খেজুর গাছ সারা বিশ্বব্যাপী খুবই পরিচিত একটি গাছ। খেজুর ফলও সবার কাছে অতিমাত্রায় গ্রহণযোগ্য। এর পুষ্টিগুণ অবর্ণনীয়। তাছাড়া খেজুর রস বা গুড়েরও রয়েছে ব্যাপক চাহিদা।
মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের জন্য খেজুর খাওয়া সুন্নাত। তাই রমজান মাসে বাজারে খেজুরের চাহিদা যেন দ্বিগুণ হয়ে যায়।
নামকরণ:
খেজুর গাছের ইংরেজি নাম Date Plam. আর উদ্ভিদের আঞ্চলিক নামগুলো হচ্ছে- খাজুর, খেজুর ও খাইজুর।
বৈজ্ঞানিক নাম:
উদ্ভিদটির বৈজ্ঞানিক নাম Phoenix dactylifera.
নামের দ্বিতীয় অংশ dactylifera এর অর্থ হলো “খেজুর বহনকারী”।
Dactylifera এর প্রথম অংশ প্রাচীন গ্রীক ভাষা dáktulos থেকে এসেছে। যার অর্থ হচ্ছে “খেজুর”। এর আরেকটি অর্থ “আঙুল”।
আর পরবর্তী অংশ ferō শব্দটি এসেছে ল্যাটিন ভাষা থেকে। যার অর্থ “আমি বহন করি”।
পরিবার:
খেজুর একবীজপত্রী আবৃতবীজী বৃক্ষ এবং সপুষ্পক একটি উদ্ভিদ।
উদ্ভিদটি অ্যারাসি (Arecaceae) পরিবার বা তালগোত্রের একটি সদস্য যার গণ phoenix.
প্রজাতি:
Wild Date Palm, Silver Date Palm, Indian Wild Palm ইত্যাদি বিভিন্ন প্রজাতির খেজুর গাছ ও ফল রয়েছে।
প্রাপ্তিস্থান:
খেজুর গাছ সাধারণত মরু অঞ্চলে বেশি জন্মায়।
একারণে সৌদি আরব, দুবাই, তুরষ্ক, ইরাক, ইরান, মিশর, ওমান, সুদান ইত্যাদি দেশগুলোর মত উষ্ণমন্ডলীয় দেশে বেশিখেজুর পাওয়া যায়।
সৌদি আরবের খেজুর সারা বিশ্বব্যাপী অত্যন্ত সমাদৃত।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় খেজুর বাগান সৌদি আরবে অবস্থিত। যার নাম ‘রাজেহী বাগান’।
আকার-আকৃতি:
খেজুর গাছ মাঝারি আকৃতির গাছ। সেই হিসেবে গাছের উচ্চতা গড়ে প্রায় ১৫-২৫ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে।
খেজুর গাছের লম্বা পাতা রয়েছে যেগুলো পাখির পালকের ন্যায় আকৃতিবিশিষ্ট। দৈর্ঘ্যে পাতাগুলো ৩-৫ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। পাতায় পত্রদণ্ড দৃশ্যমান।
গঠন ও বৈশিষ্ট্য:
খেজুর গাছ একটি ব্যতিক্রমধর্মী একটি উদ্ভিদ। এটি একক কান্ডবিশিষ্ট উদ্ভিদ। অর্থ্যাৎ এর কোন শাখা-প্রশাখা নেই। শুধু মাত্র একটি কান্ড রয়েছে। কন্ডটি সরল এবং গোলাকারের হয়। আর অনেক শক্ত হয়ে থাকে।
কান্ডের একদম উচুতে অর্থ্যাৎ শীর্ষভাগে ফুল, ফল ও পাতা গজায়। এই শীর্ষভাগ কে মাথি বলা হয়।
ফুল:
বসন্তে খেজুর গাছে ফুল ফোটে। এই ফুল খেজুর ফুল নামে পরিচিত। এই ফুলের বিন্যাস অত্যন্ত সুন্দর যা মানুষকে আকৃষ্ট করে। মাথির শক্ত মোচা থেকে বের হয় এই ফুল।
শীতকালে খেজুরমাথিতে মুচি অর্থ্যাৎ পুষ্পমঞ্জরি আসে। খেজুর গাছের পুষ্পমঞ্জরি দেখেই পুরুষ ও স্ত্রী গাছ চিহ্নিত করা যায়।
শুধুমাত্র স্ত্রী খেজুর গাছেই ফুল ও ফল ধরে। পুরুষ খেজুর গাছে ধরে না।
পুরুষ গাছের পুষ্পমঞ্জরি খাটো হয়। কিন্তু স্ত্রী পুষ্পমঞ্জরি লম্বা এবং ফুলের বর্ণ সাদা।
খেজুর ফল:
খেজুর অত্যন্ত সুপরিচিত একটি ফল। খেতে খুবই মিষ্টি।
খেজুর ফল ডিম্বাকৃতির হয়ে থাকে। এর দৈর্ঘ্য ৩-৭ সে.মি. এবং ব্যাসার্ধে ২-৩ সে.মি. পর্যন্ত হয়।
