ভারতে শনাক্ত করোনার নতুন ধরন ‘বি-ওয়ান-সিক্সসেভেনটিন’ কতটা বিপজ্জনক?
করোনাভাইরাস মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কায় নাকাল অবস্থা পুরো বিশ্ববাসী। ভারতের অবস্থা আরও খারাপ। আর এরই মধ্যে ভারতীয়দের উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে করোনার নতুন ধরন (স্ট্রেইন) ‘বি-ওয়ান-সিক্সসেভেনটিন’।
করোনায় আক্রান্ত হয়ে দিন দিন বাড়ছে রোগীর সংখ্যা, বাড়ছে মৃত্যু। ভরতের শ্মশানগুলোয় দিন-রাত জ্বলছে চিতা।
হাসপাতালে শয্যার সংকট, অক্সিজেন সংকট, অর্থ সংকটসহ নানা সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে দেশটিতে। আর তার উপর পরিবর্তিত হয়ে তৈরি হওয়া করোনার নতুন ধরনের ধাক্কা সামাল দিতে নাস্তানাবুদ ভারত।
ভারতীয় জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি মারফত জানা যায়, দেশটির কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, গত শুক্রবার থেকে গতকাল শনিবার পর্যন্ত মাত্র ২৪ ঘন্টার ভেতরেই ভারতে নতুন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন ৩ লাখ ৪৬ হাজার।
গত বেশ কয়েক দিন যাবৎ ভারতে দৈনিক রোগী শনাক্তের সংখ্যা ৩ লাখ ছাড়াচ্ছে। কমার বদলে দিন দিন এই সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
শনিবার সকাল পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী ভারতে করোনা ভাইরাস সংক্রমিত মোট রোগী শনাক্তের সংখ্যা ১ কোটি ৬৬ লাখ ১০ হাজার ৪৮১ জন। এদের মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১ কোটি ৩৮ লাখ ৬৭ হাজার ৯৯৭ জন।
অর্থ্যাৎ উপসর্গহীন, মৃদু, মাঝারি এবং গুরুতর অসুস্থ- সব মিলিয়ে শনিবার পর্যন্ত ভারতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় করোনা রোগী ছিলেন ২৭ লাখ ৪২ হাজার ৪৮৪ জন। রোগীর সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে পাশাপাশি বেড়ে চলেছে মৃত্যুর সংখ্যাও।
ভারতীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত শুক্রবার থেকে গতকাল শনিবার পর্যন্ত ভারতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু ঘটেছে ২ হাজার ৬২৪ জনের। এ নিয়ে ভারতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত মোট ১ লাখ ৮৯ হাজার ৫৪৪ জন মারা গেলেন।
তবে পরিবর্তিত হয়ে রূপ নেওয়া ‘বি-ওয়ান-সিক্সসেভেনটিন’ এ ক্ষেত্রে ঠিক কতটা দায়ী, তা অবশ্য সঠিকভাবে নিরূপণ করতে পারেননি গবেষকেরা।
সৃষ্টিহওয়া করোনারনতুনধরনবাস্ট্রেইন আসলে কী?
