একজন শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার গল্প

শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার গল্প
শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার গল্প

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের কান্ডারী। কিভাবে শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠলেন তিনি?

আজ জানবো বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার সেই গল্প।

১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি পারি দেয় এক নতুন প্রেক্ষাপটে।

পাকিস্তানের সাথে ভারতের যুদ্ধ হলেও তাতে পূর্ব পাকিস্তান আক্রান্ত হয়নি।

পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়া ভারতের পক্ষে, চীন পাকিস্তানের দিকে এবং আমেরিকা দুই পক্ষেই ছিল। এবং সেসময় পূর্ব পাকিস্তান ছিল অরক্ষিত।

একারণেই তার প্রতিরক্ষা নিয়ে বাঙালিদের মধ্যে শঙ্কা বাসা বাধে।

ষাটের দশকের বিশ্বপরিস্থিতি এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি একত্রে পূর্ব বাংলার বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও বাম সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছিল।

বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের হয়ে ঐসময় নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এবং সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে অভিভাবকত্ব করছিলেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা মাওলানা ভাসানী। ২ দলের ২ ধারার ২ নেতাই পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার এবং স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে ছিলেন অবিচল।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন পর্যালোচনা করলে লক্ষ করা যায়, তিনি তাঁর শত্রুভাবাপন্ন প্রতিপক্ষের সঙ্গে এক টেবিলে বসে আলোচনা করতেও দ্বিধা করেননি।

কোনো সংলাপ বয়কট কিংবা বর্জনের রাজনীতি বঙ্গবন্ধু পছন্দ করতেন না।

পাকিস্তান সরকার তাঁকে অব্যাহতভাবে প্রতি পদক্ষেপে নাজেহাল করেছে।  কিন্তু তারপরও তারা কোন আলোচনার বৈঠকে আমন্ত্রণ জানালে তিনি স্বগর্বে তাতে যোগ দিয়েছেন এবং নিজের মতামত তুলে ধরেছেন।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থন করে বঙ্গবন্ধু যে লিখিত জবানবন্দি দেন, তার সাথে কেবল কাজী নজরুল ইসলামের ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ তুলনীয়।

তিনি বলেছিলেন-

১৯৬৫ সালে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ চলাকালে যেসকল রাজনীতিবিদ ভারতীয় আক্রমণের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানান, তাদের মধ্যে আমি অন্যতম।

সরকারের যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে পরিপূর্ণভাবে সমর্থন করার উদ্দেশ্যে আমি আমার দল এবং জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানাই।

যুদ্ধ যোগ দেওয়ার প্রচেষ্টার সম্ভাব্য সকল ধরনের সাহায্য-সহযোগীতা প্রদান করার জন্যও আমার দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ইহার সকল অঙ্গের নিকট নির্দেশ প্রেরণ করে।

জুন, ১৯৬৮ সালে পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করা সেই জবানবন্দিতে তিনি আরও বলেন:

যুদ্ধ চলাকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের বাসভবনে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় সম্মেলনে আমি প্রদেশের অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এক যুক্ত বিবৃতিতে ভারতীয় আক্রমণের প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করি।

এবং দেশের যুদ্ধ প্রচেষ্টায় ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম ও সাহায্য-সহযোগীতা করার জন্য জনগণের প্রতি বিশেষ আবেদন জানাই।

যুদ্ধাবসানে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের প্রদেশ ভ্রমণকালে আমি এবং অন্যান্য রাজনীতিবিদগণ আমন্ত্রিত হইয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ গ্রহণ করি।

সেই সময় আমি পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান এবং যুদ্ধকালে আমাদের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে ও প্রদেশকে সামরিক প্রতিরক্ষার ব্যাপারে স্বয়ংসম্পূর্ণ করিয়া তুলিবার প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্টের নিকট আকুল আবেদন জানাই।

কারণ, যুদ্ধচলাকালে পূর্ব পাকিস্তান দেশের অন্যান্য অংশসহ সম্পূর্ণ বিশ্ব হইতে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িয়াছিল।

যুদ্ধকালীন অবস্থা ও তার পরবর্তী পরিস্থিতি পর্যালোচনার উদ্দেশ্যে ২ প্রদেশের প্রধান দলগুলোর নেতাদের মধ্যে এক সম্মেলন আহ্বান করা হয় লাহোরে।

বঙ্গবন্ধুও সেই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। এ সম্পর্কে তিনি তাঁর জবানবন্দিতে বলেছিলেন:

