ইল্যুশন, ডিল্যুশন এবং হেলুসিনেশন কি? বিজ্ঞানে এর ব্যাখ্যা
ইল্যুশন, ডিল্যুশন এবং হেলুসিনেশন
ইল্যুশন, ডিল্যুশন এবং হেলুসিনেশন আসলে কি? আমরা সবাই কি এর সঠিক ব্যাখ্যা জানি? নাকি সবাই ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে বাঁচি। চলুন জেনে আসি।
ডিল্যুশন (Delusion) কথাটার খুব বেশি প্রচলণ নেই। তবে ইল্যুশন (Illusion) আর হেলুসিনেশন কথাটা আমরা আজকাল প্রায়শই শুনে থাকি।
বিশেষ করে ইল্যুশন শব্দটা টুকটাক নেট সার্ফিং করতে গেলে চোখে পড়েই যায়। আবার এখন প্রায়শই অনেককে আমরা বলতে শুনি , “আমার হেলুসিনেশন হচ্ছে।”
যদিও তাদের অধিকাংশই এটা জানেনা যে, যে রোগটিকে তারা হেলুসিনেশন বল ধরে নিচ্ছে তা আদৌ হেলুসিনেশন কিনা।
কারণ যেচে কেউ নিজেকে টায়ফয়েডের রোগী বা আলসারের রোগী বানাতে চাইলেও, যেচে পড়ে কেউ নিজেকে মানসিক রোগী বলে পাগল প্রমাণ করতে চাইবে না।
যাই হোক, চলুন আজ তাহলে জেনে নেয়া যাক ইল্যুশন, ডিল্যুশন এবং হেলুসিনেশন সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে।
আমাদের আজকের আলোচনার প্রধান বিষয় হলো ইল্যুশন। এর পাশাপাশি ডিল্যুশন আর হেলুসিনেশন নিয়েও থাকছে কিছু কথা।
সবার আগে জেনে রাখা ভাল- ইল্যুশন, ডিল্যুশন এবং হেলুসিনেশন কিন্তু মোটেও একই জিনিস না।
একটি ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণ, অন্যটি ভ্রান্ত বিশ্বাস এবং তৃতীয়টি হলো সম্পূর্ণ অলীক প্রত্যক্ষণ।
অর্থ্যাৎ হেলুসিনেশন হচ্ছে একেবারেই বাস্তব কোনো উদ্দীপক ছাড়াই কোনো কিছু অনুভব করা বা প্রত্যক্ষ করা।
তাহলে আসুন এবার বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক-
ইল্যুশন –
ইল্যুশন হলো ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণ। অর্থ্যাৎ কোনো কিছু আসলে যেভাবে আছে সেটাকে সেভাবে না দেখে বা সেটা হিসেবে না শুনে অথবা সেই হিসেবে অনুভব না করে অন্যকিছু হিসেবে অনুভব করা।
আরো পরিষ্কার করে বলতে গেলে চোখ, নাক, কান, ত্বক প্রভৃতি মানব ইন্দ্রিয় থেকে পাওয়া সংবেদন (Sensation) আমাদের মস্তিষ্কে যখন ঐ বস্তু, প্রাণী বা পদার্থের পাওয়া সংবেদন (চোখে পড়া আলোর প্রতিফলন বা ছবি, নির্দিষ্ট গন্ধ, নির্দিষ্ট শব্দ/আওয়াজ, নির্দিষ্ট স্পর্শ বা ছোঁয়া) প্রভৃতি সঠিকরূপে প্রক্রিয়াজাত বা Process হতে পারেনা তখন আমরা দেখি একরকম আর আমাদের মস্তিষ্ক আমাদের বুঝায় অন্যরকম।
আমরা ঘ্রাণ পাই এক জিনিসের কিন্তু বুঝি অন্য জিনিস। আমরা শুনি এক আর বুঝি আরেক। আমরা স্পর্শ পাই এক জিনিসের কিন্তু আমাদের মস্তিষ্ক বোঝে অন্যআরেক জিনিস।
এবং এটাই হচ্ছে ইল্যুশন। ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, উপরে যে কয়টা পরিস্থিতির কথাই বল হোক না কেন প্রতিক্ষেত্রেই কিন্তু বাস্তবে কোনো কিছুর অস্তিত্ব রয়েছে বা ঘটছে, শুধুমাত্র আমাদের মস্তিষ্ক সেটাকে ভুলভাবে নিচ্ছে।
আর এটাই হচ্ছে Illusion বা ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
অর্থাৎ বাস্তবে যেকোন উদ্দীপক থাকবে। কিন্তু আমাদের মস্তিষ্ক তা থেকে প্রাপ্ত উপাত্ত সঠিকভাবে গুছাতে সক্ষম হয়না বা তার সাথে সঠিক তথ্য জুড়াতে পারেনা।
বিভিন্ন প্রকার ইল্যুশন:-
আমরা আসলে কেউই পুরোপুরি চোখ দিয়ে দেখিনা, নাক দিয়ে ঘ্রাণ নিই না, কান দিয়ে শুনি না। অবাক হচ্ছেন, তাই না? মজার ব্যাপার হলেও এটাই কিন্তু আসল সত্যি!
আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোর মাধ্যমে আমরা শুধুমাত্র সংবেদন গ্রহণ করি মাত্র এরপর তাকে উপযুক্ত রুপদান এবং আমাদের কাছে ব্যাখ্যা করে আমাদের মস্তিষ্ক।
যেহেতু আমাদের মস্তিষ্ক ভিন্ন ভিন্ন ইন্দ্রিয় অথবা Sense থেকে ভিন্ন ভিন্ন সংবেদন গ্রহণ করে তাই তা থেকে প্রাপ্ত ইল্যুশনও ভিন্ন হয়।
এই ভিন্ন ভিন্ন ইল্যুশনগুলো ৪ প্রকার। যেমন –
১. অপটিকাল ইল্যুশন বা (ভুল দেখা)
২. অডিটরি ইল্যুশন বা (ভুল শোনা)
৩. ট্যাকটাইল ইল্যুশন বা (স্পর্শের ভ্রান্তি)
৪. টেম্পোরাল ইল্যুশন বা (সময়ের ব্যাপারে ভ্রান্তি)।
যেহেতু বস্তুজগতের ৭০% সংবেদনই আমরা গ্রহণ করি দর্শন ইন্দ্রিয় বা চোখ দ্বারা সেক্ষেত্রে এই ৪টির মধ্যে অপটিকাল ইল্যুশনই সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী।
আসুন ৪টি ভিন্ন ভিন্ন ইল্যুশস সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিই-
১. Optical Illusion বা দৃষ্টিবিভ্রমঃ-
যেকোনো বস্তুর উপর প্রতিফলিত রশ্নি ফোটনরুপে চোখ দ্বারা আমাদের অপটিক নার্ভ দিয়ে সিগন্যালরুপে মস্তিষ্কে প্রবেশ করে।
প্রাথমিক ভাবে এসব রশ্মি বিচ্ছিন্ন এবং অবিন্যস্ত অবস্থায় থাকে।
আমাদের মস্তিষ্কে থাকা Automated ব্যবস্থা প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে তা একসঙ্গে গুছিয়ে নিয়ে আসে এবং নিউরনগুলোর মধ্যে থাকা তথ্যভাণ্ডার হতে খুঁজে সেই প্যাটার্ন, প্যাটার্নের রঙ, ধরণ ইত্যাদি শনাক্ত করার পর আমরা সেটাকে বস্তু, পরিচয়, নাম, ধরণ প্রভৃতি রূপে বুঝতে পারি।
কিন্তু মস্তিষ্কের এই পুনঃবিন্যাস এবং শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া কিছু কিছু সময় বিভিন্ন কারণে ব্যহত হয়।
এবং সেসময়ই আমরা আসলে প্রত্যক্ষ করি এক জিনিস, কিন্তু আমাদের মনে হয় আমরা দেখছি অন্যকিছু।
এই ধরণের সমস্যা বিপরীত বর্ণের কিংবা রঙের যেমন- সাদা-কালো, প্যাটার্নের আবার অনেকসময় আলোর স্বল্পতা অথবা পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন কারণেও হয়ে থাকে।
মস্তিষ্ক তখন সংবেদন গুলোর আসল গভীরতা (Depth), মাত্রা বা Dimension (দ্বিমাত্রিক নাকি ত্রিমাত্রিক), পরিমাপ বা Scaling ঠিকঠাক মতো করতে পারেনা।
এবং মস্তিষ্ক যাই Process করে, আমাদের বুঝায়ও তাই, তা ভুল হলে ভুল এবং ঠিক হলে ঠিক।
আর একারণেই অনেকসময় অন্ধকার ঘরে আমাদের ঘুম ভাঙলে পাশে ঝুলানো কাপড় দেখে আমরা মনে করি জীনের বাদশা।
২. Auditory Illusion বা শব্দবিভ্রমঃ-
মাঝরাতে হঠাৎ আপনার ঘুম ভেঙে গেল এবং আপনি কোনোকিছুর খুটখাট শব্দ শুনতে পেলেন। তারপর যখন সেই শব্দে আপনার অস্বস্তি বেড়ে যেতে আরম্ভ করলো ঠিক তখনি আপনি অদ্ভুত এক গোঙ্গানির শব্দ শুনতে পেলেন। মনে হচ্ছে এ শব্দ যেন পার্থিব কোনকিছুর না।
তারপরেও আপনি সাহস সঞ্চয় করে শব্দে উৎসের সম্মুখে গেলেন, এবং স্বস্তির নি:শ্বাস ফেললেন!
