সাপের কামড় – ঠিক কতটা ভয়ানক? কিভাবে এর থেকে পরিত্রাণ পাবেন?

সাপের কামড় - ঠিক কতটা ভয়ানক? কিভাবে এর থেকে পরিত্রাণ পাবেন?
সাপের কামড় - ঠিক কতটা ভয়ানক? কিভাবে এর থেকে পরিত্রাণ পাবেন?

পৃথিবীতে যতগুলো ভয়ংকর সরীসৃপ রয়েছে তাদের মধ্যে সাপ অন্যতম। বিষধর সাপের কামড় মানুষকে সারাজীবনের জন্য পঙ্গু করা সহ মৃত্যুর দিকে পর্যন্ত ঠেলে দিতে পারে।

তবে সব প্রজাতির সাপে অবশ্য বিষাক্ত বিষ থাকে না। এবং মানুষ শিকার এদের লক্ষ্য নয়।

সাধারণত এরা নিজেদের রক্ষার্থে মানুষকে কামড়ে থাকে। অনেক সময় সাপকে বিরক্ত করা হলেও এরা কামড়ে দেয়।

তবে যেকারণেই হোক সাপের কামড় কিন্তু মোটেই অবহেলা করার মত বিষয় নয়। সময়মত উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সাপের দংশনের বিষয়টিকে “বিশ্ব স্বাস্থ্য অগ্রাধিকার” হিসেবে বিবেচনা করার ঘোষণা করেছে। ‘আইবিএম থিঙ্ক ২০১৮’র এক অনুষ্ঠানে এই ঘোষণা করা হয়েছিল।

প্রতিবছর ৮১ হাজার থেকে প্রায় ১ লক্ষ ৩৮ হাজার মানুষ সাপের কামড় এর শিকার হয়ে মারা যায়। যাদের প্রায় অর্ধেকেরই মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ভারতে।

সাপের কামড় কতটা গুরুতর?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক তথ্যে উঠে এসেছে, প্রতিবছর গোটা বিশ্বে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ সাপের কামড় এর শিকার হন। তবে সেসব ঘটনার অর্ধেকের কিছু বেশী ক্ষেত্রে আক্রমণ হওয়া ব্যক্তির শরীরে সাপের বিষ প্রবেশ করতে পারে।

সাপের আক্রমণের শিকার হওয়ার পর এর বিষক্রিয়ার ফলে সম্পূর্ণ পৃথবীর লক্ষাধিক মানুষ অন্ধত্ব বা চিরস্থায়ী পঙ্গুত্ব বরণ করে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক এসব ঘটনাকে গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলের সবচেয়ে উপেক্ষিত ব্যাধি হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।

সারাবিশ্বে সবথেকে বেশি সাপের কামড় এর ঘটনা ঘটে সাব-সাহারান আফ্রিকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়।

বিশেষ করে গ্রামবাসীরা সাপের কামড় এর ভুক্তভোগী হন। অনেক সময় উপযুক্ত প্রতিষেধক এবং আধুনিক চিকিৎসার সুব্যবস্থা না থাকার কারণে তাৎক্ষণাৎ তারা সনাতন পদ্ধতিতে চিকিৎসা নেন। একারণে গ্রামবাসীদের মধ্যে সাপের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু সংখ্যা বেশি থাকে।

খুবই দুঃখজনক একটি ব্যাপার হচ্ছে, সাপের আক্রমণের হার প্রবল এমন অনেক দেশেরই নিজেদের উপযু্ক্ত প্রতিষেধক তৈরীর ব্যবস্থা নেই।

সাপের কামড়ের ফলে হওয়া বিষক্রিয়ার প্রভাব দূর করতে কিংবা কমাতে সাধারনত দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নতুন এক পরিকল্পনা অনুযায়ী সাপের আক্রমণ সংক্রান্ত সকল বিষয়ে সব দেশে একই পদ্ধতিতে চিকিৎসা, প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।

সাপের বিষে কি কি ক্ষতিকারক পদার্থ থাকে? এবং তা শরীরে গেলে কি হয়?

