মদিনা শহর মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের জন্য দ্বিতীয় পবিত্রতম শহর। যে শহরটিতে নবীজির রওজা মুবারাক সহ রয়েছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
আজ আমরা জানবো পবিত্র মদীনা শহর সম্পর্কে। মদীনা শহরের ইতিহাস, এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থান তাছাড়া আরও কিছু বিষয় নিয়ে।
আল মাদিনাতুল মুনাওয়ারা যেটি পশ্চিমা সৌদিআরবের হেজাজ অঞ্চলের একটি শহর। তাছাড়া সৌদিআরব দেশটির তেরটি প্রদেশের মধ্যে অন্যতম প্রাচীন এবং ঐতিহ্যের নগরী। এই শহরটি মক্কা নগরী থেকে প্রায় ৪৪৫.৫ কিলমিটার দূরে অবস্থিত।
ইতিহাসবিদদের তথ্য মতে খ্রিষ্টপূর্ব ১৬০০ বছর পূর্বে এই শহরটির জন্ম হয়। আর সেই থেকে আজ অবধি মদিনা শহরের প্রায় ৬ টি নামের তথ্য পাওয়া যায়। হজরত মোহাম্মদ সাঃ মদিনা শহর হিজরতের পূর্বে এর নাম ছিল ইয়াসরিব।
৬২২ খ্রিষ্টাব্দে যখন প্রিয় নবী মোহাম্মদ মোস্তফা সাঃ মদিনা শহরে হিজরত করলেন, তখন এর নাম রাখা হলো আল মাদিনা আল মুনাওয়ারা, আল নববীইয়া, যার অর্থ হচ্ছে উজ্জ্বলতম শহর, বা নবীর শহর।
বলে রাখা ভাল মহানবীর এই হিজরতের দিন থেকেই কিন্তু আরবী ক্যালেন্ডারের সূচনা শুরু। যার জন্য আরবী সাল ইংরেজি সাল থেকে খানিকটা পিছিয়ে।
এই মদিনা শহর মুসলমান ধর্মালম্বীদের কাছে বেশ কিছু বিষয়ের জন্য বিখ্যাত যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয় হচ্ছে-
মসজিদে নববী –
জানাযায় মহানবী মদিনা শহরে আগমনের পরে ব্যক্তিগত ভাবে এই মসজিদের নির্মাণ কাজে অংশ নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালের মুসলিম শাষকরা মসজিদের সম্প্রসারণ ও সৌন্দর্য্য বর্ধন করিয়েছেন। বর্তমানে মসজিদে নববির অভ্যন্তরে হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহুর যে ঘর, সেই ঘরে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দাফন করানো হয়েছে।
তাছাড়া সেখানে আরও সমাধিত রয়েছে মুসলান ধর্মের প্রথম দুই খলিফা আবু বকর ও উমর আলাইহিস সালাম।এবং এর পাশে আরও একটি সমাধি খালি রাখা হয়েছে। ইসলাম ধর্মের রীতি অনুযায়ী ঈসা আলাইহিস সালাম আবার পৃথিবীতে ফিরে আসবেন। তিনি মারা যাবার পরে তাকে এখানেই দাফন করানো হবে।
এই পুরো স্থানগুলোই মসজিদে নববির সবুজ গম্বুজের নিচে অবস্থিত। ১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদের শাসনামলে এই গম্বুজ নির্মিত হয় এবং ১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দে একে সবুজ রং করা হয় বলে জানা যায়।
প্রতিবছর হাজারো ধর্ম প্রিয় মুসলমান বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসেন নবীজীর এই রওজা মুবারক জিয়ারতের উদ্দেশ্যে। বর্তমানে এই মসজিদে প্রায় ১০ লাখের মত মানুষ একসাথে নামাজ আদায় করতে সক্ষম।
জান্নাতুল বাকি –
মদিনার মসজিদে নববির দক্ষিণ-পূর্ব দিকে এই স্থানটি অবস্থিত। এখানে প্রিয় নবীর পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, হজরত ওসমান সহ সাহাবায় কেরামদের অনেক কেই দাফন করা হয়েছে বলে জানা যায়।