বিভিন্ন প্রজাতির উপর নির্ভর করে কাঁচা ফল প্রথমে সবুজ পরে ক্রমাণ্বয়ে উজ্জ্বল লাল কিংবা উজ্জ্বল হলুদ বর্ণের হয়ে থাকে। এবং পাকলে খয়েরী, লালচে খয়েরী কিংবা কালচে খয়েরী রঙ ধারণ করে।
একবীজপত্রী উদ্ভিদ বলে এর বীজ হয় একটি। বীজটি লম্বায় ২-২.৫ সে.মি এবং ৬-৮ মি.মি পুরুত্বের হয়ে থাকে।
প্রধান ৩টি চাষের উপযোগী খেজুরের হচ্ছে-
১. নরম: বর্হি, হলয়ি, খাদরয়ি, মেদজুল
২. অর্ধ-শুষ্ক: দেরি, দেগলেত নূর, জাহদি এবং
৩. শুকনো: থুরি।
খেজুর রস:
খেজুর গাছ থেকে রস পওয়া যায়। যা অত্যন্ত সুমিষ্ট।
শীত ঋতুতে খেজুর গাছ থেকে রস আহরণ করা হয়।
উদ্ভিদ জগতে যখন নেমে আসে এক প্রাণহীন রসহীন বিবর্ণতার ছায়া তখন খেজুর গাছ হাজির হয় মিষ্টি রসের বার্তা নিয়ে।
বাংলাদেশের গ্রাম বাংলায় এর চাহিদা ব্যাপক। শহরেও বেশ কদর রয়েছে।
শীত কালে এই রস আহরণ করা হয় যার জন্য খেজুর গাছ বছরে ন্যূনতম একবার কাটতে হয়। তবে এক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে গাছ অবশ্যই গোলগাল রাখতে হয়।
আর সঠিক নিয়ম মেনে এই গাছ কাটতে হয়। তানাহলে গাছ মরে যায়।
খেজুরের রস থেকে পরবর্তীতে গুড় তৈরি করা হয়। বাংলাদেশে খেজুর গুড়েরও ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
উপকারিতা:
খেজুর গাছের কান্ড থেকে শুরু করে এর ফল, রস খুবই উপকারী।
অনেক দেশে খেজুর পাতা সবজি হিসেবেও খাওয়া হয়। এমনকি মঞ্জুরি বা ফুল খাওয়া হয়।
খাওয়া ছাড়াও এর আরও বিভিন্ন গুণাগুণ রয়েছে।
খেজুরের পুষ্টিগুণ:
খেজুর যে শুধু সুস্বাদু একটি খাবার তাই নয়। এর প্রচুর পুষ্টি গুণাগুণও রয়েছে। যেমন-
৪টি বা ৩০ গ্রাম পরিমাণ খেজুরে রয়েছে ৯০ ক্যালোরি, ১ গ্রাম প্রোটিন, ১৩ মি.লি. গ্রাম ক্যালসিয়াম এবং ২.৮ গ্রাম ফাইবার।
প্রতি ১০০ গ্রাম পরিষ্কার এবং তাজা খেজুরে রয়েছে ভিটামিন সি যা থেকে ২৩০ ক্যালরি বা ৯৬০ জুল শক্তি উৎপাদন করে।
খেজুর ফল ফাইবার ও ভিটামিন সমৃদ্ধ।
খেজুর অত্যন্ত সুমিষ্ট, সুস্বাদু এবং একই সাথে বহু পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ একটি ফল
খাদ্যোপযোগী প্রতি ১০০ গ্রাম শুকনা খেজুর ফলের মধ্যে
১৮.০ গ্রাম জলীয় অংশ,
১.৭ গ্রাম খনিজ পদার্থ,
৩.৯ গ্রাম আঁশ,
৩২৪ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি,
২.২ গ্রাম আমিষ,
০.৬ গ্রাম চর্বি,
৭৭.৫ গ্রাম শর্করা,
৬৩ মি. গ্রাম ক্যালসিয়াম,
৭.৩ মিলিগ্রাম লৌহ,
০.১০ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি-১,
০.০৪ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি-২ এবং
অল্প পরিমাণ ভিটামিন সি বিদ্যমান থাকে।
আবার প্রচলিত খাদ্য হিসেবে খেজুর রস বেশ সস্তা কিন্তু খুবই পুষ্টিকর এবং উপাদেয়।
খেজুর রসে প্রচুর পরিমাণে অ্যাসপারটিক এসিড, নাইট্রিক এসিড এবং থায়ামিন বিদ্যমান।
বিশ্বের সর্বত্রই খেজুর উৎপাদন হলেও মূলত মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার দেশগুলোতেই এর উৎপাদন সর্বাচ্চ।
ভেষজগুণ:
খেজুরের বিভিন্ন ঔষধি গুণাগুণ রয়েছে।
