সৌর জগৎ থেকে পৃথিবীর বুকে লোহার আর্বিভাব

সৌর জগৎ থেকে পৃথিবীর বুকে লোহার আর্বিভাব
সৌর জগৎ থেকে পৃথিবীর বুকে লোহার আর্বিভাব

সভ্যতার বিকাশের জন্য লোহাকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়। কিন্তু ঠিক কখন, কিভাবে, কোথায় লোহার আর্বিভাব হয়েছিল বা কিভাবে লোহা পৃথিবীতে আসল কখনও ভেবে দেখেছেন কি?

সেই লৌহ যুগ থেকে শুরু করে আধুনিক ডিজিটাল যুগ, কোথায় নেই লোহার ব্যবহার?

আইফেল টাওয়ার থেকে বুর্জ আলখালিফা, টাইটানিক থেকে সিম্ফোনি অফদা সিস শুধু তাই নয়।

এছাড়াও বড় ব্রীজ, শিল্পকারখানা, খনি সর্বত্রই আজ লোহার ব্যবহার।

এই অসামান্য কৃতিত্বের অধিকারি লোহার আর্বিভাব সম্পর্কে আজ আমাদের প্রতিবেদন। চলুন জেনে নিই।

লোহার আর্বিভাব সম্পর্কে কথা উঠলেই সর্বপ্রথম যে তথ্যটি আসে তাহলো বিগব্যাং থিওরী।

মহাবিশ্বের জন্ম ইতিহাসের সেই বিগব্যাং থিওরী সম্পর্কে কম-বেশি ধারণা আমাদের সকলেরই আছে।

অক্টোবর ২০১৩ সালে কেলভি ইন্সটিটিউট অফ পার্টিকেল এস্ট্রোফিজিক্স অ্যান্ড কসমোলজি এবং স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অফ এনার্জি- সংস্থা দুইটির যৌথ গবেষণায় জানা যায় কি ভাবে লোহার আর্বিভাব হয়েছিল।

তাদের গবেষণা পত্রে উঠে আসে আজ থেকে প্রায় ১০ বিলিয়ন বছর পূর্বে ক্লাষ্টার গ্যালাক্সি গুলোর মধ্যে ভায়ানক সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়।

যারফলে লোহার আর্বিভাব এবং লোহা অন্যান্য সমস্ত গ্যালাক্সির মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।

বিজ্ঞানীরা, জাপান-আমেরিকার যৌথ স্যাটেলেইট “সুজাকু” তে বসানো ৮৪ সেট এক্সরে টেলিস্কোপ থেকে প্রাপ্ত ছবি বিশ্লেষণ করে এই তথ্য উদ্ধার করেন।

২৫০ মিলিয়ন আলোক বর্ষ দূরে অবস্থিত গ্যালাক্সি সমূহ পর্যবেক্ষনের মাধ্যমে তারা দেখতে পান ঠিক কিভাবে লোহা মহাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে।

১০-১২ বিলিয়ন বছর পূর্বে মহাবিশ্বে বিলিয়ন বিলিয়ন নক্ষত্র সমুহের ভয়বহ সংঘর্ষের ফলে হিলিয়াম থেকে অত্যধিক ভারী ভারী মৌলিক কনিকার উদ্ভব হয়েছিল যেগুলোর মধ্যে লোহার পরমানু ছিল সবচেয়ে বিষ্ময়কর এবং অন্যতম।

সুপারনোভা বিস্ফোরণের সময় মহাবিশ্বের তাপমাত্রা উঠে দাড়িয়েছিল প্রায় ১০ মিলিয়ন ডিগ্রিতে যা এই সব মৌলিক কণিকা সৃষ্টির জন্য দায়ী।

আর যার মাধ্যমে লোহার আর্বিভাব হয় বলে ধারণা করা হয়।

জানা যায় ক্লাস্টার গ্যালাক্সিতে লোহার পরিমাণ ছিল প্রায় ৫০ বিলিয়ন সুর্যের ভরের সমতূল্য।

তাহলে চিন্তা করুন কি পরিমান লোহা এই মহাবিশ্বের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ।

পরবর্তীতে এই সব লোহার পরমাণুসমুহ পরষ্পরের সঙ্গে মিলিত হয়ে সৃষ্টি করতে থাকে বিরাট বিরাট লৌহ খন্ড।

এসব লৌহ খন্ড পরবর্তীকালে গ্যালাক্সি সমুহের মধ্যে ঘুরতে থাকে এবং বিভিন্ন লৌহ গ্রহ উদ্ভব করে যারা পরবর্তীকালে নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।

আর এইসব সংঘর্ষ থেকেই তৈরি হয় বিভিন্ন সাইজের উল্কাপিণ্ড যার অধিকাংশ অংশই লোহা এবং নিকেল।

পরবর্তীকালে এই লোহা এবং নিকেল দ্বারা পৃথবীর অর্ন্তবস্তু বা কোর সৃষ্টি হয় এবং বাকি লোহা ও নিকেল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে ম্যাগমার অভ্যন্তরে যা আমাদের পৃথিবীর মূল চালিকা শক্তি।

আরো পড়ুন:
বিদ্যুৎ শক্তি আবিস্কার – ইতিহাসের সাক্ষী
বিশ্বের এমন কিছু রেকর্ড যা ভাঙ্গা প্রায় অসম্ভব – ইতিহাসের সাক্ষী
তেল উত্তোলনের ইতিহাস এবং অজানা কিছু তথ্য

পৃথিবী সৃষ্টির প্রায় ২০০ মিলিয়ন বছর পরে সৃষ্ট অগভীর সমুদ্রের পানিতে এই সব মৌলিক কনিকা দ্রবীভূত হতে থাকে।