১৯৬৬ সালের গোড়ার দিকে লাহোরে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় জাতীয় সম্মিলনীর সময় বিষয় নির্বাচনী কমিটির নিকট আমি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সমস্যাবলির উল্লেখপূর্বক এর নিয়মতান্ত্রিক সমাধান-ছয় দফা কর্মসূচি উপস্থাপন করি।

ছয় দফা কর্মসূচিতে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তান উভয় অংশের জন্যই পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি করা হইয়াছে।

পশ্চিম পাকিস্তানিদের নিকট পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের কথা যখনই বলা হয়েছে, তখনই পাকিস্তানি শাসকচক্র তাঁকে ভারতীয় ষড়যন্ত্র বলে প্রচার করেছে।

১৯৫০-এর দশকে ভাসানী বলায় তাঁকে ‘ভারতের লেলিয়ে দেওয়া কুকুর’, ‘ভারতের দালাল’ বলে অপমানিত করা হয়েছে।

এবং ঠিক একইভাবে শেখ মুজিবকেও আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি করায় ‘পাকিস্তানের শত্রু’ বলে করা হয়েছিল জেল-জুলুম।

ছয় দফার অপব্যাখ্যা করে পাকিস্তানি শাসকশ্রেণি এবং তাদের সহযোগীরা জনগণকে বিভ্রান্ত করতে থাকায় শেখ মুজিবও তাঁর অবস্থান বেশ পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা দেন।

ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ প্রকাশিত শেখ মুজিবুর রহমান এর “আমাদের বাঁচার দাবী ৬-দফা কর্মসূচী” পুস্তিকাটি বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয়, অসামান্য দলিল।

পুস্তিকাটি সে সময়ের আবহাওয়ায় যে আবেদন সৃষ্টি করেছিল, তা তুলনাহীন। শুরুতেই তিনি লিখেন:

আমার প্রিয় দেশবাসী ভাই-বোনেরা,

আমি পূর্ব পাকিস্তানবাসীর বাঁচার দাবী রূপে ৬-দফা কর্মসূচী দেশবাসী এবং ক্ষমতাসীন দলের বিবেচনার জন্য পেশ করিয়াছি। শান্তভাবে উহার সমালোচনা করার পরিবর্তে কায়েমী স্বার্থীদের দালালরা আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা শুরু করিয়াছেন। জনগণের দুশমনের এই চেহারা ও গালাগালির সহিত দেশবাসী সুপরিচিত। অতীতে পূর্ব পাকিস্তানবাসীর নিতান্ত সহজ ও ন্যায্য দাবী যখনই উঠিয়াছে, তখনই এই দালালরা এমনিভাবে হৈহৈ করিয়া উঠিয়াছেন। আমাদের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী, পূর্ব-পাক জনগণের মুক্তি-সনদ একুশ দফা দাবী, যুক্ত-নির্বাচন-প্রথার দাবী, ছাত্র-তরুণদের সহজ ও স্বল্প-ব্যয় শিক্ষালাভের দাবী, বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করার দাবী ইত্যাদি সকল প্রকার দাবীর মধ্যেই এই শোষকের দল ও তাহাদের দালালরা ইসলাম ও পাকিস্তান ধ্বংসের ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করিয়াছেন।

আমার প্রস্তাবিত ৬-দফা দাবীতেও এঁরা তেমনিভাবে পাকিস্তান ২ টুকরা করিবার দুরভিসন্ধি আরোপ করিতেছেন। আমার প্রস্তাবিত ৬-দফা দাবীতে যে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে পাঁচ কোটি শোষিত বঞ্চিত আদম সন্তানের অন্তরের কথাই প্রতিধ্বনিত হইয়াছে, তাতে আমার কোনও সন্দেহ নাই।…আওয়ামী লীগ আমার ৬-দফা দাবী অনুমোদন করিয়াছেন। ফলে ৬-দফা দাবী আজ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জাতীয় দাবীতে পরিণত হইয়াছে।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৭ বছরের বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চিন্তাধারার সারাৎসার অংশটুকু তাঁর আমাদের বাঁচার দাবী “৬-দফা কর্মসূচী” লেখাটির মাধ্যমে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন নিপুণভাবে।

প্রথম মুদ্রণের পর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের আগেও এটি বহুবার মুদ্রিত হয়েছে।

ছয় দফা নিয়েও সংক্ষিপ্ত আকারের পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। তবে বঙ্গবন্ধুর রচনায় প্রথম প্রকাশিত পুস্তিকাটির বক্তব্য মূল্যবান হয়ে ওঠে নানা কারণে।

সেই পুস্তিকাটির ২/৩টি কপি আমার সংগ্রহে ছিল।

১৯৭৩ সালে বাংলাদেমের খাদ্যমন্ত্রী আবদুল মোমেনের সঙ্গে তাঁর গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনা যাই। তাঁর প্রকাশিত পুস্তিকাটির একটি কপি তাঁকে দেখিয়ে জানতে চাই সেটি প্রকাশের সময়ের কথা।

