টাইটানিক জাহাজ থেকে বেঁচে যাওয়া ৬ জন চীনা যাত্রীর শেষ পরিণতি

টাইটানিক জাহাজ থেকে বেঁচে যাওয়া ৬ জন চীনা যাত্রীর শেষ পরিণতি
টাইটানিক জাহাজ থেকে বেঁচে যাওয়া ৬ জন চীনা যাত্রীর শেষ পরিণতি

টাইটানিক জাহাজ নিয়ে মাতামাতি সেই শুর থেকেই। মানুষের মনে এই জাহাজের মত এত আগ্রহ মনে হয় আর কোন জাহাজ সৃষ্টি করেতে পারেনি। তাই হয়তো ডুবে যাওয়ার এত বছর পরেও সেই আগ্রহে কোন কমতি নেই। জানা যায়, জাহাজ ডুবি থেকে বেঁচে যায় ৬ জন চীনা যাত্রী। টাইটানিক জাহাজ থেকে বেঁচে যাওয়া সেই যাত্রীদের শেষ পরিণতি কি হয়েছিল?  কেনইবা আমেরিকান নাগরিকরা তাদের দোষারোপ করলো?

১৯১২ সালের ১৫ই এপ্রিল রাতে আটলান্টিক মহাসাগরে ডুবে যায় ইতিহাস বিখ্যাত টাইটানিক জাহাজ। তখন জাহাজ সহ কয়েক হাজার যাত্রী তলিয়ে যায় মহাসাগরের হিমশীতল পানির নিচে।

ডুবন্ত জাহাজটির লাইফবোটগুলোর মধ্যে একটি পরবর্তীতে ঘটনাস্থলে ফিরে এসে খোঁজার চেষ্টা করেছিল তখনও পানিতে কেউ জীবিত ছিল কিনা।

রাতের অন্ধকারে ঐ নৌকার উদ্ধারকারীরা সেখানে এক চীনা যুবককে খুঁজে পেয়েছিল। যে পরিস্থিতির শিকার এবং তখনও ডুবে যাওয়া টাইটানিক জাহাজের একটি কাঠের দরজা ধরে ভাসছিল এবং প্রাণে বেঁচেছিল।

টাইটানিক জাহাজ থেকে বেঁচে যাওয়া চীনা ঐ যুবকটির নাম ছিল ফ্যাং ল্যাং।

১৯৯৭ সালের ব্লকবাস্টার চলচ্চিত্র টাইটানিকে বরফ ঠান্ডা পানিতে ভাসমান আধমরা যে যুবকের উদ্ধারের দৃশ্যটি তুলে ধরা হয়েছিল সে আর কেও নয়, ঐ যুবকটিই।

কিন্তু শুধু ফ্যান ল্যাং নয়।  ডুবার পর টাইটানিক জাহাজ থেকে বেঁচে যাওয়া  যাত্রীদের মধ্যে সে ছাড়াও আরো ৫ জন চীনা নাগরিক ছিলেন।

কিন্তু অলৌকিকভাবে সেই রাতে জাহাজ থেকে প্রাণে বেঁচে গেলেওে দুর্ভাগ্য, দু:সময় পিছু ছাড়েনি ঐ ৬ জন চীনার।

টাইটানিক জাহাজ থেকে বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের নিউ ইয়র্কের এলিস আইল্যান্ডের অভিবাসন অফিসে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই আমেরিকা থেকে ঐ ৬ জন চীনাকে বহিষ্কার করা হয়।

এর কারণ সে সময় আমেরিকায় একটি আইন ছিল যে, কোনো চীনা নাগরিককে আমেরিকায় ঢুকা বা বসবাস করার অধিকার দেওয়া হবে না। আর মূলত এ কারণেই টাইটানিক ডুবির ইতিহাস থেকে এই ৬ জন চীনা এতদিন উধাও ছিলেন।

তবে সেই ভয়ংকর ট্রাজেডির ১০৯ বছর পর এসে সম্প্রতি টাইটানিক জাহাজ থেকে বেঁচে যাওয়া ঐ ৬ জন চীনা ব্যক্তিদের নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করা হয়েছে। যেটি চীনে প্রদর্শিতও হয়েছে।

তথ্যচিত্রটিতে টাইটানিক জাহাজ ডোবার এবং ঐ ৬ জনের রক্ষা পাওয়ার পর্বই শুধু নয়, পরবর্তীতে তাদের ভাগ্যে কী হয়েছিল তাও চিত্রায়ণ করা হয়েছে।

একইসঙ্গে তৎকালীন আমেরিকায় অভিবাসী বিদ্বেষ, বর্ণ বিদ্বেষের ঘৃণ্য চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে।

তথ্যচিত্রটির নাম দ্য সিক্স

টাইটানিক জাহাজ থেকে বেঁচে যাওয়া ঐ চীনা যাত্রীর পরিচয়-

টাইটানিক জাহাজ থেকে বেঁচে যাওয়া ৬ জন যাত্রীর নাম ছিল – লি বিং, ফ্যাং ল্যাং, চ্যাং চিপ, আ লাম, চুং ফু এবং লিং হি।