আজ থেকে প্রায় ৩.৫ বিলিয়ন বছর আগে জন্ম নেয় এককোষী সায়ানোব্যাকটেরিয়া যারা তাদের খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতো লোহা এবং নিকেল মিশ্রিত পানি এবং বর্জ্য হিসেবে উৎপন্ন করতো অক্সিজেন।

আর এই অক্সিজেনই প্রাণবিপ্লব ঘটায় পুরা দুনিয়াতে।

এইসব সায়ানোব্যাক্টেরিয়া নিজেদের দেহে লোহা এবং অক্সিজেনের রাসায়নিক বিক্রিয়ায় ঘটায় আয়রনক্সাইড যা সমুদ্রের তলদেশে স্তরীভুত হয়ে জমতে থাকে।

এই স্তরীভূত আয়রনক্সাইড শিলা নামে পরিচিত যেগুলোকে আমরা এখন লোহার আকরিক হিসেবে ব্যবহার করি।

এ হল প্রায় ১০ বিলিয়ন বছরের লোহার আর্বিভাব এর দীর্ঘ পথযাত্রা ।

লোহার আর্বিভাব প্রসঙ্গে পবিত্র আল কোরআন যা বলা হয়েছে-

ইসলাম ধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কোরআন এ লোহার আর্বিভাব সম্পর্কে বলা হয়েছে। তা নিম্নরুপ-

بِالْبَيِّنَاتِ وَأَنْزَلْنَا مَعَهُمُ الْكِتَابَ وَالْمِيزَانَ لِيَقُومَ النَّاسُ بِالْقِسْطِ وَأَنْزَلْنَا الْحَدِيدَ فِيهِ بَأْسٌ شَدِيدٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَلِيَعْلَمَ اللَّهُ مَنْ يَنْصُرُهُ وَرُسُلَهُ بِالْغَيْبِ إِنَّ اللَّهَ قَوِيٌّ عَزِيزٌ

যার অর্থ- “আমরা তো আমাদের রসূলগণকে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম সুস্পষ্ট প্রমাণাদি দিয়ে, আর তাঁদের সঙ্গে আমরা অবতারণ করেছিলাম ধর্মগ্রন্থ ও মানদন্ড যাতে লোকেরা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে, আর আমরা লোহা পাঠিয়েছি যাতে রয়েছে বিরাট শক্তিমত্তা ও মানুষের জন্য উপকারিতা, আর যেন আল্লাহ্ জানতে পারেন কে তাঁকে ও তাঁর রসূলগণকে অগোচরেও সাহায্য করে। নিঃসন্দেহ আল্লাহ্ মহাবলীয়ান।”

উল্লেখ্য, এই স্থানে লক্ষণীয় বিষয় যে, কোরান মাজিদ পৃথিবীতে লোহার অবতরণ বুঝাতে ‘নাযালা’ (نزل) শব্দটি ব্যবহার করেছে।

‘নাযালা’ শব্দটি পূর্বেকার ভাষ্যকারদের নিকট ছিল কোরান মাজিদের এক রহস্য। জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক উন্নতি-উৎকর্ষতা কোরান মাজিদের এই রহস্যকে বর্তমানে বিজ্ঞানের সামনে একটি বাস্তব সত্যে রূপান্তরিত করেছে।

আল্লাহ তাআলা ব্যতীত আর কার এমন সুনিশ্চিত জ্ঞান থাকতে পারে, যা মানব জ্ঞানের সকল স্তরকে অতিক্রম করে ছাপিয়ে যায়।

লোহার আর্বিভাব সম্পর্কে নৃতত্ত্ববিদরা বর্তমানে স্বীকার করে যে, আমাদের সৌর জগৎ এর সম্পূর্ণ শক্তি একত্র করেও এক পরমাণু লোহা উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট নয়।

অধিকন্তু তাদের মতামত, পৃথিবীর উপরিভাগে এক পরমাণু পরিমাণ লোহা উৎপাদন করার জন্য আমাদের সৌর জগতের ৪ গুণ শক্তির দরকার হবে।

এভাবে  পর্যালোচনার মাধ্যমে নৃতত্ত্ববিদরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, লোহা একটি অতি জাগতিক বস্ত্ত, যা পৃথিবীতে এসেছে অন্য কোনো গ্রহ থেকে।

Chemical Education নামক আমেরিকান এক সাময়িকীতে ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের সংখ্যায় এবং New Scientists -এর ১৩ জানুয়ারি ১৯৯০ সালের সংখ্যায় বলা হয়েছে যে: লোহার পরমাণু কণিকাসমূহ সাধ্যাতীত দৃঢ়ভাবে ঘনীভূত।

লোহা হচ্ছে একধরনের সর্বাধিক ভারী পদার্থ যা মানসম্মত পারমাণবিক প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে একটি নক্ষত্রে সৃষ্টি হয়েছে। এতে সর্বাধিক সুদৃঢ় নিউক্লিয়াস বিদ্যমান।

লোহাকে সংশ্লেষণ করার জন্য যেসকল শক্তির দরকার হবে তা পৃথিবীতে সুলভ নয়।

তাই, পৃথিবীতে যে লোহা আমরা প্রাপ্ত হই নিঃসন্দেহে তা বাইরের মহাকাশে সংশ্লেষিত।

লোহার আর্বিভাব নিয়ে নানা সংশয় থাকলেও লোহা যে পৃথিবী তথা মানবজীবনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাতু তা অস্বীকার করা কোন উপায় নেই। এর প্রয়োজনীয়তা এবং ব্যবহার প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে।

তাই, এটির রক্ষার্থে আমাদের উচিত লোহার সুরক্ষায় নানা পদক্ষেপ এখনই গ্রহণ করা।

curious

শেয়ার করুন -

উত্তর দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার নাম লিখুন