তিনি বলেন, পুস্তিকাটি বঙ্গবন্ধুর নিজের হাতের লেখা মুসাবিদা। অন্য আর কেউ ওতে হাত দেননি। তিনি ডিকটেশন দিয়েও লেখাননি পুস্তিকাটি। ওই পুস্তিকাটিতে তিনি বলেছিলেন:

আমি জানি, জনগণের দুশমনদের ক্ষমতা অসীম, তাঁদের বিত্ত প্রচুর, হাতিয়ার এঁদের অফুরন্ত, মুখ এঁদের দশটা, গলার সুর এঁদের শতাধিক। এঁরা বহুরূপী। [পাকিস্তানের মূলমন্ত্র] ঈমান, ঐক্য ও সংহতির নামে এঁরা আছেন সরকারি দলে। আবার ইসলাম ও গণতন্ত্রের দোহাই দিয়া এঁরা আছেন অপজিশন দলে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দুশমনির বেলায় এঁরা সকলে একজোট।

এঁরা নানা ছলা-কলায় জনগণকে বিভ্রান্ত করিবার চেষ্টা করিবেন। সে চেষ্টা শুরুও হইয়া গিয়াছে। পূর্ব পাকিস্তানবাসীর নিষ্কাম সেবার জন্য এঁরা ইতিমধ্যেই বাহির হইয়া পড়িয়াছেন।

আগরতলা মামলা প্রত্যাহার এবং আইয়ুব সরকারের পতনের উদ্দেশ্যে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাস হতে ছাত্র-যুব-শ্রমিক-পেশাজীবীদের দুর্বার আন্দোলন আরম্ভ হয়।

আন্দোলনের ওই মামলা থেকে বঙ্গবন্ধু আদালতের রায়ে মুক্তি পাননি। বাংলার সাধারণ মানুষ তাদের প্রিয় বন্ধুকে শত্রুর থাবা থেকে ছিনিয়ে আনে গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়ে।

আরো পড়ুন:
বঙ্গবন্ধু সকল ভারতীয়দের কাছেও একজন বীর: টুইট করেন মোদি

পাকিস্তানের ২ অংশের ভেতরে বৈষম্যের চরিত্র তিনি যুক্তিসহকারে সকলের সম্মুখে তুলে ধরেন।

পূর্ব পাকিস্তানের রাজস্ব আয়ের বেশিরভাগই চলে যায় পশ্চিম পাকিস্তানে। অথচ পশ্চিমের তুলনায় পূর্বের জনসংখ্যার প্রায় ৫৫ ভাগ বাস করে বাংলায়।

এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু লিখেছিলেন:

পশ্চিম পাকিস্তানী ভাই সাহেবান, আপনারা দেখিতেছেন, যেখানে-সেখানে আমাদের দান করিবার আওকাৎ ছিল, আমরা দান করিয়াছি। আর কিছুই নাই দান করিবার। থাকিলে নিশ্চয় দিতাম।…আমরা দেখাইতাম, পূর্ব পাকিস্তানীরা মেজরিটি বলিয়াই পাকিস্তান শুধু পূর্ব পাকিস্তানীদের নয়, ছোট-বড়নির্বিশেষে তা সকল পাকিস্তানীর।…পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থনীতিতে মোটা ও পশ্চিম পাকিস্তানকে সরু করিতাম না। দুই অঞ্চলের মধ্যে এই মারাত্মক ডিসপ্যারিটি সৃষ্টি হইতে দিতাম না।

সাধারণ জনগণের বোধগম্য ভাষায় ‘আপনাদের স্নেহধন্য খাদেম শেখ মুজিবুর রহমান’ লিখেছিলেন:

আপনারা দেখিতেছেন যে, আমার ৬-দফা দাবীতে একটিও অন্যায়, অসংগত, পশ্চিম পাকিস্তানবিরোধী বা পাকিস্তান ধ্বংসকারী প্রস্তাব করি নাই। বরঞ্চ আমি যুক্তিতর্কসহকারে দেখাইলাম, আমার সুপারিশ গ্রহণ করিলে পাকিস্তান আরো অনেক বেশি শক্তিশালী হইবে। তথাপি কায়েমি স্বার্থের মুখপাত্ররা আমার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার এলজাম লাগাইতেছে।

আজীবন তিনি বাংলার মাটি ও মানুষের খাদেম বা সেবক হয়ে ‘তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির সাধনায়’ নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন।

ছয় দফার বক্তব্য জনগণের কাছে স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করতে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন জেলায় জেলায় জনসভা করছিলেন।