ইমাম মালিক (রহ.)-এর তথ্য মতে জান্নাতুল বাকিতে অন্তত প্রায় দশ হাজার সাহাবার কবর রয়েছে। তাছাড়া সেখানে অসংখ্য মুমিন বুজর্গের সমাধী অবস্থিত। বর্তমানে হজ্জ্ব ও ওমরা মৌসুমে মদিনায় যাবার পরে যদি কোন হাজি মারা যান, তাহলে তাদেরকে এই জান্নাতুল বাকিতে দাফন করানো হয়।
প্রিয় নবী সাঃ জীবিত থাকা অবস্থায় বেশ কয়েকবার এই স্থানে এসে এখান কার কবরগুলো জিয়ারত করছেন।তাই সারা বিশ্ব থেকে আগত মুসলিম উম্মাহ এই জান্নাতুল বাকিতে এসে একটি বার হলেও এখানকার কবরগুলো জিয়ারত করেন।
মসজিদে কুবা –
মসজিদে কুবা হচ্ছে ইসলামের প্রথম মসজিদ। নবী সাঃ মদিনায় আগমনের পরে সর্বপ্রথম এ মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা হয়। তাছাড়া হিজরতের পর প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এখানে ১৪দিন অবস্থান করেছিলেন বলেও জানা যায়।
পুরো পৃথিবী জুড়ে সম্মান ও মর্যাদার দিক থেকে মসজিদে হারাম, মসজিদে নববি এবং মসজিদে আকসার পরেই মসজিদে কুবার অবস্থান।

মসজিদে কুবা সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যে মসজিদ প্রথম দিন থেকেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাকওয়ার উপর (মসজিদে কুবা) – তাই বেশি হকদার যে, তুমি সেখানে নামাজ কায়েম করতে দাঁড়াবে। সেখানে এমন লোক আছে, যারা উত্তম রূপে পবিত্রতা অর্জন করতে ভালবাসে। আর আল্লাহ্ পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালবাসেন।
মসজিদ আল কিবলাতাইন –
ঐতিহাসিক দিক থেকে এই মসজিদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে নামাজ পড়ার সময় মুহাম্মদ সাঃ এর কাছে কিবলা পরিবর্তনের নির্দেশের জন্য ওহি এসেছিল। এরপর তার সাথে জামাতে নামাজে দাঁড়ানো মুসল্লিরাও জেরুজালেম থেকে মক্কার দিকে ফিরে যায় তাদের মুখ ফিরিয়ে নামাজ আদায় করেন। মূলত এই ঘটনা থেকেই মসজিদটির এরূপ নামকরণ করা হয়েছে।

জানা যায় পূর্বে এই মসজিদে দুইটি মিহরাব ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে মসজিদের পুণর্নির্মাণের সময় জেরুজালেমমুখী মিহরাব সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
হুদ পাহাড় –
মদিনা শহরের উত্তরে ১০৭৭ মিটার তথা ৩৫৩৩ ফুট উচ্চতার এই হুদ পাহাড়টি অবস্থিত। এ পাহাড়ের পাদদেশে মক্কার কুরাইশ ও মদিনার মুসলিমদের মধ্যে দ্বিতীয় যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। যেখানে মক্কার বাহিনীর আক্রমণে বিশ্ব নবি আহত হয়েছিলেন এবং তাঁর একটি দাঁত ভেঙে যায়। গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, তিনি নিহত হয়েছেন।

হৃদয় বিদারক এ যুদ্ধে প্রথমদিকে মুসলিমরা বিজয় লাভ করলেও পাল্টা আক্রমণে কুরাইশ দের তুলনায় মুসলিমদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
হযরত হামজা রাদিয়াল্লাহু আনহু সহ ৭০ জন সাহাবি শাহাদাত বরণ করেন এই যুদ্ধে। যাদেরকে পরবর্তি সময়ে হুদ পাহাড়ের নিচে দাফন করা হয়।।।
ইতিহাস থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে মদিনা শহররের কথা বলতে গেলে বোধ হয় আরও একটি বিষয় অপূর্ণ থেকে যায় আর সেটি হচ্ছে মদিনা সনদ।
৬২২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে সেপ্টেম্বর রাসুল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদিনা নগরীতে হিজরত করেছিলেন।
সেই সময়ে মদিনায় বসবাসরত বনুআওস এবং বনুখাজরাজ সম্প্রদায় দুটির মধ্যে ছিল গোষ্ঠীগত হিংসা-বিদ্বেষ। তাই কলহেলিপ্ত এ দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি স্থাপন ও মদিনায় বসবাসরত সকল গোত্রের মধ্যে সুশাসন ও শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইসলামের নবী মুহাম্মাদ (সা.) ৪৭ ধারার একটি সনদ বা সংবিধান প্রণয়ন করেন যা ইতিহাসে ‘মদিনার সনদ‘ নামে পরিচিত।
উলেখ্য, বর্তমানে গোটা মদিনা শহরের আয়তন হচ্ছে ৫৮৯ বর্গ কিলোমিটার, যেখানে প্রায় ১৫ লাখের মত মানুষ বাস করছেন।
এ সম্পর্কিত আমাদের ভিডিও –