ইতেকাফ কি ? কিভাবে একে আদায় করতে হবে –

ইতেকাফ কি ? কিভাবে একে আদায় করতে হবে -
ইতেকাফ কি ? কিভাবে একে আদায় করতে হবে -

সৃষ্টি কর্তাকে খুশি করার জন্য আমরা নামাজ রোজা সহ বিভিন্ন ইবাদত পালন করে থাকি। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এই ইতেকাফ। আজ আমি আলোচনার করবো ইতিকাফ কি সে সম্পর্কে এছাড়াও ইতিকাফ কাকে বলে এবং ইতিকাফ কত প্রকার ও কি কি তা নিয়ে। 

ইতেকাফের সংজ্ঞা –  

শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদতের জন্য যখন কোন বান্দা দুনিয়ার অন্য সব কিছু থেকে নিজেকে আলাদা করে নিয়ে একমাত্র আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের নিরন্তর সাধনায় ঐকান্তিকভাবে মশগুল হয়ে পড়ে তখন তাকে ইতিকাফ বলে। এটি একটি মহৎ ইবাদত এবং এ ইবাদত স্বেচ্ছায় পালনীয়।

ইতিকাফ তিন প্রকার –

যথা-

১. সুন্নতঃ রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফ,

২. নফলঃ যেকোনো সময়ের ইতিকাফ,

৩. ওয়াজিবঃ মানতের ইতিকাফ।

ইতিকাফের সর্বোত্তম স্থানঃ

ইতিকাফের জন্য সর্বোত্তম স্থান হলো বাইতুল্লাহ শরিফ এবং বাইতুল্লাহ শরিফের পর মসজিদে নববি। এরপর যথাক্রমে বাইতুল মাকদিস বা মুকাদ্দাস, জুমা আদায় করা হয় এমন মসজিদ, মহল্লার যে মসজিদে নামাজির সংখ্যা বেশি হয় সে মসজিদ।

ইতিকাফের মাহাত্ম্য ও তাৎপর্যঃ

এ বিষয়ে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভি (রহ.) বলেন, মসজিদে ইতিকাফ হচ্ছে হৃদয়ের প্রশান্তি, আত্মার পবিত্রতা ও চিত্তের নিষ্কলুষতা। সেই সাথে চিন্তার পরিচ্ছন্নতা ও বিশুদ্ধতা। ইতিকাফ হলো ফেরেশতাকুলের গুণাবলি অর্জন এবং লাইলাতুল কদরের সৌভাগ্য ও কল্যাণ লাভসহ সব ধরনের ইবাদতের সুযোগ লাভের একটি সর্বোত্তম উপায়।

এ জন্য মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রাসুল (সা.) নিজে ইতিকাফ পালন করেছেন এবং তাঁর বিবিরাসহ সাহাবায়ে কেরামের অনেকেই এই সুন্নতের ওপর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমল করে গিয়েছেন। (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা : ২/৪২)

এছাড়া, ইতিকাফ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে হজরত ইবরাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.) এর কথা উল্লেখ করে ইরশাদ হয়েছে যে, ‘আমি ইবরাহিম ও ইসমাইলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী ও রুকু-সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র করো।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১২৫)। সেই সাথে ইতিকাফ সম্পর্কে হাদিস শরীফে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অসংখ্য হাদিস বর্ণিত হয়েছে।

এর মধ্যে দুটি হাদিস নিচে উল্লেখ করা হলো—

১. ইবনে উমার (রা.) থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রমজানের শেষ দশকে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইতিকাফ করতেন। (মুসলিম, হাদিস নং-১১৭১)। মদিনায় অবস্থানকালে রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতিবছরই ইতিকাফ পালন করেছেন এবং শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও তিনি রমজান মাসে ইতিকাফ ছাড়েননি।

২. আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- প্রতি রমজানের ১০ দিন রাসুলুল্লাহ (সা.) ইতিকাফ করতেন। তবে যে বছর তিনি ইন্তেকাল করেন, সে বছর তিনি ২০ দিন ইতিকাফে কাটান।’ (বুখারি, হাদিস নং-১৯০৩)।

