বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বাস করে বহুকোষী জলজ প্রাণী হাইড্রা। এটির দেহে এমন এক ধরনের কোষ রয়েছে যা তাকে বুড়িয়ে যেতে দেয় না।
আদর্শ পরিবেশ পেলে এটিই হতে পারে পৃথিবীর প্রথম মৃত্যুহীন প্রাণী।
একদল বিজ্ঞানীর সাম্প্রতিক গবেষণার প্রকাশিত প্রতিবেদনে এমন তথ্যই তুলে ধরেছেন তারা।
প্রতিবেদনটি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় বিজ্ঞান একাডেমি সাময়িকী Proceedings of the National Academy of Science-এ প্রকাশিত হয়।
হাইড্রার অমরত্ব নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানের গবেষকরা।
আজ আমরা জানবো এই দীর্ঘজীবি প্রাণী হাইড্রা সম্পর্কে নানা তথ্য।
নামকরণ:
১৭৫৮ সালে ক্যারোলাস লিনিয়াস নামক এক বিজ্ঞানী শতবর্ষজীবী এই প্রাণীর নাম দেন হাইড্রা।
ইরেজিতে Hydra.
গ্রিক রুপকথার নয় মাথাওয়ালা ড্রাগনের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়।
ঐ ড্রাগনটির একটি মাথা কেটে দিলে তার বদলে দুই বা ততোধিক মাথা গজাতো।
হাইড্রার একটি বিশেষ গুণ হচ্ছে হারানো বা ক্ষতিগ্রস্থ অংশ পুণরায় সৃষ্টি করতে পারে।
এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই হাইড্রার এই নামকরণ।
পরিবার:
হাইড্রা নিডারিয়া পর্বভুক্ত সরল গড়নের প্রায় স্বচ্ছ একটি জলজ প্রাণী। এবং এটি Hydridae পরিবারের অন্তর্গত।
প্রজাতি:
বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় ৪০ টির মতো প্রজাতির হাইড্রা রয়েছে।
গায়ের রং, কর্ষিকার সংখ্যা ও দৈর্ঘ্য এবং জননাঙ্গের অবস্থান ও আকারের ভিত্তিতে হাইড্রার শ্রেণীবিন্যাস করা হয়।
তবে তাদের মধ্যে বাংলাদেশে দেখা যায়-
১. Hydra Viridissima বা সবুজ বর্ণের হাইড্রা ,
২. Hydra Oligactis বা বাদামী বর্ণের হাইড্রা ,
৩. Hydra Vulgaris বা বর্ণহীন বা হলুদ-বাদামী হাইড্রা ।
তবে বিভিন্ন প্রজাতি গুলোর মধ্যে Hydra Vulgaris বাংলাদেশে বেশি দেখা যায়।
একারণে এটি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
আকার-আকৃতি:
হাইড্রার দেহ অরীয় প্রতিসম। এটি লম্বায় ১০-৩০ মিলিমিটার এবং চওড়ায় প্রায় ১ মিলিমিটার পর্যন্ত হতে পারে।
বৈশিষ্ট্য:
হাইড্রার দেহ নরম। এবং অনেকটা নলাকার। দেহের এক প্রান্ত খোলা এবং অপর প্রান্ত বন্ধ।
খোলা প্রান্তটিতে মুখছিদ্র অবস্থিত এবং বন্ধ প্রান্তটি কোন বস্তুর সঙ্গে আটকে থাকে।
হাইড্রা সাধারণত নিমজ্জিত বস্তু বা জলজ উদ্ভিদের গায়ে সংলগ্ন থাকে।
তবে বিভিন্ন উত্তেজনাকে সাড়া দেবার জন্য বা খাদ্য গ্রহণের জন্য এদেরকে স্থান ত্যাগ করতে হয়।