ধারণা করা হয়, পেশায় তারা প্রত্যেকেই নাবিক ছিলেন। এবং কাজের উদ্দেশ্যে তারা টাইটানিকে চড়ে বসেন, তাদের চূড়ান্ত গন্তব্য ছিল ক্যারিবিয় দ্বীপপুঞ্জের কোথাও।

‘দ্য সিক্স’ নামে তথ্যচিত্রটি নির্মান করেন ব্রিটিশ চলচ্চিত্র নির্মাতা আর্থার জোনস্। তিনি বলেন, দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফিরা ঐ ছ’জনের দলটি সম্পর্কে খুবই কম কথা তখন হয়েছে। তারা একরকম অজানা রহস্যই রয়ে গেছেন।

জাহাজের যাত্রীদের নামের তালিকায় তাদের নাম ছিল। টাইটানিক জাহাজ ডোবা সংক্রান্ত সেসময় মিডিয়াতে দিনের পর দিন প্রচুর খবর হয়েছিল।

কিন্তু সেগুলো থেকে ঢালাও করে কিছু জানা যায়নি, তার কয়েকটিতে তাদের কথা খুব সংক্ষিপ্ত আকারে ছিল।

বেঁচে যাওয়া ৬ জন চীনা যাত্রীদের মধ্যে ৪ জন
বেঁচে যাওয়া ৬ জন চীনা যাত্রীদের মধ্যে ৪ জন

টাইটানিক ডুবি থেকে সেসময় যারা রক্ষা পেয়েছিলেন, তাদের নিয়ে মিডিয়ায় তখন ব্যাপক সরগোল হয়েছিল।

কিন্তু বিভিন্ন ইতিহাসবিদ এবং গবেষকদের মতে, শুধুমাত্র বেঁচে যাওয়া ৬ জন চীনার কপালে প্রবল দুর্নাম, নিন্দা আর কটূক্তি ছাড়া কিছুই জুটেনি। আর এর পেছনে মূল কারণটি ছিল তৎকালীন পশ্চিমা সমাজে চীন এবং চীনা বিদ্বেষ।

টাইটানিক জাহাজ ডোবার কিছু দিন পর ব্রুকলিন ডেইলি ঈগল নামক একটি পত্রিকার এক রিপোর্টে ঐ বেঁচে যাওয়া ছয় চীনাকে শুধুমাত্র ”জীব” হিসাবে বর্ণনা করা হয়। এবং সেই রিপোর্টে আরও বলা হয় ”বিপদের গন্ধ পাওয়ার সাথে সাথেই” তারা লাফ দিয়ে লাইফ বোটে চড়ে বসে পালিয়েছিল এবং নিজেদের পরিচয় গোপন রাখার উদ্দেশ্যে সিটের নিচে মুখ ঢেকে রেখেছিল।

কিন্তু নতুন এই তথ্যচিত্রটি নির্মাণের কারনে করা গবেষণায় উঠে এসেছে যে, এ ধরনের কথাগুলি ছিল সম্পূর্ণ মনগড়া।

টাইটানিক জাহাজের লাইফবোটের আদলে হুবহু একটা নৌকা তৈরি করে দ্য সিক্সের তথ্যচিত্রের প্রযোজনা দলটি দেখেছেন, ঐরকম নৌকার সিটের নিচে লুকিয়ে থাকা অসম্ভব ছিল।

তথ্যচিত্রের পরিচালক মি. জোনস্‌ জানান, ”আজও আমরা একই প্রবণতা লক্ষ্য করছি। আমেরিকার মিডিয়া বিনাদোষে অভিবাসীদের অপরাধী হিসাবে টার্গেট করে চলেছে।”

সেসময়কার পশ্চিমা অনেক মিডিয়ার রিপোর্টে আরও একটি মনগড়া তথ্য বলা হয় যে, লাইফবোটে জায়গা পেতে ঐ চীনা নাগরিকরা নাকি মেয়েদের পোশাক পরে ছিল ।

টাইটানিক ডুবি নিয়ে গবেষণা করেছেন ইতিহাসবিদ টিম মালটিন। তিনি বলেন, টাইটানিক জাহাজ থেকে বেঁচে যাওয়া ঐ ছয় চীনা নাবিক লাইফ বোটে লুকিয়ে ছিলেন, অথবা নৌকায় জায়গা পেতে তারা নারীর ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলেন এমন কোন প্রমাণই এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তিনি আরও বলেন, ”মিডিয়া এবং অনেক মানুষের সেসময়কার এসব কথা ছিল স্রেফ বানোয়াট।”

টাইটানিক থেকে যেসকল পুরুষ যাত্রীরা প্রাণে বেঁচে  গিয়েছিলেন তাদেরকে সেসময় এমনিতেও কিছুটা সন্দেহের চোখে দেখা হতো। বলা হতো তারা হয়ত সুযোগ সন্ধানী এবং  স্বার্থপর ছিল। যেকারণে নারী এবং শিশুদের কথা না ভেবেই তারা নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত ছিলেন।

