বিশ্বের সবচাইতে বড় মহাবন আমাজন

বিশ্বের সবচাইতে বড় মহাবন আমাজন
বিশ্বের সবচাইতে বড় মহাবন আমাজন

আমরা যতই চাঁদ বা মহাকাশ জয় করিনা কেন পৃথিবীর এখনো অনেক রহস্য রয়েগিয়েছে যা আমাদের অজানা। ঠিক এমনি এক রহস্য হচ্ছে মহাবন আমাজন। যাকে অন্য অর্থে পৃথিবীর ফুসফুসো বলা হয়

আজ আমরা জানতে চলেছি  সমগ্র পৃথিবীতে রেইন ফরেস্ট বলে পরিচিত আমাজন বন সম্পর্কে।

উৎপত্তির ইতিহাস:

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বন হলো আমাজন। যা দক্ষিণ আমেরিকায় অবস্থিত। বিভিন্ন দিক থেকে এই মহাবন আমাজন অন্য সাধারন বন থেকে আলাদা হওয়ায় একে বিশ্বের প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম একটি হিসেবেও ধরা হয়ে থাকে।

 আমাজন বন উৎপত্তি হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ৫ কোটি বছর আগে, ইওসিন (Eocene) যুগে। সেই সময় আমাজন বেষ্টিত পুরো এলাকা উষ্ণ এবং আর্দ্র জলবায়ু থাকায় আমাজন বনের আবির্ভাব ঘটে। এই আমাজন বনের আয়তন প্রায় ৫৫ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার।

অবস্থান:

মহাবন আমাজন অরণ্য দক্ষিণ আমেরিকার প্রায় সিংহভাগ অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত। ৯ টি দেশের প্রায় ৭০ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে রয়েছে মহাবন আমাজন।

এই ৯ টি দেশের মধ্যে আবার বেশির ভাগ বেষ্টিত ব্রাজিল জুড়ে। আমাজন বনের মোট আয়তনের প্রায় ৬০ শতাংশই ব্রাজিলে অবস্থিত।

এছাড়াও বাকি অংশগুলো অন্যান্য বিভিন্ন দেশে অবস্থিত। যেমন পেরুতে ১৩ শতাংশ কলম্বিয়াতে , ১০ শতাংশ

এবং অন্যান্য ১৭ শতাংশ বনান্ঞল বাকি ৬টি দেশ বলিভিয়া, ভেনেজুয়েলা, ইকুয়েডর, গায়ানা, সুরিনাম এবং ফরাসি গায়ানায় অবস্থিত।

জলবায়ু:

আমাজন জঙ্গলের মোট ৭০ লক্ষ বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে ৫৫ লক্ষই আর্দ্র জলবায়ু দ্বারা প্রভাবিত। যে কারনে একে রেইন ফরেস্ট নামেও ডাকা হয়।

যদিও রেইন ফরেস্ট মানে এই নয়জে এই বনে সর্বোদাই বৃষ্টিপাত হয়। বরং একে রেইন ফরেস্ট বলা হয় এখানকার অত্যাধিক আদ্রোতা বৃষ্টিপাত এবং গরম আবহাওয়ার কারনে।

আমাজন নদী:

আমাজন বনের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত নদী গুল আমাজন নদী হিসেবে পরিচিত। পেরুর আন্দিজ পর্বতমালার ব্রাজিল অংশের নেভাদো মিসমি নামক চূড়া আমাজন নদীর উৎপত্তিস্থল।

আমাজন নদী পৃথিবীর দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী। নদীটি বিশ্বের যেকোনো নদীর তুলনায় বেশি পানি ধারণ করার ক্ষমতা রাখে।

প্রায় এক হাজারটি উপনদী মিলিত হয়ে আমাজানের বিশাল নদী সৃষ্ট। এসব উপনদী গুলোই বনের জীবনীশক্তি।

এখানে প্রধান যেকয়টি উপনদী রয়েছে, তাদের মধ্যে ১৭ টি নদীর দৈর্ঘ্য ১ হাজার মাইলেরও বেশি।

এসব নদীগুলোকে বনের ভিতর ‍দিয়ে যাতায়াতের জন্য কার্যকরি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

আমাজন নদী সর্বশেষ আটলান্টিক মহাসাগরে গিয়ে মিলিত হয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার প্রায় ৩ হাজার মাইল পারি দিয়ে এটি আটলান্টিকে মিশেছে।

আমাজন নদী যেখানে সাগরে গিয়ে মিশেছে সেখানে প্রতি সেকেন্ডে ৪২ লক্ষ ঘন ফুট পানি সাগরে পতিত হয়।

বর্ষা মৌসুমে এর পরিমাণ প্রায় ৭০ লক্ষ ঘনফুটে স্থির হয়। এছাড়াও এ নদীটি বৈশ্বিক পানির প্রায় ২০ ভাগ পানি সাগরে বহন করে থাকে বলে জানা যায়।

