মাশরুম উদ্ভিদ চিনে না পৃথিবীতে এমন মানুষ মনে হয়ে খুব কমই পাওয়া যাবে। উদ্ভিদ হিসেবে তো বটেই খাদ্য হিসেবেও গোটা বিশ্বে মাশরুমের ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে।
আজ আমরা বিশদ জানবো অতি জনপ্রিয় মাশরুম উদ্ভিদ সম্পর্কে-
মাশরুমের ইংরেজি নাম Mushroom. মাশরুম উদ্ভিদ ব্যাঙের ছাতার মত দেখতে হলেও দুটির মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। মূলত এটি একটি ছত্রাক।
বৈজ্ঞানিক নাম:
মাশরুম উদ্ভিদের বৈজ্ঞানিক নাম Calocybe indica।
পরিবার:
মাশরুম উদ্ভিদ Tricholomataceae পরিবারভূক্ত
পর্ব বা গোত্র:
মাশরুম ছত্রাক গোত্রের অপুষ্পক উদ্ভিদ। অধিকাংশ মাশরুমই ব্যাসিডিওমাইকোটা এবং কিছু কিছু অ্যাসকোমাইকোটার অন্তর্ভুক্ত।
খাদ্যগ্রহণ প্রকৃয়া:
অন্যান্য উদ্ভিদের মত মাশরুম সালোকসশ্লেষণ প্রকৃয়ার মাধ্যমে খাদ্য তৈরি করে না। খাদ্য তৈরি করতে এদের সূর্যের আলোর প্রয়োজন পরে না।
প্রকারভেদ:
মাশরুমের বেশ কিছু প্রকারভেদ রয়েছে। যেমন-
এগারিক্স- এধরনের মাশরুম উদ্ভিদ খাবার উপযোগী আবার একইসাথে বিষাক্ত ও মাদক প্রকৃতিরও হয়ে থাকে।
বোলেটস- এধরনের মাশরুমের বেশিরভাগই খাবার উপযোগী। এবং অনেকেই একে সুস্বাদু খাদ্য রুপে বিবেচনা করেন।
ব্রাকেট ফাঙ্গি
চান্টারেলেস
কোরাল ফাঙ্গি
কাপ ফাঙ্গি
জেলি ফাঙ্গি
পলিপোরেস
সাইকেডেলিক- এই মাশরুম শ্রুমস নামেও পরিচিত।
পাফবলস
স্টিঙ্কহর্নস
টুথ ফাঙ্গি-বিষাক্ত প্রকৃতির
বৈশিষ্ট্য:
মাশরুম উদ্ভিদ একদিকে যেমন খুব দ্রুত বৃদ্ধি ও প্রসার পায়, অন্যদিকে আবার খুব দেরিতেও বাড়ে।
অনেক মাশরুম উদ্ভিদ দেখা যায় এক রাতের মধ্যেই পরিণত হয়ে গেছে। তবে অধিকাংশ মাশরুম উদ্ভিদই ধীরে ধীরে বৃ্দ্ধি পায়।
দৈহিক গঠন:
পৃথিবীর বেশিরভাগ মাশরুম উদ্ভিদ এর একটি দন্ড এবং একটি ছাতার ন্যায় টুপি থাকে।
আবাদকৃত মাশরুম আকারে ক্ষুদ্রাকৃতির হয়ে থাকে। কিছু কিছু সময় এই ছত্রাকজাতীয় অপুষ্পক উদ্ভিদের নিন্মাংশে বীজ কিংবা অঙ্কুর থাকে।
খাদ্য হিসেবে মাশরুম:
প্রাকৃতিক ভাবে যেসব মাশরুম উদ্ভিদ জন্মায় সেসবই কিন্তু খাওয়া যায়না। কারণ তাদের বেশিরভাগিই বিষাক্ত। তবে শুধুমাত্র প্রাকৃতিক ভাবে উৎপন্ন মাশরুম দ্বারা মানুষের চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়।
পৃথিবীতে প্রায় ৩ লক্ষ প্রজাতির মাশরুম রয়েছে। তাদের মধ্যে মাত্র ১০ হাজার মাশরুমের গবেষণা হচ্ছে। এবং কিছু কিছু মাশরুম মাশরুম-চাষীরা চাষ করছে।
বন-জঙ্গল থেকে সঠিক খাবারযোগ্য মাশরুম খুঁজে বের করা অধিক কঠিন। কারণ সব মাশরুম দেখতে একইরকম।
সেজন্য মাশরুম সংগ্রহকারীকে রাসায়নিক উপাদান সম্পর্কে যথেষ্ঠ জ্ঞান রাখতে হয়।
খাবার উপযোগী মাশরুম
খাবার উপযোগী মাশরুম খামারে চাষ করা হয়। এগুলো গবেষণাগারে পরীক্ষা করা উন্নত জাতের মাশরুম। যাতে বিষকৃয়া হবার ভয় নেই।
তবে বিশ্বের অনেক স্থানের মানুষই শৈশবকাল থেকে বুনো মাশরুম খেয়ে অভ্যস্থ।
মাশরুম চাষের ইতিহাস এবং বাংলাদেশে মাশরুম চাষ:
মাশরুম চাষের কথা প্রাচীন গ্রিক, রোম এবং ভারতীয় সাহিত্য থেকে পাওয়া যায়। মাশরুমকে প্রাচীনকালের রাজা-বাদশাহদের একটি লোভনীয় খাদ্য হিসেবে বর্ণিত হয়েছে।
চীন, কোরিয়া,জাপান এবং ইউরোপীয় দেশগুলোয় মাশরুমের ব্যবহার বেশি।
বিশ শতকের শুরুর দিকে ইউরোপে প্রথম বাণিজ্যিক ভাবে মাশরুমের চাষ শুরু হয়। তবে বাংলাদেশে মাশরুম চাষ শুরু হয়েছে অতি সম্প্রতি।
বিগত শতকে আশির দশকের প্রারম্ভের দিকে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের উদ্যোগে মাশরুমের চাষ আরম্ভ হয়।
তারপর সাভারে ‘মাশরুম চাষ কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠিত হয়। চাষের জন্য অনুমোদিত উপযোগী প্রজাতিগুলি হলো, White button mushroom (Agaricus bisporus) এবং Oyster mushroom/Wood fungus (Pleurotis sajor-caju, P. flabellatus, P. ostreatus).