যেকোনো ভাইরাসই প্রতি মুহূর্তে নিজেদের রূপ পরিবর্তিত করে, নিজেদের নতুন নতুন সংস্করণ কিংবা ধরন অর্থ্যাৎ স্ট্রেইন সৃষ্টি করে। তবে ভাইরাসের অধিকাংশ পরিবর্তনই ততটা উল্লেখযোগ্য কিছু নয়।
কোনো কোনো পরিবর্তনের কারণে ভাইরাসগুলো দুর্বলও হয়ে পড়ে। কিন্তু একইসাথে আবার কোনো কোনো পরিবর্তনের পর ভাইরাস আরও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। যার প্রভাব থেকে প্রচলিত টিকার মাধ্যমে সুরক্ষা পাওয়া দুরূহ হয়ে পড়ে।
ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ভারতে তৈরি হওয়া করোনার নতুন ধরনটির নাম গবেষকেরা রেখেছেন ‘বি-ওয়ান-সিক্সসেভেনটিন’। নতুন ধরনের এই ভাইরাস ‘বি-ওয়ান-সিক্সসেভেনটিন’ সর্বপ্রথম শনাক্ত হয় গত অক্টোবর মাসে।
সেসময় দেশটি সবেমাত্র করোনাভাইরাসের প্রথম ধাক্কা সামাল দিয়ে উঠছে। তবে গত মার্চ থেকে ভারতে সংক্রমণ আবার বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। গবেষকেরা বলেছেন, এটি হচ্ছে ভারতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ।
করোনার নতুন ধরন ‘বি-ওয়ান-সিক্সসেভেনটিন’ কতটা ছড়িয়েছে
এক সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনার নতুন ধরনটি কতটা ছড়িয়েছে, এটা নির্ণয়ে ভারতে বড় পরিসরে এখনো কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়নি।
তবে ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য মহারাষ্ট্রে গত জানুয়ারি-মার্চ মাস পর্যন্ত সংগৃহীত ৩৬১টি নমুনার মধ্যে ২২০টিতেই করোনার নতুন ধরনটি শনাক্ত হয়েছে।
বৈশ্বিক তথ্যভান্ডার GISAID-এর তথ্যানুসারে, করোনার নতুন ধরনটি এরই মধ্যে অন্তত ২১টি দেশে ছড়িয়ে পরেছে।
‘বি-ওয়ান-সিক্সসেভেনটিন’ কি আরওবেশি সংক্রামক?
গবেষকরা এখনো পরিপূর্ণ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি, ‘বি-ওয়ান-সিক্সসেভেনটিন’ আরও বেশি সংক্রামক কি না।
এমনকি করোনা মোকাবিলায় যে টিকাগুলো দেশে দেশে প্রয়োগ করা হচ্ছে, সেগুলো এই নতুন ধরনের বিরুদ্ধে কতটুকু কার্যকর, আদৌ কার্যকর কি না তাও এখনো স্পষ্ট নয়।
উল্লেখ্য, ভারতে তৈরি হওয়া করোনার নতুন ধরন ‘বি-ওয়ান-সিক্সসেভেনটিন’ উল্লেখযোগ্য ২টি পরিবর্তনের পর সৃষ্টি হওয়ায় একে ‘ডাবল মিউট্যান্ট’ বলছেন গবেষকরা।
তবে ভারতীয় এই ধরনের চেয়ে যুক্তরাজ্যে তৈরি হওয়া করোনার ধরনটি আরও বেশি সংক্রামক ও বিপজ্জনক কি না, সে ব্যাপারে এখনো নির্ভূল সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। যুক্তরাজ্যের এই ধরনটিও ৫০টিরও অধিক দেশে ছড়িয়েছে।
ভারতীয় ধরন ‘বি-ওয়ান-সিক্সসেভেনটিন’ সম্পর্কে এত কম তথ্য কেন
বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের ভারতীয় নতুন ধরনের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত পাওয়া অধিকাংশ তথ্যই অসম্পূর্ণ। এবং নতুন এই ভাইরাসটির খুব কম নমুনাই তাঁরা এখন পর্যন্ত সংগ্রহ করতে পেয়েছেন।
করোনার নতুন ধরনটির নমুনা ভারত থেকে পাওয়া গেছে ২৯৮টি। আর বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে সংগ্রহ করা গেছে ৬৫৬টি নমুনা।
পক্ষান্তরে যুক্তরাজ্যের তৈরি হওয়া নতুন ধরনটির নমুনা পাওয়া গেছে ৩ লাখ ৮৪ হাজারের বেশি।
ভাইরাস বিশেষজ্ঞ জেরেমি কামিল বলছেন, ভারতে করোনার নতুন ধরনটি শনাক্তের পর গোটা বিশ্বজুড়ে এটি ৪০০টিরও কম নমুনা শনাক্ত হয়। তাই, গবেষকরা নতুন এই ধরনটির গবেষণার কাজ যথাযোগ্য ভাবে এগিয়ে নিতে পারছেন না বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ।
ভারতে সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণ কি ‘বি-ওয়ান-সিক্সসেভেনটিন’?