বৃক্ষরাজি:

জীব বৈচিত্রময় আমাজন মহাবনে ৪০ হাজার প্রজাতির প্রায় ৩ হাজার ৯শ কোটি বৃক্ষ রয়েছে। যার মধ্যে সবচাইতে উচু বৃক্ষের দৈর্ঘ হচ্ছে ১২০ ফুট।

পৃথিবীর মোট অক্সিজেনের ২৫ শতাংশই উৎপাদিত হয় আমাজন বন থেকে। সেই সাথে এটি বাতাস থেকে বিপুল পরিমান কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে। এ কারণে আমাজন বনকে পৃথিবীর ফুসফুস বলা হয়।

এখানে রয়েছে মাংসখেকো ‍উদ্ভিদ। যেটা বিভিন্ন পোকা অথবা মাছি শিকারের মাধ্যমে নিজের জীবনীশক্তি বৃদ্ধি করে।

আমাজনের অতিকায় প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে ভিক্টোরিয়া আমাজনিয়া নামে এক প্রকারের জলপদ্ম। ইংল্যান্ডের রাণী ভিক্টোরিয়ার নামে এই বৃক্ষের নামকরণ করা হয়।

ভিক্টোরিয়া আমাজনিয়া জলপদ্ম
আমাজনে অবস্থিত ভিক্টোরিয়া আমাজনিয়া জল পদ্ম

যেই  পদ্মপাতা গুলোর আয়তন প্রায় ৩ মিটার। এছাড়াও এই জঙ্গলে রাবার গাছ সহ বিশাল বিশাল উদ্ভিদ থেকে শুরু করে ছোট্ট গুল্ম লতাও রয়েছে।

প্রাণীকূল:

আকারের বিশালতার মতই আমাজন অরণ্যের প্রাণীকূলেও রয়্ছে বিভিন্ন ধরনের বৈচিতময়তা।

এই মহা অরণ্যে প্রায় ১ হাজার ৩০০ জাতের পাখি, ২ হাজার ২০০ জাতের মাছ, ৪২৭ জাতের স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৩৭৮ জাতের সরীসৃপ, ৪২৮ জাতের উভচর প্রাণী এবং ২৫ লক্ষ জাতের বিভিন্ন পোকামাকড় রয়েছে।

আমাজন বন যে শুধু সৌন্দর্য্যেই ঘেরা তা নয়। বিভিন্ন রকম প্রাণীর ভীড়ে এদের মধ্যে রয়েছে অসংখ্য বিপদজনক প্রাণীও।

বিশ্ববিখ্যাত, সবচেয়ে ভয়ংকর এবং দীর্ঘতম সাপ এ্যানাকোন্ডার বাস এই আমাজন জঙ্গলেই। এছাড়াও রয়েছে চিতাবাঘ বৈদ্যুতিক ইল, মাংসখেকো পিরানহা মাছ, বিষাক্ত ডার্ক ফ্রগ, অসংখ্য বিষাক্ত জাতের সাপ সহ নান জাতের হিংস্র প্রাণী ও বিষাক্ত পোকা।

রহস্যময়তা:

আমাজন শুধু বড় বনই নয়। বিশাল এই অরণ্যটি নানান রহস্যময়তায় ঘেরা। ব্রাজিলিয়ান আমাজনের বুকে বেশ কিছু বৃত্তাকার নকশা দেখতে পাওয়া যায়। নকশাগুলো আজও রহস্যে ঘেরা।

নৃতাত্ত্বিকগণ এখনো এই নকশার পেছনের রহস্য উদঘাটন করে চলেছে।

প্রচলিত ধারায় প্রাচীন আমাজনীয়রা এই নকশার শিল্পী ছিলেন। তবে এই নকশা গুলো কি দিয়ে আঁকা হয়েছিল, গবেষণা করেও তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।

প্রাপ্ত তথ্য গুলো বিশ্লেষণ করে উদঘাটন করা যায় এই নকশাগুলো ১২০০ থেকে ১৫০০ বছর আগে তৈরি করা হয়েছিল।

তবে এগুলো কেন তৈরি করা হয়েছিল সে সম্পর্কেও কোনো স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয়, প্রাচীনকালে নকশা গুলো সমাধি অথবা সুরক্ষাক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

এই আমাজন বনের মধ্যে এমনো স্থান রয়েছে যেখানে ঘন বন হবার কারনে দিনের বেলাতেও সূর্যের আলো উক্ত স্থানে পৌছাতে পারেনি।

মহাবন আমাজন এর রহস্যময়তার আরও একটি বড় উদাহরণ হচ্ছে ফুটন্ত নদী।

এই নদীর পানি অত্যন্ত উষ্ণ। এর তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৯৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত হতে পারে।

কেন এই নদীর পানি এত উত্তপ্ত তার কারণ বিজ্ঞানীরা এখনো ব্যাখ্যা করতে পারেনি।

উপজাতি:

