এ পি জে আব্দুল কালাম এর আত্মজীবনী

এ পি জে আব্দুল কালাম এর আত্মজীবনী
এ পি জে আব্দুল কালাম এর আত্মজীবনী

ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের রামেশ্বরমে দরিদ্র দম্পতি জয়নুল আবেদিন ও অশিয়াম্মা কখনও স্বপ্নেও ভাবেননি তাদের ছেলে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে ভারতকে নেতৃত্ব দিবে। এমনকি দেশের রাষ্ট্রপতির আসন অলংকৃত করবে।

কিন্তু সেই দরিদ্র বাবা-মার সন্তান আবদুল কালামও দেখিয়ে দিয়েছিলেন তিনি ভারতের শীর্ষ বিজ্ঞানী প্রশাসক।

বিজ্ঞানী এবং রাষ্ট্রপতি হিসেবে ভারতে তাঁর অবদান অসমান্য। তাঁর হাত ধরেই সাফল্যের শিখরে পৌছেছে ভারতের মহাকাশ গবেষণা।

Indian space research organization এ এ পি জে আব্দুল কালাম এর অবদান অনস্বীকার্য। ভারতের রকেট ও মিশাইল প্রযুক্তিতে তাঁর অবদান সর্বাগ্রে। অগ্নি, পৃথ্বী এর মত পারমাণবিক মিশাইল প্রযুক্তি পূর্ণতা পেয়েছে তাঁর হাত ধরেই।

এজন্য এ পি জে আব্দুল কালামকে Missile Man of India বলে আখ্যায়িত করা হয়।

আজ আমরা জানবো এই মহান ব্যক্তির সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য।

জন্মগ্রহণ:

১৯৩১ সালের ১৫ অক্টোবর তামিলনাড়ুর একটি ছোট শহরে জন্ম এ পি জে আবদুল কালামের।

শহর ছোট হলেও বড় স্বপ্ন নিয়ে পৃথিবীর পথে যাত্রা ‍শুরু করেছিলেন তিনি।

পরিচয়:

এ পি জে আবদুল কালমের সম্পূর্ণ নাম আবুল পাকির জয়নুল আবেদিন আবদুল কালাম।

এ পি জে আবদুল কালামের পিতার নাম আবুল ফকির জয়নুল আবেদিন। পেশায় তিনি ছিলেন রামেশ্বরমের ডিঙ্গি নৌকা নির্মাতা।

এবং তাঁর মাতা অশিয়াম্মা ছিলেন গৃহবধু।

ছেলেবেলা:

তামিল মুসলিমি পরিবারে ছোটবেলা থেকেই চরম দারিদ্রের মধ্যে বড় হয়ে ওঠেন কালাম।

পরিবারের দারিদ্রতা তাঁর জীবনে বার বার বাধা হয়ে দাড়িয়েছিল। পড়াশোনার ব্যয় সংকুলান করতে কালাম অনেক ছোটখাট কাজ করেছেন জীবনে।

পরিবারকে সহায়তা করতে খবরের কাগজও বিক্রি করেছিলেন একসময়।

ছোটবেলা থেকেই অংক কষতে খুব ভালবাসতেন কালাম। ঘন্টার পর ঘন্টা বসে তিনি একের পর এক অংক কষে যেতেন। এই কাজে তাঁর কোন ক্লান্তি ছিল না।

তিনি একজন মধ্যম মানের ছাত্র ছিলেন। তবে তাঁর ধৈর্য্য, অধ্যবসায় ও কোন জিনিসকে জানার প্রবল আগ্রহ পরবর্তীতে তাঁকে পাল্টে দেয়।

শিক্ষাজীবন:

রামনাথপুরম স্কোয়ার্টজ ম্যাট্রিকুলেশন স্কুল থেকে শিক্ষা সম্পূর্ণ করেন এ পি জে আব্দুল কালাম।

এরপর কালাম  মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে তিরুচিরাপল্লির সেন্ট জোসেফ’স কলেজে ভর্তি হন। এবং ১৯৫৪ সালে তিনি পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক লাভ করেন।

১৯৫৫ সালে তিনি মাদ্রাজ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে বিমানপ্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষালাভ করেন। এই প্রতিষ্ঠানে পড়ার সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ডিন তাঁর পঠন-পাঠনের অগ্রগতি না দেখে অসন্তুষ্ট হন। তাই ডিন তাঁকে ভয় দেখান তিন দিনের মধ্যে প্রকল্প শেষ না করলে তিনি কালামের বৃত্তি বন্ধ করে দিবেন।

