তুরস্ক দেশ – হাজারো ইতিহাসে রচিত একটি রাষ্ট্র

তুরস্ক দেশ - হাজারো ইতিহাসে রচিত একটি রাষ্ট্র
তুরস্ক দেশ -

তুরস্ক দেশ – পশ্চিম এশিয়ার বৈচিত্র্যময় সুন্দর একটি দেশ তুরষ্ক। ইতিহাস,ঐতিহ্য ও শিল্পে সমৃদ্ধ  তুরস্ক একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। এদেশ বিখ্যাত তার শিল্প সমৃদ্ধের জন্য। বিশ্বের বেশ কিছু ইতিহাস বিখ্যাত শৈল্পিক স্থাপনা রয়েছে তুরস্ক দেশে।

আজ আমাদের আলোচনার বিষয় হচ্ছে তুরষ্ক দেশ। চলুন জেনে আসা যাক তুরষ্ক সম্পর্কে কিছু তথ্য।

তুরষ্কের ভৌগলিক অবস্থান:

তুরস্কের মোট আয়তন ৭,৮৩,৩৩৫৬ বর্গকিলোমিটার বা ৩,০২,৪৫৫ বর্গমাইল। তুরস্ক একটি চতুর্ভুজাকৃতির দেশ।   তুরস্ক দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার আনাতোলিয়া উপদ্বীপের সম্পূর্ণ অংশ এবং দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের বলকান উপদ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তের অংশ বিশেষ নিয়ে গঠিত। এদেশটি এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে অবস্থিত।

turkey map - curious24world.com - তুরস্কের ম্যাপ
তুরস্কের ম্যাপ

মূলত তুরস্ক দেশ পশ্চিম এশিয়াতে অবস্থিত। এদেশটি উত্তর-পূর্বে জর্জিয়া,আর্মেনিয়া ও স্বায়ত্বশাসিত আজারবাইজান,নাখচিভান প্রজাতন্ত্র আর পূর্বে ইরান, দক্ষিণে ইরাক,সিরিয়া ও ভূমধ্যসাগর। তুরস্কের রয়েছে বিস্তৃত উপকূল, যা দেশটির সীমান্তের তিন-চতুর্থাংশ গঠন করেছে।

এছাড়াও  সামরিক কৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তিনটি জলপথ এশীয় ও ইউরোপীয় তুরস্ককে পৃথক করেছে এরা হল মার্মারা সাগর,বসফরাস প্রণালী ও দার্দানেলেস প্রণালী। যা একত্রে কৃষ্ণ সাগর থেকে এজীয় সাগরে যাবার পথ তৈরি করেছে।

তুরষ্কের নাম করণের ইতিহাস:

তুরস্ক নামটি এসেছে মধ্য লাতিন ‘তুর্চিয়া’ থেকে তুর্চিয়া অর্থ তুর্কিদের দেশ।

তুরষ্কের ইতিহাস:

তুরস্কের রয়েছে একটি সুদীর্ঘ -সমৃদ্ধ ও ঘটনাবহুল  ইতিহাস।  প্রাচীনকাল থেকে বহু বিচিত্র জাতি ও সংস্কৃতির লোক এখানে বসবাস করে আসছে।  ১৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে এখানে বাস করত হিটাইট জাতি। তাদের সময়েই এখানে প্রথম বড় শহর গড়ে ওঠে।

এরপর বিভিন্ন সময়ে এখানে ফ্রিজীয়,গ্রিক,পারসিক,রোমান ও আরবদের আগমণ ঘটে। এরপর ১১০০ শতকে এখানে এসে বাস করা শুরু করে এশিয়ার যাযাবর তুর্কিজাতি। এজাতির আগমনের মধ্যদিয়ে  এ অঞ্চলে  সেলজুক রাজবংশের সূচনা হয়। তাদের শাসনের মাধ্যমেই এই অঞ্চলের জনগণ তুর্কি ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে মিশে যায়।

১৩শ শতকে মোঙ্গলদের আক্রমণের ফলে সেলজুক রাজবংশের পতন ঘটে। ১৩ শতকের শেষ দিকে এখানে উসমানীয় সাম্রাজ্যের সুচনা হলে এরা পরবর্তী ৬০০ বছর তুরস্ক শাসন করে এবং আনাতোলিয়া ছাড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্য ও পূর্ব ইউরোপ এবং উত্তর আফ্রিকার এক বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃতি লাভ করে।

১৯২৩ সালে মুস্তাফা কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতন হয় ও তুর্কিভাষী এলাকা আনাতোলিয়া ও পূর্ব থ্রাস নিয়ে আধুনিক তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯৩৮ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আতাতুর্ক তুরস্কের রাষ্ট্রপতি ছিলেন।

তিনি একটি শক্তিশালী, আধুনিক ইউরোপীয় রাষ্ট্র হিসেবে তুরস্কের পরিচয় প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তার সরকারের মূলনীতিগুলি কামালবাদ নামে পরিচিত এবং এগুলি পরবর্তী সমস্ত তুরস্ক সরকারের জন্য নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করেছে। আতাতুর্কের একটি বিতর্কিত মূলনীতি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। আর এভাবেই যাত্রা শুরু হয় একটি আধুনিক তুরস্কের।