মহাবন আমাজন অরণ্যে বিভিন্ন উপজাতির বাস অতি প্রাচীন কাল থেকেই লক্ষ করা যায়। এই বনে প্রায় ৩০০ এরও বেশি উপজাতি বাস করে।

এই বনে মোট ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে প্রায় ১০লাখেরও বেশি মানুষ। এদের বেশির ভাগই ব্রাজিলীয় বংশভূত।

এক জরিপে জানা যায় বর্তমানে প্রায় ২ কেটির বেশি জাতির ও সমাজের আদিবাসী মানব আমাজন জঙ্গলের ভেতর বাস করে।

এদের নিজস্ব ভাষা রয়েছে। তাছাড়া এদের মধ্যে ভারতীয়, পর্তুগীজ, স্প্যানিস ইত্যাদি গোষ্ঠীও রয়েছে।

আরো পড়ুন - 
পৃথিবির যে স্থানে কখনই বৃষ্টি হয়নি
টাইটানিক জাহান ডুবে জাবার অদ্ভুত এক কারন

আমাজনে বসবাসরত বেশিরভাগ জনগোষ্ঠী তাদের আবাস স্থল হিসেবে বেছে নিয়েছে বিভিন্ন নদীর উপকূল। এতে তাদের যাতয়াত,জীবিকা নির্বাহ হিসেবে মাছ ধরা সুবিধাজনক ছিল। এদের মধ্যে আবার কিছু রয়েছে যাযাবর।

১৬০০ শতাব্দীতে ইউরোপিয়ানদের আগমনের ফলে আমাজনীয়ানদের সংখ্যা লোপ পেতে থাকে। তবে বর্তমানে এক গবেষণায় দেখা যায় আমাজনের ১১.৮ শতাংশ জায়গা আমাজনীয়রা ব্যবহার করছেন।

আমাজনীয় উপজাতিদের অনেকেই এখন আধুনিকতার ছোঁয়ায় নিজেদের বদলে ফেলেছেন। কিন্ত এদের মধ্যে অনেকেই রয়েছে যারা বহিঃ বিশ্বের আধুনিকতার সাথে যোগাযোগ রাখতে পছন্দ করে না।

চাষাবাদ:

মহাবন আমাজন এর মাটিতে খুব বেশি আবাদী জমি নেই। পূর্বে প্রাচীন পদ্ধতিতে আমাজনের জমিতে চাষ করা হতো। কিন্ত আমাজনের জমি গুলো বছরের অল্প সময় উর্বর থাকে। এজন্য এখন চাষিদের নতুন জমির খোজে বনের বিভিন্ন প্রান্তে যেতে হয়।

পরিবেশ বিপর্যয়:

১৯৬০ সালের আগে আমাজন জঙ্গলে প্রবেশাধিকার ছিল না। তখন বনের পরিবেশ ছিল স্বাভাবিক।

১৯৭০ সালের দিকে ট্রান্স আমাজনিয়া হাইওয়ের কাজ শুরু হয়। কিন্ত আমাজনের হুমকির কারণ হওয়ায় এর কাজ বন্ধ হয়ে যায়।

এরপরও ১৯৯০ সালের মধ্যে আমাজনের ৪ লক্ষ বর্গকিলোমিটার বনভূমি ধ্বংশ করা হয়।

২০০০ সালের মধ্যে বন উজারের পরিমাণ গড়ায় ৫ লক্ষ ৮৭ হাজার বর্গকিলোমিটারে।

এছাড়াও এই বছরের শুরুর দিকে বেশ কয়েকদিন যাবত আমাজন বনে লেগে থাকা আগুনের বিষয় সম্পর্কে হয়তো আপনারা সকলেই অবগত রয়েছেন যেখনে প্রায় মাইলকে মাইল বন আগুনে পুরে ধংশ হয়ে গিয়েছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের একজন বিজ্ঞানী আশঙ্কা প্রকাশ করছেন মহাবন আমাজন আগামী ৫০ বছরের মধ্যে বিলীন হয়ে যেতে পারে। তার মতে জটিল প্রতিক্রিয়া নামক পরিবেশ সম্পর্কিত প্রক্রিয়ায় এমনটা ঘটতে পারে।

অপরিকল্পিত বন নিধন এই বিশাল অরণ্য তথা পুরো বিশ্বের জন্যও হুমকি সরুপ। এর ফলাফল বিশ্ব উষ্ণায়নেও পরিবেশে বিরূপ প্রভাব পরবে। সেই সাথে পৃথিবীর ফুস ফুস তথা আমাজন বন ধিরে ধিরে নিস্তেজ হয়ে যাবে।

curious

শেয়ার করুন -

১ মন্তব্য

  1. আমাজন বনের পাশ দিয়ে বয়ে চলছে আমাজন নদী। এই নদী অন্য যে কোন নদীর চেয়ে বড় এবং গিয়ে মহাসাগরে পতিত হয়েছে।

উত্তর দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার নাম লিখুন