সুমো কুস্তি, জাপানের খুবি জনপ্রিয় একটি খেলা। পুরো বিশ্বে এই খেলাটি ততটা প্রাধান্য না পেলেও জাপানিদের কাছে কিন্তু এটি ঐতহ্যের এক লড়াই। আজ আমরা জানবো জাপানের বিখ্যাত খেলা সুমো কুস্তি সম্পর্কে।
ইতিহাস –
বলা হয় সুমো কুস্তি খেলার প্রচলন শুরু হয় যীশু খৃষ্ট্রের জন্মের পূর্ব থেকে। ততকালীন সময় জাপানের রাজা কে খুশি করবার জন্য জাপানি পালয়ানরা এই খেলার প্রচলন করেন।
যাকিনা ধীরে ধীরে জাপানের নাগরীগদের কাছে অনেকটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করে ফেলে।
যদিও ১৮৬৭ সালে জাপানের সম্রাট সুমুতোই কোসিমা এই খেলা পছন্দ না করায় বেশ কিছু বছর ধরে একে স্থগিত রাখা হয়।
পরে ১৯০৯ সালে দুজন বিখ্যাত সুমোবিদ হিটারিয়ামা ও উনিগ্রেতিনির বিশেষ আগ্রহে আবার শুরু হয় সুমো কুস্তি। মূলত এদের দুজনের উৎসাহ এবং চেষ্টায় তৎকালীন সম্রাট তৈরি করে দেন একটি সুমো স্টেডিয়াম।
আর আজ সুমো কুস্তি জাপানের জাতীয় খেলা সহ এটি সেখানকার সবচাইতে জনপ্রিয় একটি খেলা।
সুমো খেলোয়াড় তৈরি-
সুমো খেলোয়াড়দের জাপানি ভাষায় বলা হয় রিকিসি। এ ক্ষেত্রে যারা নতুন সুমো তাদের বলা হয় ‘মায়েজুমো’। আর যারা ভালো কুস্তি করেন তাদের ‘মাকুচিতা’, ‘জুরিও’, ‘মাকুউচি’, প্রভৃতি নামে ডাকা হয়।
বিশাল শরীরের অধিকারী হওয়া এক একজন সুমো কুস্তিগীর কিন্তু একদিনেই এমনটা হয়ে যায়নি,
এর জন্য শিশুকাল থেকেই তাদের গড়ন বেড়ে উঠা, এবং খদ্যাভাস তৈরি করা হয় আলাদা ভাবে,
আমাদের দেশে একজন শিশুকে পরিপূর্ন ভাবে খেলয়ার হিসেবে তৈরি করার জন্য ঠিক যেমন বিকে এস পি রয়েছে, তেমনি ভাবে জাপানেও এমন বেশ কিছু সরকারী এবং বেসরকারী সংস্থা রয়েছে,
যাদের দায়িত্ব হচ্ছে ছোট থেকে একটি শিশুকে সুমো কুস্তিগির হিসেবে গড়ে তুলা।
গঠন এবং খাদ্যাভ্যাস –
সুমো কুস্তি খেলয়ারদের গড় উচ্চতা ছয় থেকে সাড়ে ছয় ফুটের মতো। এছাড়াও তাদের ওজন হয় দেড়শো থেকে আড়াইশো কেজি কিংবা তার চাইতেও বেশি।
এমন দৈত্যাকৃতির হবার জন্য সুমো কুস্তি খেলয়াড় দের শুরু থেকে ভিন্ন ভাবে জীবন যাপন করতে হয়।
রাখা হয় নিজেস্ব পোশাক, নির্দিষ্ট পরিমানে ঘুম, নিয়ম মাফিক চলা ফেরা এবং অঢেল পরিমানে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা।
একজন সুমো কুস্তিগিরের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় যেকল জিনিস দেয়া হয় সে গুল হচ্ছে –
চার – পাঁচ কেজি মাংস,
২০ থেকে ২৫টি ডিম,
সমুদ্রের শৈবালের তৈরি খাবার,
নারিকেলের পানি,
স্কুইড,
সামুদ্রিক মাছ,
এছাড়াও প্রটিন এবং পুষ্টি বৃদ্ধি করা নানা ধরনের খাদ্য দ্রোব্য,
সুমো খেলার নিয়ম –
জাপানিরা এই সুমো খেলায় শিন্তো ধর্মীয় বিশ্বাসে আবদ্ধ। এমনকি এ খেলার আশির্বাদ হিসেবে শুরুতে লবণ ছিটানোর মাধ্যমে পরিশুদ্ধিকরণ অন্যতম একটি উদাহরন।
একটি বড়ো বৃত্তের মধ্যে খেলা হয় সুমো। যেই বৃত্তটি মূল মাটি থেকে কিছুটা উঁচুতে থাকে। খেলা শুরু হওয়ার আগে একজন উপস্থাপক প্রতিযোগীর নাম, বয়স, ওজন বলে দেন।