এরপর কালাম নির্দিষ্ট দিনের মধ্যেই তাঁর প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করেন।

কর্মজীবন:

৮ টি পদের জন্য পরীক্ষায় ৯ম স্থান লাভ করায় ভারতীয় বিমান বাহিনীতে যুদ্ধ বিমানের চালক হিসেবে তাঁর স্বপ্ন খুব অল্পের জন্য হাতছাড়া হয়।

১৯৬০ সালে বিজ্ঞানী হিসেবে এ পি জে আবদুল কালাম ডিআরডিও অর্থ্যাৎ Defiance Research And Development Organization এর সঙ্গে যুক্ত হন।

ক্যারিয়ারের একেবারে প্রথম দিকেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য একটি ছোট হেলিকপ্টার ডিজাইন করেন এ পি জে আব্দুল কালাম।

১৯৬৫ সালে তিনি ডিআরডিও তে একটি রকেট প্রজেক্টে কাজ শুরু করেন।

১৯৬৯ সালে ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থায় স্যাটেলাইট প্রজেক্ট ডিরেক্টর পদে অসীন হন।

তাঁর নেতৃত্বেই ভারত ১৯৮০ সালে প্রথম স্যাটেলাইট  ‘রোহিনী’ মহাকাশে ক্ষেপণ করেন।

ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সম্পর্কে তাঁর গবেষণার কারণে তাঁকে ভারতের মিশাইল ম্যান হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে।

তিনি ১৯৯৮ সালে সংগঠিত ভারতের পোখরান-২ ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার ব্যাপারেও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।

রাজনৈতিক জীবন:

ভারত রত্ন এবং মিশাইল ম্যান খ্যাত এ পি জে আবদুল কালাম ছিলেন ভারতের ১১তম রাষ্ট্রপতি।

তৎকালীন বিজেপি নেত্রীত্বাধীন এন ডি এ সরকার কালামের নাম প্রস্তাব করলে কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি সহ অনেক দলই একযোগে তা মেনে নেয়।

২০০২ সালে ভারতীয় জনতা পার্টি ও ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সমর্থনে এ পি জে আবদুল কালাম দেশটির একাদশ তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হন।

এবং পরবর্তী পাঁচ বছর ২০০২ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে বহাল থাকেন।

পুরষ্কার ও সম্মাণনা:

কাজের স্বীকৃতিসরূপ ভারত সরকার এ পি জে আবদুল কালামের

-১৯৮১ সালে পদ্ম ভুষণ

-১৯৯০ সালে পদ্ম বিভূষণ ও

-১৯৯৭ সালে ভারত রত্ন উপাধি দেন।

এই ৩ জাতীয় উপাধি ছাড়াও জাতীয় স্বার্থে ও মানব কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি আরও অনেক দেশীয় ও অনেক আন্তর্জাতিক পদক, সম্মানে ভূষিত হন।

রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনকালে এ পি জে আবদুল কালাম যেমন প্রশংসিত হয়েছেন তেমনি সমালোচিতও হয়েছেন বহুবার। বিশেষ করে ২০ জনের প্রাণভিক্ষার আবেদনের ব্যাপারে তাঁর নির্বিকার ভূমিকা অনেকে ভালভাবে নেন নি।

এ পি জে আবদুল কালামের সৃষ্টি:

রাষ্ট্রপতি ও বিজ্ঞানী কালামের বাইরে তিনি একজন অত্যন্ত সংবেদনশীল লেখক কালামও ছিলেন। তিনি বেশকিছু প্রণোদনামূলক ও প্রভাবশালী বই লিখেছেন।

এদের মধ্যে India 2020 সর্বাধিক পঠিত ও প্রশংসিত। এই বইয়ে ২০২০ সালের মধ্যে সুপার পাওয়ার হতে হলে ভারতকে কি ধরনের পরিকল্পনা ও পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে যেতে হবে সে ব্যাপারে একটি রূপরেখা দিয়ে গেছেন তিনি।

* তাঁর অন্যান্য বহুল পঠিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে—

-Ignited Minds

-Mission India

-Inspiring Thoughts

-The Luminous Sparks ও

-Wings of Fire

২০১১ সালে তিনি তরুণদের নিয়ে What Can I Give Movement শীর্ষক দূর্নীতিবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন।

কালামের লেখা ২৯ টি বইয়ের মধ্যে Wings of Fire-এ ১৯৯২ সাল পর্যন্ত তাঁর জীবনের বিভিন্ন ঘটনাক্রম উঠে এসেছে। বইটি ১০ লাখেরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে।