বাঙালি মধ্যবিত্তদের মধ্যে বিশেষ করে শিক্ষিত যুবসমাজে আবেদন ছিল। তাদের ভেতরে ছিল প্রচুর সুপ্ত বঞ্চনাবোধ।

আর তাই বঙ্গবন্ধুর জনসভায় জনসমাগম হচ্ছিল প্রচুর। আইয়ুবের তাঁবেদার গভর্নর মোনায়েম খান তাঁর অনুষ্ঠিত সভা-সমাবেশে বলছিলেন, শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র করছেন।

এরপর বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার কোনো কোনো অংশ ‘আপত্তিকর’, অভিযোগে গোয়েন্দাদের দিয়ে এমন রিপোর্ট করিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে একটার পর একটা মামলা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হতে থাকে।

বঙ্গবন্ধুর এক জনসভার মামলায় জামিন নিতে না নিতেই আরেক জেলায় মামলা করা হয়।

পাকিস্তান সরকারের এই প্রতিহিংসামূলক তৎপরতায় বাংলার মানুষের সমর্থন বারবার বঙ্গবন্ধুর দিকেই যায়।

তাতে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তীব্রতর হয় এবং জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে শেখ মুজিবের এক উজ্জ্বল ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে।

৮ মে ’৬৬, নারায়ণগঞ্জ এ পাটকল শ্রমিকদের নিয়ে অনুষ্ঠিত এক বিশাল সমাবেশে শেখ মুজিব তাঁর ভাষণে পাকিস্তান সরকারের দমননীতির কঠোর সমালোচনা করেন।

ওই দিনই দেশরক্ষা আইনের আওতায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। আওয়ামী লীগের আরও অনেক নেতাকেও গ্রেপ্তার করা হয় একই কারণে।

৭ জুন তারিখে নেতাদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ সারা দেশে ধর্মঘটের আহ্বান করে। ১৪৪ ধারা জারি করা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের প্রচেষ্টায় সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয়।

সেই ধর্মঘটে তেজগাঁও ও টঙ্গী শিল্প এলাকা এবং নারায়ণগঞ্জে আবুল হোসেন, মনু মিয়াসহ ১১ জন শ্রমিক নিহত হন। আহতের সংখ্যা অগণিত।

আর গ্রেপ্তার করা হয় হাজার দেড়েক শ্রমিককে।

হরতালে হতাহতের প্রতি তীব্র নিন্দা জানিয়ে মওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিসহ বিভিন্ন দল বিবৃতি দেয়।

পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে কেবল একের পর এক হীন ষড়যন্ত্র করতেই থাকে।

৩ জানুয়ারি ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুক ১ নম্বর আসামি করে সশস্ত্র বাহিনীর ৩৫ জন বাঙালি সদস্য এবং সিএসপি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পাকস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের করা হয়।

সেই ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ বাঙালির স্বাধীনতার ইতিহাসের আরেক অধ্যায়। বঙ্গবন্ধু সহ অন্যান্য অভিযুক্তদের সাধারণ কারাগার থেকে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে গিয়ে আটক করে রাখা হয়।

‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব’ শিরোনামে সেই মামলার বিচারের বিবরণ প্রকাশিত হতে থাকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। এই অবস্থায় শেখ মুজিবের প্রতি সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মনে গভীর সহানুভূতির সৃষ্টি হয় এবং এর মাধ্যমে গড়ে ওঠে তাঁর এক মহানায়কের ভাবমূর্তি।

আগরতলা মামলা প্রত্যাহার এবং আইয়ুব সরকারের পতনের উদ্দেশ্যে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাস থেকে ছাত্র-যুব-শ্রমিক-পেশাজীবীরা দুর্বার আন্দোলন করতে শুরু করে।

আগরতলা মামলা থেকে তিনি আদালতের রায়ের মাধ্যমে মুক্তি পাননি। বাংলার মানুষ তাদের প্রিয় বঙ্গবন্ধুকে শত্রুর থাবা থেকে ছিনিয়ে আনে গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়ে।

অবশেষে ২২শে ফেব্রুয়ারি তিনি মুক্তি পান। ২২শে ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ তাঁকে রেসকোর্স ময়দানে গণসংবর্ধনা প্রদান করে।

এই গণসংবর্ধনায় তিনি হয়ে ওঠেন শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু।

সেই সংবর্ধনায় তাঁকে যে অভিধায় সম্বোধন করা হয়েছিল, আজ তা তাঁর নামের অংশ: বঙ্গবন্ধু। আর এভাবেই বাঙালির কাছে শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন তিনি।

curious

শেয়ার করুন -

উত্তর দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার নাম লিখুন