নির্দিষ্টি কোন চলন অঙ্গ না থাকায় সমগ্র প্রকৃয়াটি বিভিন্নভাব প্রধাণত পদতল দেহের সংকোচ-প্রসারণশীল পেশিতন্ত্র ও নেমাটোসিস্ট এর সহায্যে সম্পন্ন হয়।
খাদ্যাভ্যাস:
হাইড্রা একটি মাংসাশী প্রাণী। যেসব ক্ষুদ্র জলজ প্রাণীকে সহজেই নেমাটোসিস্ট দিয়ে অবশ করা যায়, সেসব প্রাণীই হাইড্রার প্রধান খাদ্য।
এরা বিভিন্ন পতঙ্গের লার্ভা, Cyclops (সাইক্লপস) ও Daphnia (ড্যাফনিয়া) নামক ক্রাস্টাসীয় সন্ধিপদী প্রাণী ছোট ছোট কৃমি, মাছের ডিম ইত্যাদি খায়।
হাইড্রার খাদ্যগ্রহণপ্রক্রিয়া
হাইড্রার খাদ্যগ্রহণ পদ্ধতি বিচিত্র। ক্ষুদার্ত হাইড্রা পদতলকে ভিত্তির সাথে আটকে নির্দিষ্ট এলাকা জুড়ে মূলদেহ ও কর্ষিকাগুলো ভাসিয়ে দিয়ে শিকারের অপেক্ষায় থাকে।
কোন খাদ্যপ্রাণী বা শিকার কাছে আসামাত্র কর্ষিকার নেমাটোস্টিগুলো উদ্দীপ্ত হয়ে উঠে এবং ঐ শিকার কর্ষিকা স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের নেমাটোসিস্ট-সূত্র নিক্ষিপ্ত হয়।
এর ফলে শিকার অবশ হয়ে গেলে কর্ষিকা সেটিকে মুখের কাছে নিয়ে আসে।
মুখছিদ্র স্ফীত বা চওড়া হয়ে সেটি গ্রহণ করে। মুখের চারদিকে অবস্থিত গ্রন্থিকোষ মিউকাসে সিক্ত ও পিচ্ছিল হয়ে খাদ্য সিলেন্টরনে এসে পৌছায়।
বাসস্থান:
হাইড্রা একটি একক মু্ক্তজীবী প্রাণী। মিঠাপানি যেমন- খাল, বিল, পুকুর, হ্রদ, ঝর্ণায় নিমজ্জিত কঠিন বস্তু এবং জলজ উদ্ভিদের পাতার নিচের পৃষ্ঠে সংলগ্ন থেকে নিন্মমুখী হয়ে ঝুলে থাকে।
এছাড়াও স্থির, শীতল এবং পরিষ্কার পানিতে এদের বেশি দেখতে পাওয়া যায়।
ঘোলা, উষ্ণ এবং চলমান পানিতে খুব একটা সন্ধান মেলেনা।
প্রজনন:
হাইড্রা যৌন বা অযৌন উভয় পদ্ধতিতেই বংশবৃদ্ধি করতে পারে।
যৌন জনন সম্পাদন হয় ২ ভাবে।
১. অস্থায়ী জননাঙ্গ সৃষ্টি
২. নিষেক ও পরিস্ফুটন
অযৌন জনন সম্পাদন হয় ২ ভাবে।
১. মুকুলোদগম-
মুকুলোদগম প্রকৃয়ার শুরুতে দেহের মধ্যাংশে বা নিন্মাংশে একটি ক্ষুদ্র স্ফীত অংশের সৃষ্টি হয়।
স্ফীত অংশটি ক্রমশ বড় হয়ে মুকুল (bud) এ পরিণত হয়।
এতে এপিডার্মিসস, মেসোগ্লিয়া ও গ্যাস্ট্রোডার্মিস সৃষ্টি হয়।
মুকুলটি মৃতৃহাইড্রা থেকে পুষ্টি গ্রহণ করে বড় হয়। এবং শীর্ষপ্রন্তে গঠিত হয় মুখছিদ্র, হাইপোস্টোম ও কর্ষিকা।
শিশু হাইড্রাটি আরও বড় হলে মাতৃহাইড্রা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
শিশুহাইড্রা কিছুক্ষণ বিচরণ করে কোন বস্তু সংলগ্ন হয়ে স্বাধীন জীবনযাপন করে।
২. বিভাজন-
কোন বাহ্যিক কারণে হাইড্রার দেহ দুই বা ততোধিক খন্ডে বিভিক্ত হলে প্রত্যেক খন্ড থেকে নতুন হাইড্রা জন্মায়।