ইতিহাসের অভিশপ্ত ভৌতিক মহিলা – ব্লাডি মেরি

ইতিহাসের অভিশপ্ত ভৌতিক মহিলা – ব্লাডি মেরি
ইতিহাসের অভিশপ্ত ভৌতিক মহিলা – ব্লাডি মেরি

আমরা অবশ্যই ব্লাডি মেরির নাম শুনেছি। অনেকে বিভিন্ন ভিডিও দেখেছি। ব্লাডি মেরি সম্পর্কে বিভিন্ন জন বিভিন্ন ব্যাখ্যাও দিয়ে থাকেন।

অনেকেরেই বিশ্বাস ব্লাডি মেরি রয়েছে। আবার অনেকেই এসব বিশ্বাস করেন না।

ব্লাডি মেরির ঘটনা জানানোর পূর্বে আগে আমরা ব্লাডি মেরিকে নিয়ে প্রচলিত কিছু বিষয় জানিয়ে রাখি-

অনেকেরই বিশ্বাস যদি কেও রাত ২:৩০ মিনিট থেকে রাত ৩:৩০ মিনিটের মধ্যে একটি অন্ধকার রুমে একটি মোমবাতি জ্বালিয়ে আয়নার সামনে ৩ বার ব্লাডি মেরির নাম উচ্চারণ করে তাহলে সেই আয়নায় ব্লাডি মেরিকে দেখা যায়।

যাকে দেখতে খুবই ভয়ানক। এবং যার চোখ থেকে রক্ত পরতে দেখা যায়। এবং তাকে জোড়ে চিৎকার করতেও শোনা যায়।

আবার অনেকের দাবি ব্লাডি মেরি তাদের উপর আক্রমণও করেছে। অনেকেই বলে থাকে ব্লাডি মেরির হাতে একটি বাচ্চাকেও দেখা যায়, যাকে সবাই ব্লু বেবী বলে জানে।

এমন শোনা যায় যে, যদি কেও সেখানে Bloody Mary I stole your Baby এই বাক্যটি বলে তাহলে অবশ্যই ব্লাডি মেরি তার উপর আক্রমণ করবে।

বহুকাল ধরে মানুষের মাঝে এই সমস্ত কথা প্রচলিত হয়ে আসছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি হচ্ছে আসলেই কি এটি সত্যি??

এই ঘটনার সূত্রপাত সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৬০০ খ্রীস্টাব্দে।

যেখানে ব্লাডি মেরি সম্পর্কে ইতিহাসের পাতায় কিছু তথ্য রয়েছে।

মেরি ছিলেন ইংল্যান্ডের প্রথম মহিলা রাণী শাষক। যার সময়কাল ছিল ১৫৫৩ খ্রীস্টাব্দ।

মেরির বাবা ছিলেন কিং হ্যানরি।

ছেলেবেলা থেকেই মেরি ছিলেন খুবই চতুর এবং বুদ্ধিমতী।

কিন্তু মেরির বাবা সবসময় চাইতেন তার যেন একটি পুত্র সন্তান হয়। যাতে পরবর্তী সময় রাজসিংহাসনের দায়িত্ব নিতে পারে।

আর এ কারণেই মেরি ছিলেন অবহেলিত। পুত্রসন্তান না হওয়ার কারণে কিং হ্যানরি ৬টি বিয়ে করেন।

এই কারণে কিং হ্যানরি এবং মেরির মা ক্যাথরিনের মধ্যে অমিল দেখা যায়। যার জন্য ক্যাথরিনকে রাজ্য থেকে বের করে দেওয়া হয়।

তখন মেরি কেবল ১৪ বছরের কিশোরী। তার মা ক্যাথরিনের সঙ্গে কোন সম্পর্ক না রাখার জন্য তাকে কড়া আদেশ দেওয়া হয়।

মেরির সৎ মা মেরিকে নাজায়েজ বলে দাবি করে এবং রাজপ্রসাদে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়।

তাই ছেলেবেলা থেকেই মেরি প্রচুর মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে বড় হয়।

প্রথম সন্তান হওয়া সত্বেও মেরির সৎ ভাইবোন থেকে তাকে নিচে দেখা হতো।

কিন্তু প্রজাদের মনে মেরির জন্য ছিল ভীষণ ভালোবাসা।

তাই কিং হ্যানরি মারা যাবার পর রাজসিংহাসনের দায়িত্ব মেরিকেই দেওয়া হয়।

৩৭ বছর অবধি মেরি রাজসিংহাসনের দায়িত্ব খুব ভালোভাবে পালন করেন।

কিন্তু একদিন মেরির মনে হয়, তার একটি সন্তান প্রয়োজন,যেন সে পরবর্তী সময়ে এই রাজসিংহাসন সামলাতে পারে।

তাই ফিলিপ নামক এক ব্যাক্তির সঙ্গে তার বিবাহ হয়। যিনি ছিলেন স্পেনের রাজা।

যেহেতু মেরি জীবনে সুখ ও প্রশান্তি পায়নি তাই বিয়ের পর মেরি ভাবতে শুরু করেছিল এবার তার ভাগ্য পরিবর্তন হলো।

মেরি সন্তানসম্ভবা হলে পুরো রাজ্যে খুশির বন্যা বয়ে যায়।

কিন্ত মূলত এখান থেকেই আরম্ভ হয় মেরির দুর্ভাগ্য।

সন্তানসম্ভবা হওয়া এবং তার সমস্ত বিলক্ষণ থাকা সত্ত্বেও ধীরে ধীরে রাজ্যে একটি খবর রটে যায় যে, মেরি আসলে সন্তানসম্ভবা নয়। বরং সে সবাইকে বোকা বানাচ্ছে।