ইতিহাসবিদ মি. মালটিনের মতে, সেই চীনা ৬ যাত্রী বরং অন্য যাত্রীদের সহায়তা করবার চেষ্টা করছিলেন।

যেমন- ফ্যাং ল্যাং নামে যে চীনা যুবক জাহাজের দরজা ধরে ভাসছিলেন বলে দেখা যায়, উদ্ধার হওয়ার পর তিনি ঐ লাইফ বোটটি চালনা করেছিলেন। আর নৌকায় থাকা সবাইকে নিরাপদে রাখার জন্য সাহায্য করেছিলেন।

টাইটানিক দুর্ঘটনার পর তাদের ভাগ্যে কী জুটেছিল?

টাইটানিক জাহাজ থেকে বেঁচে যাওয়া ঐ ৬ চীনাদের যুক্তরাষ্ট্র সরকার সেখান থেকে বহিষ্কার করে কিউবাতে পাঠিয়ে দেয়।

তবে তার কিছুদিন পর অবশ্য ৬ জন ব্রিটেনে চলে আসেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হওয়ায় ব্রিটেনের অধিকাংশ নাবিক তখন সেনাবাহিনীতে যোগদান করে, যারফলে নাবিকের সঙ্কট দেখা দেয়। এ কারণে ব্রিটেনে নাবিকের চাকরি পেয়ে যান তারা।

টাইটানিক দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফিরলেও এরপর থেকে অসুস্থতা চ্যাং চিপের পিছু ছাড়েনি। ২০১৪ সালে তিনি নিউমোনিয়ায় মারা যান। লন্ডনে তাকে সমাধিস্থ করা হয়। তবে তার সমাধির কোনো চিহ্ন রাখা হয়নি।

বাকি ৫ জন চীনা ১৯২০ সাল পর্যন্ত ব্রিটেনে কর্মরত ছিলেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ ব্রিটেনে বিয়ে করে সংসার করেন এবং তাদের সন্তান-সন্ততিও হয়েছিল।

কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী অর্থনৈতিক সঙ্কটে ব্রিটেনে অভিবাসী বিদ্বেষ আরও বেশি বেড়ে গিয়েছিল। এতটাই তুঙ্গে উঠেছিল যে তারা কাউকে না জানিয়ে নিজেদের স্ত্রী-সন্তান ফেলে অনত্র চলে গিয়েছিলেন।

মি জোনস্ বলেন, ”আসলে তাদের দোষ দেয়া যায় না। রাজনৈতিক ভিন্ন পরিস্থিতির কারণে ঐ পরিবারগুলোর পরিণতি খুবই করুণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তখনকার পরিস্থিতির ওপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না।”

আ লামকে ব্রিটেন থেকে বহিষ্কার করে হংকংয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

লিং হি ভারতের কলকাতার উদ্দেশ্যে একটি জাহাজে চড়ে বসেন এবং

লি বিং চলে যান কানাডার অভিবাসী হয়ে।

আর ফ্যাং ল্যাং বেশ কয়েক বছর ধরে ব্রিটিশ জাহাজে কাজ করার পরে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। কিন্তু সেই দেশ থেকেও একসময় তাকে বিতাড়িত করা হয়েছিল।

আরো পড়ুন:
বায়তুল মোকাররম মসজিদের ইতিহাস – যেভাবে এটি জাতীয় মসজিদ হয়ে উঠলো
ইতিহাসের অভিশপ্ত ভৌতিক মহিলা – ব্লাডি মেরি
ঘড়ি আবিষ্কার এর ইতিহাস

টাইটানিক জাহাজ ডোবার বহুদিন পর যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যের মিলউকু নগরে ফ্যাং ল্যাংয়ের ছেলে টম ফংয়ের জন্মগ্রহণ করে। তবে তার পারিবারিক নামের সাথে এখন ইংরেজি শব্দ যুক্ত করা হয়েছে।

কয়েক দশক ধরে টম ফং তার বাবার অতীত অভিজ্ঞতার বিষয়ে কিছুই জানতেন না। সংবাদ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ”বাবা (ফ্যাং ল্যাং) কখনই সেসব ব্যাপার নিয়ে আমার সাথে কথা বলেননি। এমনকি আমার মার কাছেও কিছু বলেননি।”

অন্য এক যাত্রী মি ফ্যাং ১৯৮৫ সালে ৯০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর প্রায় ২০ বছর পরে তার ছেলে ফং সর্বপ্রথম পরিবারের কোন একজন সদস্যের মুখ থেকে জানতে পারেন যে তার বাবা টাইটানিক জাহাজ থেকে বেঁচে যাওয়া  এক যাত্রী ছিলেন।

কিন্তু সেই রাতে কিংবা তার পরবর্তীতে তার বাবা কী কী অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিল তা শোনেননি টম ফং।

subscribe to our youtube channel 2

শেয়ার করুন -

উত্তর দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার নাম লিখুন