ভারতে বর্তমানে প্রতিদিনই আগের দিনগুলোর থেকে বেশি করোনা রোগী শনাক্ত হচ্ছেন। একই সাথে পাল্লা দিয়ে মৃত্যুও বাড়ছে দেশটিতে। তবে এর জন্য করোনার নতুন ধরনটি দায়ী কি না, এ ব্যাপারেও নিশ্চিত হতে পারছেন না গবেষকেরা।
তবে গবেষকেরা বলছেন, করোনার নতুন ধরন সংক্রমণ বৃদ্ধির পেছনে মূল কারণ কি না তা স্পষ্টত না হলেও ভারতে যে পরিপূর্ণভাবে সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় অনেক ঘাটতি রয়েছে, তা পরিষ্কার।
ভারতের জনসংখ্যা অনেক বেশি, একারণে বড় জমায়েত হওয়া এবং মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্বের নিয়মকানুন মেনে চলাসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যবিধি মানায় ঘাটতির কারণগুলির জন্যই হয়তো করোনাভাইরাস দ্বিতীয় দফায় এতটা প্রবলভাবে আঘাত হানতে পেরেছে।
যুক্তরাজ্যের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েলকাম স্যাঙ্গার ইনস্টিটিউটের গবেষক জেফরি ব্যারেট সংবাদ প্রতিবেদককে বলেন, ভারতে ভাইরাস সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বৃদ্ধির পেছনে করোনার নতুন ধরন ‘বি-ওয়ান-সিক্সসেভেনটিন’ এর ভূমিকা থাকতে পারে। তবে এ বিষয়ে তাদের হাতে খুবই অল্প তথ্য-প্রমাণ রয়েছে।
তিনি বলছেন, ‘ভারতের ভাইরাসের বি-ওয়ান-সিক্সসেভেনটিন এর উদ্ভব হয় গত বছর। কাজেই নতুন এই ধরনের কারণে যদি ভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে থাকে, তাহলে বলতে হবে, এটি যুক্তরাজ্যের ভাইরাসের ধরনের তুলনায় কম সংক্রামক। এর কারণ বর্তমান অবস্থায় পৌঁছাতে ভাইরাসটির বেশ কয়েক মাস সময় লেগেছে।’
‘বি-ওয়ান-সিক্সসেভেনটিন’এর বিরুদ্ধে কি টিকা কার্যকর হবে?
বিজ্ঞানীরা আশাবাদী যে বর্তমান সময়ে করোনার যেসব টিকা প্রয়োগ করা হচ্ছে, তা ভারতের ভাইরাসের নতুন ওই ধরনটির বিরুদ্ধে কাজ করবে।
বিশেষ করে গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়াকে প্রতিরোধ করতে টিকাগুলো কার্যকর হবে বলেই ধারণা করছেন তাঁরা।
তবে নেচার সাময়িকীতে প্রকাশিত এক গবেষণামূলক নিবন্ধে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল মাইক্রোবায়োলজির অধ্যাপক রবী গুপ্তা এবং তাঁর সহকর্মীরা মন্তব্য করেছেন, কোভিড-১৯ এর কিছু নতুন ধরন অবধারিতভাবে টিকা প্রয়োগের মাধ্যমে মানবদেহে তৈরি হওয়া সুরক্ষা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দেবেই।
কাজেই এর বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ সুফল পেতে চাইলে ভাইরাসের পরিবর্তনের সঙ্গে সময়ে সময়ে টিকায়ও বিভিন্ন পরিবর্তন আনতে হবে।
তারপরও যে টিকাগুলো বর্তমানে বিভিন্ন দেশে প্রয়োগ করা হচ্ছে, তা করোনাভাইরাসের সংক্রমণ অধিক হারে ছড়িয়ে পড়ার গতি ধীর করবে, তাতে কোনোরূপ সন্দেহ নেই।
এ ব্যাপারে ভাইরাস বিশেষজ্ঞ জেরেমি কামিল সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রেই এই টিকাগুলো সুরক্ষা প্রদান করবে।
এমনকি এই টিকা নেওয়ার পর হাসপাতালে ভর্তি হওয়া কিংবা মৃত্যুঝুঁকিও অনেকখানিই কমে আসবে।
তাই তিনি পরামর্শ দেন, ‘আপনার হাতের কাছে করোনার যে টিকা রয়েছে, তা গ্রহণ করে ফেলুন। এনিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগা এবং শতভাগ আদর্শ টিকার অপেক্ষা করার মতো ভুল একেবারেই করবেন না।’