লজ্জাবতী গাছ; স্পর্শেই নুয়ে পরা অদ্ভুদ এক উদ্ভিদ

লজ্জাবতী গাছ; স্পর্শেই নুয়ে পরা অদ্ভুদ এক উদ্ভিদ
লজ্জাবতী গাছ; স্পর্শেই নুয়ে পরা অদ্ভুদ এক উদ্ভিদ

মাইমোসা বা লজ্জাবতী লতা উদ্ভিদটি লজ্জাবতী গাছ নামেই বেশি পরিচিত। গ্রামাঞ্চলের ঝোপ-ঝাড়ে বেশি দেখা যায়। আমাদের শৈশবের স্মৃতির সঙ্গে ওতোপ্রতো ভাবে জড়িত এই উদ্ভিদ।

ছেলেবেলায় আমরা খেলার ছলে গাছটির  পাতা বা কান্ড ছুঁয়ে দিলেই সঙ্গে সঙ্গে নুইয়ে পরতো তা। এ নিয়ে আমাদের শৈশব মনে তখন আনন্দের বন্যা বয়ে যেত।

নামকরণ:

লজ্জাবতী গাছের ইংরেজী নাম Mimosa বা মাইমোসা। একটি লাতিন শব্দ।

স্পর্শের সঙ্গে সঙ্গে লজ্জাবতীর ছড়ানো পাতা একদম বন্ধ হয়ে যায়। একারণে গ্রামে-গঞ্জে সাধারণ ভাবে, একে লজ্জা পায় বলে ইঙ্গিত করে এই উদ্ভিদকে লজ্জাবতী নামে ডাকে।

এই গাছের আরও কিছ নাম রয়েছে। যেমন- করপত্রাঞ্জলি, অঞ্জলিকারিমা

বৈজ্ঞানিক নাম:

লজ্জাবতী গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Mimosa Pudica Linn.

পরিবার:

লজ্জাবতী উদ্ভিদ লেগিউম জাতীয় ফ্যাবায়েসি পরিবারের Mimosoideae উপ-পরিবারের অন্তর্গত।

এই গণটির নাম এসেছে গ্রিক ভাষার শব্দ μιμος (mimos) হতে।

যেটির অর্থ “নকল”, এবং মেয়েলি প্রত্যয়ে–osa, “অনুরূপ”, এর ‘সংবেদনশীল পাতাগুলি’র নির্দশে করে।

যা ‘সচেতনভাবে প্রতিক্রিয়া জানানোর ভান ধরে’ বলে ধারণা করা হয়।

প্রজাতি:

পৃথিবীতে প্রায় ৪০০ প্রজাতির বিভিন্ন রকম লজ্জাবতী দেখা যায়।

এর মধ্যে জায়ান্ট মাইমোসা (কাঁটাবিহীন লজ্জাবতী) ডাঙ্গায় বেশি দোখা যায়।

এবং ওয়াটার মাইমোসা অগভীর পানিতে জন্মাতে  বেশি দেখা যায়।

ইতিহাস বা আদিনিবাস:

লজ্জাবতী গাছের আদিনিবাস আমেরিকার মেক্সিকোতে। তবে বর্তমানে এটি বিভিন্ন জায়গায়, দেশে ছড়িয়ে পরেছে।

প্রাপ্তিস্থান:

দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, আমেরিকার উত্তর-দক্ষিণ কোস্টাল বেল্টে আফ্রিকার অনেক দেশে এবং অস্ট্রেলিয়ায়ও প্রচুর পরিমাণে লজ্জাবতী গাছ জন্মাতে দেখা যায়।

ট্রপিক এবং সাব-ট্রপিকের আওতাধীন সকল দেশে লজ্জাবতী ভালো জন্মায়।

ভারতের রাজস্থানে বিভিন্ন বাগানে কভার ফসল হিসেবে ও গ্রিন ম্যানুয়ারিং ফসল হিসেবে লজ্জাবতী গাছ চাষেরও প্রচলন রয়েছে।

বাংলাদেশেও প্রচুর পরিমাণে লজ্জাবতী গাছ জন্মে। প্রায় প্রতিটি জেলার উঁচু ভূমিতে সব ধরণের মাটিতে লজ্জাবতী জন্মে।

তবে গাড় ও পাহাড়ী এলাকার মাটিতে এ প্রজাতির উদ্ভিদ বেশি জন্মায়।

আগাছা হিসেবেও বাংলাদেশের বনভূমির উন্মুক্ত প্রান্তিক এলাকায় প্রচুর লজ্জাবতী  গাছ বেড়ে ওঠতে দেখা যায়।

আকার-আকৃতি:

লজ্জাবতী গাছ একটি ক্ষুদ্র গুল্ম জাতীয় লতা উদ্ভিদ। উদ্ভিদের পাতার বোঁটা ৩/৪ সে.মি. পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। এবং এই বোঁটার প্রান্ত থেকে হাতের চারটি আঙুলের মতো বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের (দুটি ছোট ও দুটি বড়) চারটি পত্রদন্ড গজায়।

বৈশিষ্ট্য:

লজ্জাবতী গাছ লতানো মাটিতে গড়িয়ে বেড়িয়ে যায়। গায়ের নিচের দিকে বাকাবাকা কাটা রয়েছে। পাতা স্পর্শপ্রবণ।

পাতায় স্পর্শ করার সাথে সাথেই ছোট ছোট পাতাগুলিসহ পত্রদন্ড চারটি একটির সাথে অন্যটি জুড়ে যায়।