কারণ আসলে শব্দটা করছিল একটি ইদুর।
অথচ আপনার মস্তিষ্ক প্রথমে বুঝ দিলো শব্দটা অতিপ্রাকৃত কিছু। শব্দের এরকম বিভ্রান্তিই হচ্ছে Auditory Illusion.
৩. Tactile Illusion বা স্পর্শবিভ্রান্তিঃ-
আপনি বসে কোন কাজ করছেন। আর হঠাৎ করেই আপনার মনে হল আপনার হাতে একটা প্রজাপতি উড়ে এসে বসলো। আপনি হকচকিয়ে উঠে গেলেন!
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা কাপড়ের টুকরো ছিল। স্পর্শের অথবা অনুভূতির এধরনের ভ্রান্ত ধারণাই হলো Tactile Illusion.
৪. Temporal Illusion বা কালবিভ্রমঃ-
অংক বিষয়টি আপনার চরম অপছন্দ। অংক ক্লাস চলাকালে আপনার প্রতিটা সেকেন্ড মনে হয় একেকটা ঘণ্টার সমান। কিন্তু বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেবার বেলায় সময় কোনদিক দিয়ে চলে যায় তা টেরই পান না।
তখন মনে হয় একেক ঘণ্টা যেন মাত্র কয়েকটা সেকেন্ডের সমান।
এইযে রুচির উদ্দীপকের প্রভাবে অতিবাহিত সময় সম্পর্কে আপনার বিভ্রান্তি, এই প্রকার বিভ্রান্তিই হচ্ছে কালবিভ্রম বা Temporal Illusion।
ডিল্যুশন:-
মিসেস রুমকির (কাল্পনিক) মা মারা গিয়েছেন আজ থেকে প্রায় তিন বছর আগে।
তবু তার বিশ্বাস, রোজ বুধবার তার মায়ের বিদেহী আত্মা আসে উনাদের দেখার জন্যে।
একারণে তিনি সেদিন ঘরে আগরবাতি জ্বালান, মিলাদ দেন, এবং অযথাই কান্নাকাটি করেন।
পরিস্থিতি হাতের বাইরে গেলে উনার স্বামী একজন মনোবিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করান তাকে। মনোবিদ পরীক্ষা করে জানান, মিসেস রিুমকি ডিল্যুশনে ভুগছেন।
এই যে বিভিন্ন উদ্দীপকের প্রভাবে মানুষের মধ্যে বিভিন্নরকম ভ্রান্ত ধারণা-বিশ্বাস, একদম সমূলে দানা বেধে বসে এগুলোই হচ্ছে ডিল্যুশন।
সব ডিল্যুশন মানসিক রোগ পর্যায়ে রূপ নেবে ততটা গুরুতর হয় না।
তবে বহু ডিল্যুশনই মারাত্মক মানসিক সমস্যার আকার ধারণ করে।
এতে করে ব্যক্তিবিশেষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যহত হয়।
উল্লেখ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হেলুসিনেশন ডিল্যুশনাল ডিসঅর্ডারের অংশরূপে থাকে।
সুতরাং বোঝাই যায় ডিল্যুশন So called ইল্যুশনের চাইতে আরো বেশি গুরুতর! ভ্রান্ত ধারণা বা বিশ্বাস গুরুতর পর্যায়ে চলে গেলে সেক্ষেত্রে কালক্ষেপন না করে ভাল কোনো মনঃচিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া অত্যন্ত জরুরী।
তবে তাই বলে যেকোনো প্রকার সমস্যাকে হুট করে ডিল্যুশন ধরে নেওয়া ঠিক নয়।
হেলুসিনেশন:-
আমরা অনেকসময় ভুলভাল দেখে ঘটনাটিকে বলে থাকি, “হায় হায়, আমার হেলুসিনেশন হচ্ছে।”
কিন্তু আসলে তা নয়, হেলুসিনেশন (Hallucinaton) মোটেও ভুলভাল কিচ্ছুনা।
হেলুসিনেশন হলো এমন এক ব্যধিগ্রস্থ পর্যায়ের মানসিক অবস্থা যে অবস্থায় থাকাকালে আক্রান্ত ব্যক্তি কোনো উদ্দীপ ব্যতীতই বস্তু প্রত্যক্ষণ করে থাকে।