সাপের বিষে জিংক সালফাইড (ZnS ) নামক এক প্রকার রাসায়নিক যৌগ পাওয়া যায়। সাপের বিষ মূলত একধরণের লালা(Slaiva) জাতীয় পদার্থ, যাতে বিভিন্ন রকম টক্সিক পদার্থ থাকে, যেমনঃ নিউরোটক্সিন, প্রোটিন (আমিষ)।

তবে এই প্রোটিন সাপের বিষের সর্বাধিক ক্ষতিকর উপাদান। এছাড়াও সাপের বিষে রয়েছে এনজাইম। যা দেহের বৃহৎ মলিকিউলি নামক রাসায়নিকের বন্ধনকে ভেঙ্গে ফেলে।

এই এনজাইম দেহের কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফসফোলিপিড ও নিউক্লিওটাইডকে ভেঙ্গে ফেলতে সাহায্য করে।

তাছাড়া এই বিষ শরীরের রক্তচাপ কমিয়ে দেয় এবং লোহিত রক্ত কণিকা কে ভেঙ্গে ফেলতে পারে। পেশীর নিয়ন্ত্রণকে বাধাগ্রস্থ করে।

সাপের বিষ সংরক্ষণ
সাপের বিষ সংরক্ষণ

বিষাক্ত সাপের কামড়ে কি হয়?

বিষাক্ত সাপকে সাধারনত ২ ভাগে বিভক্ত করা যায়।

  • স্থায়ী দাঁতসহ সাপের বিষে সাধারনত নিউরোটক্সিক বিষ থেকে থাকে, যেগুলো স্নায়ুতে আঘাত করে ও শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য ক্ষতিকর।

  • অন্য আরেক প্রজাতির সাপ রয়েছে যাদের দাঁত লুকানো থাকে যা সাধারণত শিকার করার সময় বা শত্রুকে আক্রমণ করার সময়ই ব্যবহার করে।

এই প্রজাতির সাপের আক্রমণের ফলে শরীরের চামড়ার টিস্যু ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং শরীরে অভ্যন্তরীণ রক্তপাত হয়ে থাকে।

কোন ধরণের সাপের বিষ সবচেয়ে বিষাক্ত?

কোন সাপের বিষ সবচেয়ে বিষাক্ত ও কোন ধরণের সাপ মানুষের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর তা নির্ণয় করে জেনে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।

  • মাটিতে বাস করা যে কোন সাপের মধ্যে সবথেকে বিষাক্ত সাপ হচ্ছে তাইপান যার আবাসস্থল অস্ট্রেলিয়ায়।

বলা হয়ে থাকে, এই সাপের এক ছোবলে যে পরিমাণ বিষ উদগীরণ হয় তার মাধ্যমে প্রায় ১০০ জন মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হতে পারে। তবে এই প্রজাতির সাপের দংশনের কারণে কোনো মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে এমন খবর এখনো পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

এই প্রজাতির সাপগুলো সাধারনত লাজুক স্বভাবের হয়ে থাকে এবং দুর্গম স্থানে বসবাস করে। তাছাড়া অস্ট্রেলিয়ায় এই ধরণের সাপের বিষের প্রতিষেধকও সহজলভ্য।

বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক সাপও অত্যন্ত বিষাক্ত হয়। তবে এসব সাপ মানুষের সংস্পর্শে অনেক কম আসে। একারণে এই সাপের কামড়ের ঘটনা বিরল।

  • ব্ল্যাক মাম্বা ও উপকূলীয় তাইপান সাপ, এগুলো অস্ট্রেলিয়ায় দেখা যায় এরা অপেক্ষাকৃত কম বিষাক্ত কিন্তু অত্যন্ত বিদজনক যা মানুষের জন্য বেশি ঝুঁকির কারণ।

এই ২ প্রকারের সাপই একই প্রজাতির এবং তাদের বিষক্রিয়া খুবই দ্রুত আরম্ভ হয়।

সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা না হলে এই ধরণের সাপের কামড়ের শিকার হওয়া ব্যক্তি আধা ঘন্টারও কম সময়ে মারা যেতে পারে।

কোন ধরণের সাপের কামড় সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ডেকে আনে?