মূলত সিসমোন্যাস্টিক চলন(Seismonastic Movement)এর প্রভাবেই লজ্জা পাতা বন্ধ হয়ে যায়।

এই দৃশ্য দেখলে মনে হয় যেন উদ্ভিদটি করজোড় করছে-তাই এর অন্য নাম করপত্রাঞ্জলি বা অঞ্জলিকারিমা।

স্পর্শের সঙ্গে সঙ্গে ছড়ানো পাতা বন্ধ হয়ে যায়
স্পর্শের সঙ্গে সঙ্গে ছড়ানো পাতা বন্ধ হয়ে যায়
  • লজ্জাবতী ফুল:

লজ্জাবতীর পুষ্পদন্ড ২-৩ সে.মি. মত লম্বা হয়। এ দন্ডের অগ্রভাগে গোলাকৃতি তুলার মতো নরম, হালকা বেগুনি রঙের ফুল জন্মায়।

  • ফল এবং বীজ:

প্রতিটি পুস্পদন্ডের অগ্রভাগে ১৪-২০টি করে ফল শুঁটি এবং প্রতি শুঁটিতে বা ফলে ২/৩টি বীজ পাওয়া যায়।

ফলের দুই প্রান্ত ঘিরে ছোট ছোট নরম কাঁটা বিদ্যমান। ফলের বীজ পেকে গেলে তা খয়েরি রং ধারণ করে।

ফুল ও ফল বছরের সকল সময় জন্মালেও সাধারণত জুলাই-ডিসেন্বর মাসের মধ্যে ফুল ও ফল অধিক জন্মায়।

বংশবিস্তার:

লজ্জাবতী গাছ মূলত বীজ দ্বারা বংশবৃদ্ধি করে থাকে।

তাবে বীজ দ্বারা এ প্রজাতির উদ্ভিদ বংশবিস্তার করলেও অঙ্গজভাবেও এর বংশবিস্তার সম্ভব।

লজ্জাবতী গাছের উপকারীতা:

লজ্জাবতী গাছ মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে।

এছাড়াও গবাদি পশুর খাদ্য হিসেবে এই উদ্ভিদ ব্যবহার করা হয়।

মালয়েশিয়ায় মহিষের খাদ্য হিসেবে জায়ান্ট মাইমোসার ব্যবহার প্রচলণ রয়েছে।

তাই বাংলাদেশেও তা মহিষের খাবার বা ফডার হিসেবে চাষের ব্যবস্থা নেয়া যায়।

আরো পড়ুন:
কচুরিপানা উদ্ভিদ
বেতগাছ
মাশরুম উদ্ভিদ

থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়ায় ও কিছু আফ্রিকান দেশে সবজি হিসেবে লজ্জাবতী গাছ খাওয়াও হয়।

আফ্রিকার অনেক অধিবাসী চা-কফির বিকল্পে লজ্জাবতী পান করে থাকে। আর তাই চট্টগ্রামের হাতে-গোণা কিছু ব্যবসায়ী আমাদের দেশের লজ্জাবতীর লতা-পাতা সংগ্রহ করে তা শুকিয়ে বিদেশে রপ্তানি করে থাকে।

সবচেয়ে বড় কথা লজ্জাবতী গাছ প্রচুর ঔষধীগুণ সম্বলিত একটি উদ্ভিদ।

  • ঔষধী গুণাগুণ:

লজ্জাবতী গাছের ঔষধি গুণাগুণ অত্যন্ত বেশি। বিভিন্ন প্রকার রোগের চিকিৎসায় হারবাল মেডিসিন তৈরিতে এই উদ্ভিদের ব্যবহার যুগযুগ ধরে চলে আসছে।

এর কয়েকটি গুণাগুণ হলো-

লজ্জাবতী গাছে tannin রয়েছে। তাই পুরানো ঘায়ে লজ্জাবতীর ক্বাথ একটু ঘন করে দিনে ৩/৪ বার কয়েকদিন ব্যবহার করলে ঘা ভাল হয়ে যাবে।

. লজ্জাবতী গাছের পাতা বেটে হাইড্রোসিল-এ প্রলেপ দেওয়া যায়।

. কানে পুঁজ হলে লজ্জাবতী গাছ সিদ্ধ করে, ঐ ক্বাথ সহ তেল গরম করে তা কানে দিলে পুঁজ পড়া বন্ধ হবে এবং ক্ষত সেরে যাবে।

   ৪. অনেকের ঘামে দুর্গন্ধ হয় এবং জামায় বা গেঞ্জিতে হলদে দাগ লাগে, এক্ষেত্রে লজ্জাবতী গাছের ডাঁটা এবং পাতার ক্বাথ তৈরী করে বগল ও শরীরে লাগালে এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।

অনেক দেশে লজ্জাবতী গাছ চাষ করে একে উপকারী উদ্ভিদে পরিণত করেছে। বিশেষ প্রয়োজনে লজ্জাবতী চাষাবাদে চাষীদের আগ্রহ প্রতিনিয়তই বাড়ছে।

তাই আমাদের দেশেও এ সম্পর্কে কৃষকদের ধারণা যেওয়া উচিত।

মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি, আগাছা দমন, ভূমিক্ষয় রোধ, ঔষধি ও সবজি হিসেবে ব্যবহার, সুফল আহরণ এসকল কারণে অতি সম্ভাবনাময়ী এই উদ্ভিদ সম্প্রসারণ ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট সবারই প্রচেষ্টা নেয়া অত্যাবশ্যক।

curious

শেয়ার করুন -

উত্তর দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার নাম লিখুন