অর্থাৎ তারা এমন কিছু দেখে যা আসলে ভুল দেখা নয় বস্তুত সেখানে আসলে কিছু নেই।
নমুনাস্বরূপঃ ইল্যুশনে কেউ দড়ি দেখে সাপ ভাবতে পারে, কিন্তু হেলুসিনেশনে কেউ দড়ি না থাকা সত্বেও সেজায়গায় সাপ দেখতে পারে, অথবা ঘুমভাঙা মাঝরাতে দেখতে পারে তার পাশে বিকটদর্শী বহু চোখ মুখওয়ালা কোনো এক জন্তু তার মুখের সামনে ঝুঁকে আছে।
অনেকেই বলে থাকে Hallucinative অবস্থায় তারা কথা শুনতে পায় কিন্তু বাস্তবে সেখানে কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নেই।
আবার অনেকে কোনো উৎস ছাড়াই ঘরের যেকোনো নির্দিষ্ট জায়গায় সুঘ্রাণ বা দুর্গন্ধ পাচ্ছে। এগুলোকেই বলে হেলুসিনেশন।
হেলুসিনেশন আমাদের প্রধান পঞ্চ ইন্দ্রিয় গুলোর মধ্যে যেকোনোটির ক্ষেত্রেই হতে পারে।
এসব নির্ভর করে মস্তিষ্কের প্রক্রিয়ার তীব্রতার উপর নির্ভর করে।
যেহেতু হেলুসিনেশন বাহ্যিক কোনো উদ্দীপক ব্যতীতই ঘটে থাকে তাই এর কারণ, ঝুঁকি এবং মাত্রাও নির্ভর করে দেহের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা বা গঠনের উপর।
আর এ কারণেই হেলুসিনেশনকে মূলত একধরণের মানসিক রোগ বলা চলে। কিংবা এটি হতে পারে অন্যান্য মানসিক রোগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
তবে কিছু হালকা মাত্রার হেলুসিনেশন রয়েছে যেমন- কিছু Simple Visual Hallucination, LSD এসব মাদকের প্রভাবে সাময়িক ভাবে হেলুসিনেশন হয়। এই প্রভাবগুলো কোনো মারাত্মক মানসিক রোগ ছাড়াও বিচ্ছিন্ন Symptom এর মত দেখা যায়।
আর মনে রাখা জরুরী কেবলমাত্র একটি এবং বিচ্ছিন্নভাবে হওয়া Symptom কখনো মানসিক রোগ (Syndrome) হতে পারেনা।
মানসিক রোগ এর জন্য প্রয়োজন পড়ে একাধিক Symptom এবং দরকার সেগুলোর পুনরাবৃত্তির।
হেলুসিনেশন বিভিন্ন প্রকার শারিরীক অভ্যন্তরীণ কারণেও হতে পারে।
এগুলো মধ্যে Parkinson Disease, মৃগী রোগ বা Epilepsy, প্রচন্ডরকম মানসিক চাপ বা ভয়ের সম্মুখীন হওয়া অথবা এমন কোনো ঘটনা দ্বারা সৃষ্ট Post Tarumatic Disorder বা মস্তিষ্কের স্নায়ুর স্বাভাবিক কার্যবিধি কোনো কারণে ব্যহত বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণেও হয়ে থাকে।
স্কিৎসোফ্রেনিয়া (Schizophrenia), Psychosis, নানারকম Deperssive Disorder প্রভৃতি কারণে হেলুসিনেশন হতে পারে।
এমতাবস্থায় দেরী না করে যতদ্রুত সম্ভব ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া অত্যাবশ্যকীয় কর্তব্য…
ইল্যুশন, ডিল্যুশন এবং হেলুসিনেশন নিয়ে ভ্রান্তি-বিভ্রান্তির কথাবার্তা আজ তাহলে এপর্যন্তই। পরে আবার কথা বলা যাবে অন্যকোন বিষয় নিয়ে।
onek ojana tottho janlam
tnx for this valuable airticle. 🙂