নারীদের ইতিকাফের বিধানঃ

পুরুষদের মতো করে নারীদের জন্যও ইতিকাফ করা সুন্নত। তবে সেটি মসজিদে নয় বরং তারা তাদের ঘরে ইতিকাফ করবে। এর জন্য ঘরের যে নির্দিষ্ট নামাজঘর রয়েছে সেটিকে তারা ইতিকাফের জন্য ব্যবহার করতে পারে।

আর কারো যদি নামাজের জন্য নির্দিষ্ট নামাজঘর না থাকে তাহলে নামাজের নির্দিষ্ট স্থানকে কাপড় দিয়ে ঘেরাও করে সেখানটায় ইতিকাফের ব্যাবস্থা করা যেতে পারে। এ বিষয়ে হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজানের শেষের দশকে ইতিকাফ করেছেন ইন্তেকাল পর্যন্ত।

এরপর তাঁর স্ত্রীরা ইতিকাফ করেছেন।’ (বুখারি, হাদিস : ১৮৬৮, মুসলিম, হাদিস : ২০০৬)। আয়েশা (রা.) আরো বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রত্যেক রমজানে ইতিকাফ করতেন।’ (বুখারি, হাদিস : ২০৪১);

রমজানের প্রথম দুই দশক ও শেষ দশকের ইতিকাফের নিয়মঃ

রমজান মাসের প্রথম দশক রহমতের এবং আল্লাহ তাআলা এ দশকে তাঁর বান্দাকে রহমতের বারিধারা বর্ষণ করে মাগফিরাত ও ক্ষমার উপযোগী করেন। এরপর দ্বিতীয় দশক হলো মাগফিরাতের। এ দশকে আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের ক্ষমা করে দেন এবং তৃতীয় দশক হলো নাজাতের।

আর তৃতীয় এই দশকে আল্লাহ তার বান্দার জন্য নাজাতের ফয়সালা করেন। হাদিস শরিফে শেষ এই দশককে ‘ইতক্বুম মিনান নার’ বা জাহান্নাম থেকে মুক্তির দশক বলা হয়েছে। এছাড়া, রমজানের প্রথম দুই দশকেরও বিশেষ গুরুত্ব ও ফজিলত রয়েছে।

তবে শেষ দশকে পবিত্র শবেকদর থাকায় এ দশকের গুরুত্ব ও ফজিলত আরো অনেক গুণ বেশি। হাজার মাসের চেয়েও উত্তম এই শবেকদরের রজনী। অর্থাৎ এক হাজার মাস ইবাদত করলে যে সওয়াব হতে পারে, এই এক রাতের ইবাদতে তার চেয়েও বেশি সওয়াব পাওয়া যাবে।

এ রাতের কারণেই পুরো রমজান মাস তাৎপর্য ও ফজিলতপূর্ণ হয়েছে। তাছাড়া, রমজানের শেষ এই দশকেই অবতীর্ণ হয়েছিলো সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ পবিত্র আল কোরআন। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে যে, ‘আমি এই কিতাব অবতীর্ণ করেছি এক বরকতময় রজনীতে। অবশ্যই আমি সতর্ককারী।

রজনীতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয়।’ (সুরা : দুখান, আয়াত : ৩-৪) তাই রমজানের বিগত দিনগুলো যাদের অবহেলায় কেটে গেছে, তাদের জন্য এখনো সময় আছে নিজেকে শুধরে নেওয়ার। শেষ দশকে গুরুত্বের সঙ্গে ইতিকাফের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমি কদরের রাতের সন্ধানে প্রথম ১০ দিন ইতিকাফ করলাম। এরপর করলাম মধ্যবর্তী ১০ দিন।

অতঃপর ওহি প্রেরণ করে আমাকে জানানো হলো যে তা শেষ ১০ দিনে। সুতরাং তোমাদের যে ইতিকাফ পছন্দ করবে, সে যেন ইতিকাফ করে।’ এরপর মানুষ তাঁর সঙ্গে ইতিকাফে শরিক হয়। (মুসলিম, হাদিস : ১৯৯৪)।