সর্দি-কাশি নিরাময়ে খেজুর ফল উপাদেয়।
খেজুর পাতা রোগ হৃদরোগ, জ্বর ও উদরের সমস্যা সমাধানে বেশ কার্যকর।
খেজুর গাছের শিকড় দাঁত এবং মাড়ির প্রদাহ নিবারণে ব্যবহৃত হয়।
খেজুরের রস মুখে রুচি আনে।
খেজুর রসের বা গুড়ের তৈরি খাবার:
বাংলাদেশ ভারতের মত বিভিন্ন দেশে খেজুরের রস কিংবা গুড়ের সমাদর খুবই বেশি।
খেজুরের রস অনেকে শুধুও খেয়ে থাকে। আবার যেকোন পিঠা-পুলি, পায়েশ তৈরিতে এটি ব্যবহৃত হয়। এগুলো আমাদের দেশের ঐতিহ্য।
খেজুরের রস থেকে পরবর্তীতে খেজুর গুড় তৈরি করা হয়। রস চুলায় জ্বাল দিয়ে শুকিয়ে গুড় প্রস্তুত করতে হয়।
এই গুড় পিঠা, পায়েশ, আচার ইত্যাদি বিভিন্ন রকম মিষ্টি জাতীয় খাদ্য প্রস্তুতে ব্যবহৃত হয়।
বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, ঘানা, উত্তর আফ্রিকা, আইভরীকোস্ট দেশগুলোয় খেজুর গাছের অংশ কেটে সুমিষ্ট রস বের করা হয়।
গাছের কান্ড কেটে খেজুর রস সংগ্রহ করার পদ্ধতি
খেজুর পাতার ব্যবহার:
খেজুর গাছের পাতা ব্যবহার করে বিভিন্ন কারুশিল্প সৃষ্টি করা যায়। খেজুর পাতার পাখার বেশ সুখ্যাতি রয়েছে। গ্রামে-গঞ্জে বলা হয়ে থাকে এই পাখার বাতাস নাকি প্রচুর ঠান্ডা।
এছাড়া খেজুর পাতার তৈরি শীতল পাটিরও বেশ কদর রয়েছে।
এগুলো ছাড়াও খেজুর পাতা দিয়ে ঝাড়–ঝুড়ি, থলে, ছিকা সহ নানা রকম খেলনা এখনও অতি সমাদৃত।
খেজুর গাছ জ্বালানি কাঠ হিসেবে ব্যাপক মাত্রায় ব্যবহৃত হয়। গাছটি আঁশযুক্ত হওয়ায় এর দাহ্য ক্ষমতা খুব বেশি। তাই জ্বালানী হিসেবে এটি খুব ভাল।
অর্থনৈতিক ভাবে লাভ:
খেজুর গাছে ফল ফলাতে প্রায় ৪-৫ বছর লেগে যায়। তবে দীর্ঘ প্রকৃয়া হলেও একটু ধৈর্য্য ধরে সঠিক ভাবে পরিচর্যা করতে পারলে একটি খেজুর গাছ থেকেই ৪-৫ লক্ষ টাকা আয় করা সম্ভব।
ফল ছাড়াও খেজুর রস, গুড়, পাতা দিয়ে তৈরি বিভিন্ন শিল্পকর্মগুলো যেমন- পাখা, পাটি ইত্যাদি তৈরি করে বিক্রি এমনকি খেজুর কাঠ জ্বালানি হিসেবে বিক্রি করেও প্রচুর অর্থ আয় করা সম্ভব।
আমাদের দেশে খেজুর ফলের চাহিদা প্রায় ৩০ হাজার টন। যার পুরোটাই আমদানি নির্ভর। অন্যদিকে পার্শ্ববর্তী দেশ পাকিস্তানে দিকে আমরা যদি তাকাই দেখা যায় দেশটি খেজুর রপ্তানিতে বিশ্বে ৪র্থ। নিজেদের দেশের চাহিদা মিটিয়ে দেশটি খেজুর রাপ্তানিও করছে।
অথচ বাংলাদেশের মাটি ও পাকিস্তানের মাটিতে তেমন কোন তফাৎ নেই। কিন্তু বাংলাদেশে এর উৎপাদন নেই বললেই চলে।
সুমিষ্ট ফল হিসেবে বিশেষ ভাবে পরিচিত সৌদি খেজুর গাছ চাষ পদ্ধতি অত্যন্ত কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ ব্যপার বিধায় বাংলাদেশের কৃষকরা খেজুর চাষ করতে চায় না।
আমরা বিদেশ থেকে সেই খেজুর আমদানি করি যা অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ।
চাইলে আমরা খেজুর উৎপাদন করে নিজেদের দেশে খেজুরের চাহিদা পূরণ করে বরং বিদেশে রপ্তানিও করতে পারব। এবং প্রচুর বৈদিশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারব।
তাই আমাদের উচিত দেশীয় কৃষিকদের খেজুর চাষে উদ্বুদ্ধ করা। এবং চাষে তাদের যথাযোগ্য সাহায্য করা।