ওই সাফল্যের অনুপ্রেরণায় তিনি লেখেন Turning Points নামে আরও একটি বই। যাতে নিজের সফলতার পথে ৭টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তিনি তুলে আনেন।

অসাধারণ ব্যক্তিত্ব:

এ পি জে আবদুল কালাম একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। রাজনৈতিক কিংবা কর্মজীবন সব জায়গাতেই তিনি ছিলেন খুবই সুপরিচিত এক মুখ।

তরুণ শিক্ষার্থীদের খুব ভালবাসতেন এ পি আবদুল কালাম
তরুণ শিক্ষার্থীদের খুব ভালবাসতেন এ পি আবদুল কালাম

মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ পি জে আবদুল কালাম অনেক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে লেকচার দিয়েছেন।

তরুণ শিক্ষার্থীদের খুব ভালবাসতেন তিনি। ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গ দিতেন সেই সাথে কিভাবে পথ চলতে হয়, স্বপ্ন দেখতে হয়, স্বপ্ন পূরণ করতে হয় তা শিখিয়ে যেতেন তাদের।

প্রায় ৮০ লাখেরও বেশি তরুণের সঙ্গে তিনি মতবিনিময় করেছেন বলে জানিয়েছিলেন এক অনুষ্ঠানে।

মৃত্যু:

এই মহান মানুষটি ২০১৫ সালের ২৭ জুলাই মেঘালয়ের শিলং শহরে অবস্থিত ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট নামক এক প্রতিষ্ঠানে ‘বসবাসযোগ্য পৃথিবী’ প্রসঙ্গে বক্তব্য প্রদান করার সময় ভারতীয় সময়  সন্ধ্যা ৬:৩০ নাগাদ হৃদ‌রোগে আক্রান্ত হন।

সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে বেথানী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এবং যেখানে ভারতীয় সময় সন্ধ্যা ৭:৪৫ নাগাদ তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর।

এ পি জে আবদুল কালামের মৃত্যুর খবর শুনে শিলং এর মানুষ বেথানী হাসপাতলের সামনে ভিড় জমান। তাদের মুখে ছিল ‘কালাম অমর রাহে’ শ্লোগান।

আরো পড়ুন:
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট সংখ্যা! এবং তাদের পরিচিতি
ইবনে সিনা – মধ্যযুগের জ্ঞান সাধনার শ্রেষ্ঠ নক্ষত্র
বায়তুল মোকাররম মসজিদের ইতিহাস – যেভাবে এটি জাতীয় মসজিদ হয়ে উঠলো

এ পি জে আবদুল কালামের কিছু অনুপ্রেরণামূলক বাণী:

  • স্বপ্ন বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত তোমাকে স্বপ্ন দেখে যেতে হবে।

  • স্বপ্ন সেটা নয় যেটা তুমি ঘুমিয়ে দেখ, স্বপ্ন হলো সেটাই যা পূরণের অদম্য ইচ্ছা তোমাকে ঘুমাতে দেবে না।

  • যারা হৃদয় দিয়ে কাজ করতে পারে না, তাদের সাফল্য অর্জন আনন্দহীন ও আকর্ষণহীন, এমন সাফল্যের থেকেই সৃষ্টি হয় তিক্ততা।

  • জীবন আর সময় হলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। জীবন শেখায় সময়কে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে আর সময় শেখায় জীবনের মূল্য দিতে।

  • যদি সূর্যের মত উজ্জ্বল হতে চাও, তাহলে তোমাকে প্রথমে সূর্যের মত পুড়তে হবে।

  • জীবন একটি কঠিন খেলা। ব্যক্তি হিসাবে মৌলিক অধিকার ধরে রাখার মাধ্যমে একমাত্র তুমি জয়ী হতে পারবে।

  • গোটা মহাবিশ্ব আমাদের প্রতি বন্ধুসুলভ। যারা স্বপ্ন দেখে এবং কাজ করে তাদেরই শ্রেষ্ঠতা দেওয়ার জন্য চক্রান্তে লিপ্ত এই বিশ্ব।

  • সৌন্দর্য্য থাকে মানুষের মনে, মুখে নয়।

  • যুবসমাজকে চাকরিপ্রার্থী হওয়ার বদলে চাকরিদাতা হওয়া প্রয়োজন।

  • উদার ব্যক্তিরা ধর্মকে ব্যবহার করে বন্ধুত্বের হাত বাড়ান, কিন্তু সংকীর্ণ মনের মানুষরা ধর্মকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন।

subscribe to our youtube channel 2

শেয়ার করুন -

উত্তর দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার নাম লিখুন