 ইতিকাফের ভেঙে যাবার কারনঃ

১. শেষ দশকের সুন্নাত ইতিকাফকারীর জন্য প্রস্রাব-পায়খানাসহ মানবীয় ও শরয়ি বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া অন্য কোনো কারণে মসজিদ থেকে বের হওয়া বৈধ নয়। তাই যদি কেউ বের হয় তাহলে তার ইতিকাফ ভেঙে যাবে। সুতরাং ফরজ গোসল ছাড়া গরম ও গায়ের দুর্গন্ধের কারণে গোসল করার জন্যেও বের হওয়ার জায়েজ নেই।

তবে যদি অতীব প্রয়োজন হয় এবং মসজিদে গোসলের সুব্যবস্থা থাকে, তাহলে মসজিদেই গোসল করবে অথবা ভেজা গামছা দিয়ে শরীর মুছে ফেলবে। আর ইস্তেঞ্জা করতে গিয়ে অজু পরিমাণ স্বল্প সময়ের মধ্যে সাবান ইত্যাদি ছাড়া স্বাভাবিক গোসল করতেও কোনো অসুবিধা নেই। (রদ্দুল মুহতার : ২/৪৪০, ২/৪৪৫, আহসানুল ফাতাওয়া : ৪/৫১৫) কিন্তু যদি প্রয়োজন শেষে আধা মিনিটও দেরি করা হয়, তাহলে এতেও ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। (তহতবি : ৫৮৫; হিন্দিয়া : ১/২১২)

২. ইতিকাফকারীর জন্য জানাজা বা রোগী দেখা ইত্যাদি ক্ষেত্রে মসজিদ থেকে বের হওয়া জায়েজ নেই। তাই এসব কারণে মসজিদ থেকে বের হলেও ইতিকাফ ভেঙে যাবে। (ফাতাওয়া শামি : ২/২১৩)। তবে ইস্তেঞ্জা বা কোনো প্রয়োজনে বের হয়ে পথিমধ্যে রোগী দেখা এবং জানাজায় শরিক হওয়া জায়েজ আছে। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া : ১/২১২, মাআরিফুস সুনান : ৫/৫৪০)

৩. ইতিকাফরত অবস্থায় মেসওয়াক অথবা ব্রাশ করার জন্য মসজিদের বাইরে যাওয়া যাবে না। গেলে ইতিকাফ ভেঙে যাবে। তবে অজু করার জন্য যখন বের হবে তখন মেসওয়াক করে নিতে পারবে। কিন্তু শুধু মেসওয়াক বা ব্রাশ করার জন্য বাড়তি সময় যাতে নষ্ট না হয়। (ফাতাওয়ায়ে শামি, ৩/৪৩৯) এমনকি এ হিসাবে ফোনে কথা বলার জন্যও মসজিদ থেকে বের হওয়ার কোন অনুমতি নেই।

৪. ইতিকাফের জন্য রোজার শর্ত হলো, অসুস্থতার কারণে কারো যদি অপারগ হয়ে রোজা ভাঙতে হয়, তবে ইতিকাফও ভেঙে যাবে। (ফাতাওয়ায়ে শামি, ৩/৪৩১) এমনকি অসুস্থতার জন্য নিরুপায় হয়ে ডাক্তারের কাছে গেলেও ইতিকাফ ভেঙে যাবে। তবে অপারগতার দরুন গুনাহগার হবে না। (ফাতাওয়া কাজী খান : ১/২২৩)