১৯৪৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি দেশটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেয়। যুদ্ধের পর দেশটি জাতিসংঘের ও ন্যাটোতে যোগ দেয়। এ সময় থেকে তুরস্কে বহুদলীয় রাজনীতির প্রবর্তন হয়। ১৯৬০ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করে। ফলে ১৯৬০, ১৯৭১ ও ১৯৮০ সালে তুরস্কে সামরিক অভ্যুত্থান হতে দেখা যায়।

দেশটিতে সর্বশেষ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে ১৯৯৭ সালে। কিন্তু পরে আবার দেশটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে আসে। কিন্তু ২০১৩ সালের বিক্ষোভ ও ২০১৫সালে সুরুক বোমা হামল পুনরায় অস্থিরতার জন্ম দেয়। সর্বশেষ ২০১৬ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করা হয় তবে শেষ পর্যন্ত তুর্কি জনগনের ব্যাপক প্রতিরোধের মুখে তা ব্যর্থ হয়। বর্তমানে দেশটিতে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একটি সরকার রয়েছে।

turkey - তুরস্ক দেশ
তুরস্ক দেশ

তুরস্কের অর্থনীতি:

তুরস্ক দেশ হচ্ছে একটি কৃষিপ্রধান দেশ। বর্তমানে কৃষিখামার তুরস্কের অর্থনীতির একটি বড় অংশ এবং দেশের শ্রমশক্তির ৩৪% এই কাজে নিয়োজিত। তবে বর্তমানে দেশটির সেবা খাতে অনেক প্রসার ঘটেছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সাথে এদেশটির কৃষিকাজের পরিমানও কমেছে।

১৯৯৪ সালের অর্থনৈতিক মন্দার ও ১৯৯৯ সালে ভয়াবহ ভূমিকম্পের ফলে তুরস্কের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা লাগে। এসব সমস্যার কারণে ১৯৮১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ৪ শতাংশ। ২০০১ সালের সৃষ্ট অর্থনৈতিক সমস্যার পর নতুন করে সংস্কার কর্মসূচি শুরু করেন অর্থমন্ত্রী কামাল দারবিশ।

তার সংস্কারের ফলে মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্ব অনেক কমে যায়। তুরস্ক তার বাজার ধীরে ধীরে মুক্ত করতে শুরু করে। ২০০২ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত প্রবৃদ্ধির হার ছিল গড়ে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০০৮ সালে দেশটির প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০০৯ সালে আবার বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার ধাক্কা লাগে তুরস্কের অর্থনীতিতে। বর্তমানে এদেশটি উন্নত অর্থনীতির একটি দেশ।

তুরস্কের রাজনীতি:

তুরস্ক দেশ একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কাঠামো ভিত্তিক রাষ্ট্র। এরাষ্ট্রের সরকার প্রধান হলেন প্রধানমন্ত্রী। রাষ্ট্রের যাবতীয় নির্বাহী ক্ষমতা সরকারের উপর ন্যস্ত। সরকার এবং আইনসভা উভয়ের  উপর ন্যস্ত আইন প্রণয়নের ক্ষমতা।

তুরস্কে ৫৫০ আসন বিশিষ্ট একটি সংসদ আছে, যার সদস্যরা ৫ বছরের জন্য জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার গঠন করে এবং সংসদ সদস্যরা রাষ্ট্রপতিকে ৫ বছরের জন্য নির্বাচিত করেন। রিসেপ তায়িপ এরদোয়ান এ দেশটির বর্তমান রাষ্ট্রপতি এছাড়াও তুরস্কের  প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন  বিনালি ইলদিরিম।

তুরস্কের প্রদেশ:

তুরস্কে ৮১ টি প্রদেশ রয়েছে। প্রতিটি প্রদেশের নামই সেই প্রদেশের রাজধানীর নামকরণ করা হয়। আর প্রতিটি প্রাদেশিক রাজধানী সংশ্লিষ্ট প্রদেশের কেন্দ্রীয় জেলা। তুরস্ক দেশটির সবচাইতে বড় শহর ইস্তাম্বুল।

আঙ্কারা হল তুরস্কের রাজধানী শহর। এটি হচ্ছে তুরস্কের বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রবিন্দু। প্রতিটি প্রদেশ কয়েকটি করে জেলায় বিভক্ত করা হয় এবং ৮১ টি প্রদেশ কে সাতটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। তুরস্কে মোট জেলা রয়েছে ৯২৩টি।

আরো পড়ুন -    

হায়া সোফিয়া মসজিদ এবং তার ইতিহাস 
তুরস্কের টিভি সিরিজ দিরিলিজ আরতুগ্রুল 
ইন্টারনেটে ভাইরাল হওয়া তুর্কি পাঁচক - সল্ট ব্যয় 

জনসংখ্যা:

তুরস্কের মোট জনসংখ্যা হল ৭৯,৪৬৩,৬৬৩ জন।  জনগণের প্রায় ৭০ দশমিক ৫ শতাংশ লোক শহরে বসবাস করে। বেশির ভাগই মুসলিম ধর্মালম্বী। সিআইএ ফ্যাক্টবুক অনুসারে তুর্কি পুরুষের গড় আয়ু ৭০ দশমিক ৬৭ বছর ও মহিলাদের গড় আয়ু ৭৫ দশমিক ৭৩ বছর।

মোট জনসংখ্যার গড় আয়ু ৭৩ দশমিক ১৪ বছর। তুর্কি সংবিধানের ৬৬ নম্বর আর্টিক্যাল অনুসারে, ‘তুরস্কের নাগরিকত্ব যাদের আছে তারাই তুর্কি বলে পরিচিত।

ভাষা:

তুরস্কের সরকারি ভাষা  হচ্ছে তুর্কি ভাষা। এখানকার প্রায় ৯০% লোক তুর্কি ভাষাতে কথা বলেন। এছাড়াও এখানে  আদিগে,আরবি,আর্মেনীয়,আজারবাইজানি,জর্জীয়,কুর্দি সহ মোট ৩০টি ভাষা প্রচলিত রয়েছে তবে আন্তর্জাতিকভাবে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করা হয়।

শিক্ষা:

তুরস্কে গড় শিক্ষার হার ৮৭ দশমিক ৪ শতাংশ। ৬ থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশুদের জন্য শিক্ষা বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক। শিক্ষার হার পুরুষের ৯৫ দশমিক ৩ শতাংশ ও নারীদের ৭৯ দশমিক ৬ শতাংশ। ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয় তুরস্কের প্রথম প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়।

তুরষ্কের দর্শনীয় স্থান:

শিল্প-সভ্যতার এক বিচিত্র সৌন্দর্য্যমন্ডিত দেশ হচ্ছে তুরস্ক। তুরস্কে রয়েছে বিশ্বের বিখ্যাত কিছু ঐতিহাসিক স্থাপনা যার মধ্যে কিছু স্থাপনা তুলে ধরা হল:

হায়া সোফিয়া:

তুরস্কের অন্যতম বিখ্যাত ও সৌন্দর্যমন্ডিত স্থাপত্য নিদর্শন হল হায়া সোফিয়া। ১৫৩২ খ্রিস্টাব্দের এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটি একসময় গির্জা হিসাবে ব্যবহৃত হত। প্রায় ১০০০ বছর ধরে এটি গির্জা থাকার পর এটি একটি মসজিদে রূপান্তরিত করা হয় কিন্তু ১৯৩৫ সালে পুনরায় এ স্থাপনাকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করেন আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা কামাল আতাতুর্ক।

তুরস্ক দেশ - হাজারো ইতিহাসে রচিত একটি রাষ্ট্র
তুরস্ক দেশর হায়া সোফিয়া মসজিদটির রাতের দৃশ্য

এ স্থাপনাটির গম্বুজে ৪০টি জানালা রয়েছে যা সূর্যের আলোয় এসে ভিতরে এক রহস্যময় সৌন্দর্য্যের সৃষ্টি করে। বর্তমানে ২০২০ সালে হায়া সোফিয়াকে পুনরায় মসজিদে রুপান্তর করা হয়। ইউনেস্কো’র ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তালিকায় স্থান পেয়েছিল ‘হায়া সোফিয়া’।

সুলায়মানিয়া মসজিদ:

তুরস্কের ইস্তানবুল শহরের অবস্থিত এ মসজিদটি  ইস্তানবুলের সবচেয়ে বড় মসজিদ। বাদশাহ সুলাইমান এই মসজিদটি নির্মাণ করিয়েছিলেন বলেই তার নামে এর নামকরণ করা হয়েছে সুলায়মানিয়া মসজিদ।

১৫৫০ সাল থেকে ১৫৫৭ সাল পর্যন্ত বাদশাহ সুলাইমান এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। এটি পৃথিবীর প্রথম মসজিদ যেখানে প্রথমবারের মত চারটি মিনার স্থাপন করা হয়। স্থাপত্য শিল্পের অন্যতম নিদর্শন এই মসজিদের  সহজেই তার স্থাপত্যশৈলীতে সবাইকে মুগ্ধ করে। এই মসজিদটিও ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

কেপেদোসিয়া:

তুরস্কের  এই স্থানটি প্রায় তিন কোটি বছরে পুরনো একটি এলাকা যা একটি অগ্ন্যুৎপাতের ফলে সৃষ্টি হয়েছিল। কেপেদোসিয়া রোমাঞ্চ প্রিয় পর্যটকদের কাছে এটি জনপ্রিয় একটি স্থান। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি মাধ্যম হল হট এয়ার বেলুন নিয়ে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে হাজার ফুট ওপরে ভেসে বেড়ানো।

এই অসাধারণ মনোমুগ্ধকর জায়গাটিতে অনেক চলচ্চিত্রের দৃশ্য চিত্রায়িত হয়েছে। এছাড়া এই জায়গাটি ঐতিহাসিক শিল্পকর্মের জন্যও দারুণ বিখ্যাত।

curious

শেয়ার করুন -

উত্তর দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার নাম লিখুন