ঠিক সে সময়টাতে পুরো চত্বর প্রদক্ষিণ করে দুজন কুস্তিগীর গ্যালারিমুখো হয়ে দাঁড়ান। এরপর এক পায়ে দাঁড়িয়ে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে ‘সব শয়তানের ধ্বংস হোক’ এই প্রার্থনা করে এবং নিজের জয়ের জন্য আশীর্বাদ চেয়ে খেলার জন্য প্রস্তুত হয়,
একজন সুমো কুস্তিগীরকে জয়লাভ করতে হলে –
প্রথম কুস্তিগীর জোরপূর্বকভাবে তার প্রতিপক্ষকে বৃত্তাকার সেই স্থান থেকে বাইরে ফেলে দিতে হবে।
অথবা,
প্রথম কুস্তিগীর জোরপূর্বকভাবে তার প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে ভূমি স্পর্শ করবে।
এ ক্ষেত্রে যদি একই সময়ে দুজনে ভূমি স্পর্শ করেন তাহলে যিনি অভিজ্ঞ তিনিই বিজয়ী হবেন।
সুমো প্রতিযোগিতা –
সম্পূর্ণরূপেই সুমো কুস্তি খেলা কঠোরভাবে শৃঙ্খলিত খেলাধূলার শক্ত মানদণ্ডে আবদ্ধ। কুস্তিগীরগণ ইদো শাসনামল থেকে প্রচলিত শত-শত বছরের পুরনো পদ্ধতিতে শীর্ষস্থানীয় ক্রীড়াবিদ হিসেবে পরিগণিত হন। পুরো বছরব্যাপী ৬টি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ ও যথাযথ দক্ষতা প্রদর্শনের মাধ্যমে কুস্তিগীরকে উত্তরণ অথবা অবনমিত করা হয়।
যেই প্রতিযোগিতা গুল হচ্ছে যথাক্রমে –
মাকুচি: সর্বোচ্চ ৪২ জন কুস্তিগীর।
জুরিও: নির্ধারিত ২৮ জন কুস্তিগীর।
মাকুশিতা: নির্ধারিত ১২০ জন কুস্তিগীর।
সানদানমে: নির্ধারিত ২০০ জন কুস্তিগীর।
জোনিদান: আনুমানিক ২৩০ জন কুস্তিগীর।
জোনোকুচি: আনুমানিক ৮০ জন কুস্তিগীর।
একজন কুস্তিগীরকে প্রাথমিকভাবে সর্বনিম্ন স্তর জোনোকুচি বিভাগে অংশগ্রহণ করতে হয়। এবং তার দক্ষতা প্রদর্শনের উপর নির্ভর করে তাকে উপরের বিভাগে সুযোগ করে দেয়া হয়।
শীর্ষস্থানীয় মাকুচি বিভাগে অংশগ্রহণকারীগণ সমর্থকদের কাছ থেকে সর্বাপেক্ষা মনোযোগ আকর্ষণ করেন।
জাপানে প্রতি বৎসরই নিয়মিতভাবে প্রদর্শনীমূলক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। শীর্ষস্থানীয় কুস্তিগীরগণ বিদেশে আনুমানিক প্রতি দু’বছরে একবার এ ধরনের প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। কিন্তু এ ধরনের প্রদর্শনী খেলার ফলাফল তাদের স্থান নির্ধারণে কোন প্রভাব বিস্তার করে না।
জনপ্রিয়তা –
আমাদের দেশে একজন ক্রিকেটার যেভাবে সকল সাধারন মানুষদের কাছে অনেকটাই জনপ্রিয়, ঠিক তেমনি ভাবে জাপানে সুমো কুস্তিগীর সেই দেশের নাগরীগদের কাছে বিখ্যাত।
এছাড়াও তাদের পারিশ্রমিক বিশ্বের অন্যান্য সকল খেলয়ারদের থেকে নেহাত কোন অংশেই কম নয়।
এখন পর্যন্ত সবচাইতে বেশি পারিশ্রমিক প্রাপ্ত সুমো রেসলারের বেতন হচ্ছে প্রতি মাসে এক মিলিয়ন ডলারের চাইতেও বেশি।
তাছারা প্রতিবছর যিনি এই সুমো কুস্তি রেসলিংয়ে গ্রান্ড চ্যাম্পিয়ন হন তিনি বিভিন সম্মানোনা পাওয়ার পাশাপাশি এই খেলার ট্রফি এবং নগদ ১০ মিলিয়ন ইয়েন পেয়ে থাকেন।
সুমো রেসলার দের আয়ু –
জাপানে মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৮৩ বছরের চাইতেও বেশি, কিন্তু এ ক্ষেত্রে সুমো রেসলারদের দের গড় আয়ু হচ্ছে ৬৫ বছর,
সুমো রেসলারদের অতিরিক্ত মেদ, এবং তাদের খাদ্যাভাসের কারণে ডায়বেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, প্রভৃতি রোগে শেষ বয়সে এসে ভুগে থাকেন। যার ফলে তাদের পক্ষে জাপানের নাগরীগদের মত বেশি দিন বেঁচে থাকা অনেকটাই কঠিন হয়ে দাড়ায়।