ইতিকাফে যেসব কাজ করা মাকরুহঃ

ইতিকাফে যেকোনো অপ্রয়োজনীয় কাজ করাই মাকরুহ। যেমন—অনর্থক গল্প করা, বিনা প্রয়োজনে বেচাকেনা করা, মোবাইলে গেম খেলা, ফেসবুকে চ্যাট করা ইত্যাদি। এছাড়া, ব্যবসায়ী মালামাল মসজিদে নিয়ে আসা মাকরুহ। যদিও একান্ত প্রয়োজনে বেচাকেনা করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া, ইতিকাফ অবস্থায় চুপ করে বসে থাকাও কোনো ইবাদত নয়। তাই ইবাদত মনে করে চুপ করে বসে থাকাও মাকরুহ। (আহকামে ইতিকাফ ফাজায়েল ও মাসায়েল, পৃষ্ঠা ৬৫)

ইতিকাফের আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ঃ

১. রমজান মাসে ইতিকাফকারী মসজিদের মুয়াজ্জিন হোক বা না হোক এবং মসজিদে বিদ্যুৎ থাকুক বা না থাকুক সর্বাবস্থায় মসজিদের বাইরে গিয়ে আজান দিতে পারবে। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া : ১/২১২, রদ্দুল মুহতার : ২/৪৪৬)

২. যে ব্যক্তি সুন্নাত ইতিকাফকে শুরু করে ভেঙে ফেলেছে, তাকে রমজানের পর রোজাসহ এক দিন ও এক রাত ইতিকাফ করতে হবে। (রদ্দুল মুহতার : ২/৪৪৫)

৩. মসজিদে যদি কেউ মাগরিবের পর প্রবেশ করে, তাহলেও তার সুন্নাত ইতিকাফ হবে না তখন তার ইতিকাফ নফল হিসেবে গণ্য হবে। (ইমদাদুল ফাতাওয়া)

৪. যেহেতু এই ইতিকাফের শেষ সময় হলো ঈদের চাঁদ ওঠার দিন সূর্যাস্ত পর্যন্ত। সেহেতু ২৯ রমজান বা ৩০ রমজান সূর্যাস্তের আগে যদি চাঁদ দেখা যায়, তবুও সূর্য ডুবে যাওয়ার আগে মসজিদ থেকে বের হওয়া যাবে না। সূর্য ডুবে যাওয়ার পর মসজিদ থেকে বের হতে পারবে। (ফাতাওয়া শামি : ২/১৩৭)

৫. ইতিকাফকারীর জন্য প্রাকৃতিক ও শরিয়ত সমর্থিত প্রয়োজনে যেহেতু মসজিদ থেকে বের হওয়া জায়েজ। তাই তার জন্য যদি খাবার পৌঁছে দেওয়ার কোন লোক না থাকে তাহলে খাবার নিয়ে আসার জন্য, ইতিকাফরত মসজিদে যদি জুমার ব্যবস্থা না থাকে তাহলে জুমার নামাজ আদায় করার জন্য অন্য মসজিদে যাওয়াও জায়েজ আছে। (ফাতাওয়া শামি : ২/১৩২)

এদিকে, কোনো গ্রামের মসজিদে যদি অন্য গ্রামের কোন লোক ইতিকাফ করে তাহলে তার ইতিকাফের দ্বারা ওই গ্রামের সবার পক্ষ থেকে ইতিকাফের সুন্নাতে মুয়াক্বাদায়ে কেফায়া আদায় হয়ে যাবে। তবে গ্রামবাসীর জন্য উচিত, তাদের মধ্য থেকে কেউ ইতিকাফে বসা। (ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়া : ১৭/১৭১)

এছাড়া, ইতিকাফকে স্বেচ্ছায় পালন করতে হবে। ইসলামী শরিয়তে বিনিময় দিয়ে ভাড়া করে ইবাদত পালন করার কোনো সুযোগ নেই। তাই টাকার বিনিময়ে ইতিকাফ করা এবং করানো সম্পূর্ণ নাজায়েজ। আর এভাবে ইতিকাফ করানোর দ্বারা মহল্লাবাসী দায়মুক্ত হতে পারবে না। (রদ্দুল মুহতার : ২/৫৯৫, ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়া:১৭/১৭১)

আমাদের ইউটিউব চ্যানেল –

আরো পড়ুন –

রোজা রেখে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির কিছু টিপস
শেয়ার করুন -

উত্তর দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার নাম লিখুন