছিল সাদা।

খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ সালের দিকে প্রকাশিত চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ক লেখা দি ইবার্স প্যাপিরাস থেকে জানা যায়, সেই যুগে মিসরে বিভিন্ন পশুর চর্বি এবং সবজির তেলের সঙ্গে অ্যালকাইন লবণ যুক্ত করে অনেকটা সাবান এর মতো এক মিশ্রণ প্রস্তুত করা হতো। তবে সেই সাবানজাতীয় দ্রব্য দিয়ে শুধুমাত্র পরিচ্ছন্নতার কাজই নয়, বিভিন্নরকম চর্মরোগের চিকিৎসায়ও তা ব্যবহৃত হতো।

তবে বর্তমানে আমরা যেসব সাবান ব্যবহার করি, তা এসেছে ১৮২৩ সাল নাগাদ। বিখ্যাত রসায়নবিদ মিশেল ইউজিন শেভ্রুলের হাত ধরে। ফরাসি এই বিজ্ঞানীই প্রথম চর্বির সঙ্গে গ্লিসারিন এবং আরও বিভিন্ন উপকরণ মিশিয়ে সাবান তৈরির এক অভিনব  কৌশল আবিষ্কার করেন।

নিউইয়র্কের কোলগেট সংস্থাটির পতনের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে আধুনিক সাবান তৈরির কার্যক্রম। একই বছরেই সিনসিনাটিতে প্রোক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বলও পথ চলা আরম্ভ করে।

আর এরপর থেকেই প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে সাবান তৈরির পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে।

কিন্তু সাবানের ব্যবহার তখনো তেমন ব্যাপকতা পায় নি। চর্বির ব্যবসায়ের একটি উপজাত পণ্য হিসেবেই তখন সাবানকে বিবেচনা করা হতো। সেসময় সাবান মূলত কাপড়-চোপড় কাচার কাজে লন্ড্রিতে ব্যবহৃত হতো। চর্বি দিয়ে পাশাপাশি সাবান এবং মোম তৈরি করা হতো।

প্রোক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বলের সাবান শ্রমিকরা একটি বিশালাকারের কড়াইয়ের মধ্যে হোটেল, বাড়ি এবং কসাইদের কাছ থেকে সংগৃহীত চর্বি ফোটাতো; সাবান ও মোমবাতি উৎপাদনের জন্য।

বাণিজ্যিকভাবে সাবান উৎপাদন আরম্ভ হয় দ্বাদশ শতকের কোনো একসময়, যুক্তরাজ্যে। এরপরেই সাবান ব্যবহারে এক নাটকীয় পরিবর্তন চলে আসে।

‘রোজ গোসল এবং শরীর পরিস্কার করলে স্বাস্থ্য ভালো থাকে’ নাম না জানা কোন এক ব্যাক্তির এমন এক প্রচারের মাধ্যমেই এর ব্যবহার ক্রমশ বাড়তে থাকে। এর জন্য তাকে অবশ্যই ধন্যবাদ জানানো দরকার।

এরপর আস্তে আস্তে সাবানের গুণগত মান পরিবর্ত হতে শুরু করে। ১৮৬১ সাল নাগাদ বেলজিয়ান রসায়নবিদ আর্নেস্ট সলভে এর পরিবর্তনের কাজে প্রধান ভূমিকা রাখেন।

তিনি শেভ্রুলের কৌশলের উপর ভিত্তি করেই সাবান তৈরির দ্রব্যে সোডা অ্যাশ ব্যবহার করে এর গুণগত মান বৃদ্ধি করেন। সাবানের বাণিজ্যিক ব্যবহার বৃদ্ধিতে যা ছিল এক বিরাট অগ্রগতি।

১৮৭৯ সালের দিকে ‘আইভরি’ নামের এক সাবান বাজারে আনে টি অ্যান্ড জি। এই সাবানই আমেরিকায় প্রথম সুগন্ধি যুক্ত বাথরুম সাবান হিসেবে খ্যাতি পায়।

আমেরিকার প্রথম সুগন্ধি যুক্ত সাবান- আইভরি সাবান
আমেরিকার প্রথম সুগন্ধি যুক্ত সাবান- আইভরি সাবান

১৮৯৮ সালে জনপ্রিয় জনসন কোম্পানি বাজারে আনে পামোলিভ সাবান। যেটা দীর্ঘদিন যাবৎ বাজারে সুখ্যাতি কুড়িয়েছিল এবং ১ নম্বর স্থান দখল করে ছিল।

১৯০৯ সাল থেকে সাবান বর্তমানের রূপ ধারণ করতে শুরু করে। সাবান তৈরির সংস্থাগুলো দিনে দিনে সবান তৈরির উপাদান বদলে ফেলে। চর্বির বদলে রাসায়নিক ব্যবহারও শুরু করে।

আজকাল বাজারে যেসব সাবানের ছড়াছড়ি তার সবগুলোই রাসায়নিক দ্বারা ল্যাবরেটরিতে তৈরি।

আরো পড়ুন:
আইসক্রিম আবিষ্কারের ইতিহাস ও পর্যায়ক্রমে এর বিবর্তন 
লিপস্টিক কীভাবে তৈরি হয় এবং এর ইতিহাস 
টেলিস্কোপ আবিষ্কারের ইতিহাস – বিভিন্ন ধরনের টেলিস্কোপ

ত্বকের পি এইচ লেভেল বজায় রাখে এমন সাবান, লিকুইড সাবান, সুগন্ধী সাবান, দামী-কমদামী বিভিন্ন রকম সাবান এখন বাজারে পাওয়া যায়। আরও নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে এসব সাবানে যুক্ত করা হচ্ছে ভিন্ন রূপ, গন্ধ, কার্যকারিতা। তাই সাবান এখন মানুষের জীবনের এক অপরিহার্য বস্তুতে পরিণত হয়েছে।

subscribe to our youtube channel 2

শেয়ার করুন -

উত্তর দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার নাম লিখুন