এই তর্ক-বিতর্কে মেরির ভাবমূর্তি প্রজাদের নিকট নষ্ট হতে থাকে।

অপরদিকে তার সৎবোন এ্যালিজাবেথ এর গুণাগুণ বাড়তে থাকে।

তখনকার সময়ে ‍দুটি দলে লড়াই চলছিল। একটি হলো ক্যাথলিক এবং অপরটি প্রটেস্ট্যান্ট।

মেরি চেয়েছিল তার রাজ্যের সবাইকে একজোট দেখতে। আর তাই ১৯৫৪ সনে একটি নিয়ম তৈরি হয়।

মেরি প্রজাদের আদেশ করে তার রাজ্যবাসী সবাইকে যাতে ক্যাথলিক হতে হবে। যদি কেও আপত্তি জানায় তাহলে তাকে রাস্তার মধ্যস্থানে সবার সামনে জ্যান্ত জ্বালিয়ে দেওয়া হবে।

আর এই নিয়ম অমান্য করার কারণে আণুমানিক ২৪৪ জন পুরুষ এবং ৬০ জন মহিলাকে জ্যান্ত জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। যাদের মধ্যে একজন গর্ভবতী মহিলাও ছিল।

আরো পড়ুন: রাজধানী ঢাকার ভেতরে কম দামে জিনিসপত্র কোথায় কী পাবেন? পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম জ্ঞানী ব্যাক্তি দার্শনিক সক্রেটিস

এবং এই সমস্ত দোষের কারণ একা মেরিকেই দেওয়া হয়। কিন্তু আসলে এতে মেরি একা দায়ী ছিল না। বরং ইংল্যান্ডের বড় বড় অ্যাডভাইজারদেরও মত ছিল।

এই ঘটনার পর থেকে মেরিকে সকলে হৃদয়হীন মহিলা নামে ডাকা শুরু করেন।

নিজের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনার জন্য মেরি চিন্তা করেন, যদি তার সন্তান পৃথিবীতে আসে তাহলে প্রজাদের মন শান্ত হবে। আবার খুশিতে ভরে উঠবে গোটা রাজ্য।

একারণে তিনি নির্দিষ্ট সময়ের ১ মাস পূর্বেই তার সন্তানকে ভূমিষ্ঠ করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। তাই যেই ভাবা সেই কাজ।

কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, তখন চিকিৎসক জানায় তার গর্ভে কোন সন্তানই নেই। অথচ গর্ভকালীণ সবরকম লক্ষণই তার মধ্যে ছিল।

এই খবর দাবানলের মতো পুরো রাজ্যে রটে যেতে থাকে। বেশিরভাগ প্রজাই মেরিকে মিথ্যাচরী বলতে থাকে।

এরপর দিনের পর দিন কেটে যেতে থাকে। কিন্তু মেরির কোন সন্তান হয় না।

২ বছর পর মেরি আবার সন্তানসম্ভবা হন। কিন্তু এবার তার স্বামী ফিলিপও বিশ্বাস করেন না তাকে। তাই সে মেরিকে ছেড়ে চলে যান।

কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এবারো ঠিক আগের মতনই অবস্থা হয়। তার কোন সন্তানসম্ভবা হওয়া সত্ত্বেও তার জন্ম নেয় না।

এরপর মেরি পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েন। আর এই ঘটনার ১ বছর পর মেরি ক্যান্সারজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন।

মৃত্যুর সময় তার বয়স মাত্র ৪২ বছর ছিল।

মেরির মৃত্যুর পর তার বোন এ্যালিজাবেথ রাজ্যের দায়িত্ব নেয়।

এখন প্রশ্ন হলো কেন মেরি দুবার সন্তানসম্ভবা হওয়া সত্ত্বেও তার কোন সন্তানের জন্ম হয়নি।

মেডিক্যালি ভাষায় বলতে গেলে একে সিউডোসায়েসিস বা ‘ফলস প্রেগনেন্সি’ বলে থাকে। যার ফলে একজন মহিলা পুরোপুরি অনুভব করতে পারে যে সে সন্তানসম্ভবা। কিন্তু কিছু সময় পার হবার পর ধীরে ধীরে সে স্বাভাবিক হয়ে আসে।

কিন্তু তখনকার সময় এই রোগের ব্যাপারে কারোর জানা ছিল না।

মেরির এই সমস্ত ঘটনার কারণে তাকে সবাই ব্লাডি মেরি বলে থাকে। এবং অনেকেই বলে থাকে আয়নার সামনে কেও ব্লাডি মেরি বলে ডাকলে তার আত্মাকে দেখা যায়।

এই ঘটনা কি আসলেই সত্যি??

এর সোজাসুজি উত্তর হচ্ছে, না।

যারা সেই ১৬০০ সাল থেকে এটি প্রচার করে আসছে তারা মূলত নিজেদের প্রচার এবং স্বার্থোদ্ধারের জন্য এমনটি করে আসছে।

আর যারা এটা বিশ্বাস করে তাদের ক্ষেত্রে এটি হ্যালুসিনেশন ছাড়া আর কিছুই নয়।

কিন্তু তাইবলে কেও আবার এটা পরীক্ষা করতে যাবেন না যেন। এটা মোটেই ঠিক কাজ নয়।

কারণ এসমস্ত ঘটনা থেকে ‍দূরে থাকাটাই উচিত। কেননা অশুভ কোন প্রথা নিয়ে খেলা করাটা ঠিক নয়।

curious

শেয়ার করুন -

উত্তর দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার নাম লিখুন