সাপের আক্রমণের সংখ্যা এবং মৃত্যুহারের হিসাবের দিক থেকে, অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের ভাইপার বা বোরা সাপ সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক।

পশ্চিম আফ্রিকা এবং ভারতীয় উপমহাদেশে এই ধরণের সাপগুলোর দেখা পাওয়া যায়। এরা সাধারণত অন্ধকারে আক্রমণ করে বেশি।

সাপের কামড়ে  সারাবিশ্বে প্রতিবছর যত মৃত্যু ঘটে তার অর্ধেকই ভারতে হয় বলে ধারণা করা হয়। দেশটিতে যে ৪ ধরণের সাপের আক্রমণে সবচেয়ে বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করে তাদের মধ্যে এই ভাইপার বা বোরা সাপ অন্যতম।

শীর্ষ চার প্রজাতির বাকিগুলো হলো:

  • ইন্ডিয়ান ক্রেইৎ বা কালাচ সাপ: যদিও দিনের বেলা এরা সাধারণত আক্রমণ করে না। তবে রাতে বেশ আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। এই প্রজাতির সাপ দৈর্ঘ্যে ১.৭৫ মিটার অর্থ্যাৎ ৫ ফুট ৯ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়।

  • রাসেলস ভাইপার: ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ার প্রচুর অঞ্চলে এই আক্রমণাত্মক সাপ দেখা যায়। ইঁদুর জাতীয় প্রাণী এদের প্রধান খাদ্য, তাই শহর ও গ্রামের লোকালয়ের কাছে এদের আনাগোনা বেশি থাকে।

  • ভারতীয় কোবরা বা গোখরা সাপ: ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন এলাকায় গোখরা সাপের সন্ধান মেলে। এরাও সাধারণত রাতের বেলা আক্রমণ করে থাকে। এই প্রজাতির সাপের কামড় এর ফলে দেহে অভ্যন্তরীন রক্তক্ষরণ হয়।

সাপ কামড়ালে কি করা উচিৎ?

যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের পরামর্শ অনুযায়ী সাপের দংশনের শিকার হলে যা করা উচিত তা হচ্ছে-

  • সাপে কামড়ালে বিচলিত না হয়ে শান্ত থাকতে হবে এবং অতি দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা জরুরি।

  • শরীরের যে স্থানে সাপ দংশন করেছে সেটি যতটা সম্ভব কম নড়াচড়া করা উচিত। শরীরে ঘড়ি বা কোন প্রকার অলঙ্কার পড়া থাকলে তা খুলে ফেলতে হবে।

  • কাপড়ের বাঁধন ঢিলা করতে হবে, তবে খোলা যাবে না।

আরো পড়ুন: বিশ্বের অন্যতম ভয়ানক সাপ – র‌্যাটল স্নেক বা ঝুনঝুনি সাপ স্করপিয়নের বিষ থেকে এন্টিভেনম; সংগ্রহে মিশরীয় তরুণ মৃত্যুর পরেও জীবন্ত থাকা কিছু অদ্ভুত প্রাণী

নিম্নবর্তী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করার চেষ্টা করাই যাবে না:

  • কোন ভাবেই সাপের কামড় দেওয়া স্থান থেকে চুষে বিষ বের করে আনার চেষ্টা করা যাবে না।

  • দংশন করা স্থান আরো কেটে বা সেখান থেকে রক্তক্ষরণ করে বিষ বের করে আনার চেষ্টা করা যাবে না।

  • বরফ, তাপ বা যেকোনো ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য কামড়ের স্থানে প্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

  • আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোন অবস্থাতেই একা ফেলে যাওয়া উচিত নয়।

  • সাপে কামড়ানো স্থানের গিঁটের কাছে শক্ত করে বাঁধা। এর ফলে বিষ ছড়ানো বন্ধ হবে না বরং আক্রান্ত ব্যক্তি সারাজীবনের জন্য পঙ্গুও হয়ে যেতে পারেন।

  • বিষধর সাপ ধরা থেকেও নিজেদের বিরত রাখা উচিত। এমনকি মৃত সাপও খুব সাবধানতার সঙ্গে ধরা উচিৎ। কারণ সদ্যমৃত সাপের স্নায়ু মারা যাওয়ার কিছুক্ষণ পরও সতেজ থাকতে পারে এবং তখনও সেই সাপ দংশন করতে পারে।

subscribe to our youtube channel 2

শেয়ার করুন -

উত্তর দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার নাম লিখুন