বাংলাদেশে অয়েস্টার প্রজাতির মাশরুম সহজলভ্য এবং অধিক জনপ্রিয়।
মাশরুম চাষ পদ্ধতি:
মাশরুম চাষের মূল উপাদান ধানের খড়, তুষ, করাতের গুঁড়া, তুলার বর্জ্য এবং আরও অন্যান্য কৃষিজ উপজাতের সংমিশ্রণ।
মাশরুম চাষ করতে বিরাট জায়গা-জমির প্রয়োজন হয় না, পাকাঘর অথবা কুঁড়েঘরে পলিথিনেই চাষ করা যায়।
পুরো প্রস্ত্ততিতে নিতে প্রয়োজন সর্বমোট ৩৫দিন। বীজ বপনের ১০-১৫ দিনের মধ্যেই ফসল উত্তোলন করা যায়।
মাশরুম পুরোবছর জুড়ে চাষ করা যায়, তবে অয়েস্টার প্রজাতের মাশরুম শুধুমাত্র শীতকালে চাষযোগ্য।
নির্ভুল প্রজাতির মাশরুম চাষের জন্য সর্বপ্রথম যে উপাদান অত্যাবশ্যক তা হলো, রেণুবীজ (spore)।
প্রথম দিকে তাপমাত্রা ২০°-২৫°সে এবং পরে ছাতা ওঠার সময় ১০°-১৮°সে হলে ভালো প্রজাতির মাশরুম উৎপাদন করা যায়।
আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো মাশরুমের ছাতাটি ছড়ানোর আগেই ফসল তোলা যায়।
একটি চাষযোগ্য পলিথিন থেকে অবিরাম দুই সপ্তাহ পর্যন্ত ফসল পাওয়া সম্ভব। শুধুমাত্র চাষকৃত পলিথিনটি কিছুটা পুনরাবর্তন করলেই চলে।
ধানের খড়ে যে মাশরুম (Volvariella diplasia, V. ualvacea, V. esculanta) চাষ করা হয় যেগুরৈা গ্রীষ্মকালীন প্রজাতি।
গ্রীষ্মকালীন মাশরুম চাষ পদ্ধতি অয়েস্টার প্রজাতির মতোই, তবে এই প্রজাতির তাপমাত্রার চাহিদা ভিন্নতর। শুরুর দিকে তাপমাত্রা ৩৫°-৪০°সে এবং ছাতা গঠনের সময় ৩০°-৩৫°সে রাখা আবশ্যক।
মাশরুম দুইভাবে সংরক্ষণ করা যায়। তাজা এবং শুকনো। তাজা মাশরুম রান্না করে কিংবা শুকিয়ে বিভিন্ন ভাবে খাওয়া যায়।
কাচা অবস্থায় মাশরুমে ভিটামিন বি খাদ্যপ্রাণ থাকে যাতে রিবোফ্লবিন, নায়াসিন এবং পেন্টোথেনিক এসিড থাকে। এছাড়াও আরও বিভিন্ন প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান যেমন-সেলেনিয়াম, কপার এবং ক্যালসিয়াম থাকে।
কাচা অবস্থায় মাশরুমে স্বল্প পরিমাণে ক্যালরি থাকে বলে বেশি সমাদৃত। এছাড়াও মাশরুমে চর্বি,শর্করা এবং ক্যালরীযুক্ত উপাদানের মাত্রা কম।
মাশরুম হৃদরোগ নিরাময়ে সহায়ক। এছাড়াও মাশরুমে রয়েছে কোলেস্টেরল কমানোর অন্যতম উপাদান ইরিটাডেনিন, লোভাস্টটিন, এ টাডেনিন, কিটিন। যা নিয়মিত খেলে উচ্চ রক্তচাপও নিরাময় হয়।
মাশরুম নিরামিষ প্রকৃতির, তাই নিরামিষ বিশ্বে মাংস হিসেবে সুপরিচিত।
বর্তমানে বাংলাদেশ সহ বিশ্বে প্রায় সব জায়গাতেই মাশরুমের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। খাবার হিসেবে এটি যেমন সুস্বাদু আবার পুষ্টিকরও।
অন্যদিকে আবার মাশরুম উৎপাদনও বেশ সহজ এবং কম সময়ের। যার কারণে এটি এখন একটি লাভজনক ব্যবসায় হিসেবে বিবেচিত। এখন মাশরুম চাষ করে অনেক ব্যাবসায়ীরাই নিজেদের ভাগ্য ফেরাতে পারছেন।