বাঘ বা টাইগার – এটি মাংসাশী বর্গের বড় বিড়াল জাতের কর্ডাটা পর্বের অন্তর্ভুক্ত একটি স্তন্যপায়ী প্রাণী। বাঘ ফেলিডি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত সবচেয়ে বড় প্রাণী। বাঘ ভারত ও বাংলাদেশের জাতীয় পশু যাকে পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার অনেক এলাকায় একে দেখা যায়।
এছাড়া, বাঘ ‘অ্যানিম্যাল প্ল্যানেট’ চ্যানেলের সমীক্ষা অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি প্রাণী। মূলত সংস্কৃত শব্দ ব্যাঘ্র থেকেই আসে বাঘ। যা বাংলা ভাষায় প্যানথেরা টাইগ্রিস নামে পরিচিত।
প্রজাতিঃ বাঘ মূলত ৮টি উপপ্রজাতির অন্তর্ভুক্ত। বর্তমানে বাঘের এই ৮টি উপপ্রজাতির মধ্যে ৫টি এখনও জীবিত রয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে বেঙ্গল টাইগার বা Panthera tigris tigris। এটি বাঘের ত্রিপদী নাম। এছাড়া, এটি বাংলার বাঘ নামেও পরিচিত। যা বর্তমানে বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, নেপাল, চীন ও পশ্চিম মায়ানমারে আছে।
জননকালঃ বাঘের মিলন বছরের যেকোন সময় হতে পারে। তবে নভেম্বর-এপ্রিলের মধ্যেই এদের সর্বাধিক মিলন ঘটে। সাধারণত ৩-৪ বছর বয়সে বাঘিনী ও বাঘ প্রজননক্ষম হয় এবং বাঘিনীদের গর্ভাবস্থাকাল প্রায় ১০৩-১০৫ দিন অর্থাৎ আনুমানিক ১৪-১৫ সপ্তাহ হয়ে থাকে।
তবে এদের অধিকাংশ বাচ্চাই ফেব্রুয়ারি-মে মাসের মধ্যেই জন্মায়। এছাড়া, বাঘ একসঙ্গে ২-৫ টি বাচ্চা প্রসব করে থাকে।
স্বভাবঃ বাঘেরা পানিতে থাকতে খুব পছন্দ করে এবং প্রায়ই তাদেরকে পানিতে গোসল করতে দেখা যায়। তবে এরা শুধু শরীর ঠান্ডা রাখতেই পানিতে নামেনা বরং অনেক সময় এরা শিকারের জন্যও পানিতে নামে।
খাদ্যাভাস ও দৈনিক খাদ্য চাহিদাঃ বিভিন্ন নিরামিষাশী, বুনো বা গৃহপালিত প্রাণী-যেমনঃ চিত্রা হরিণ, সম্বর হরিণ, মহিষ, গৌড়, বুনো শূকর, বানর, গরু, ছাগল, কুকুর ইত্যাদি বাঘের খাদ্য। তবে খিদে পেলে এরা চিতাবাঘ,কুমির, ভাল্লুক বা অজগরকেও ছাড়েনা।
এমনকি হাতি ও গণ্ডারের বাচ্চার উপরেও বাঘ হামলা করে থাকে। আর তখন কিছু সময়ের জন্য বাঘ নরখাদক হয়ে যায়। এছাড়া, একটি বাঘ দৈনিক ৫-১৫ কেজি মাংস খায়। তবে বড় পুরুষ বাঘ সুযোগ পেলে ৩০ কেজি মাংসও খেতে পারে।
শিকার কৌশলঃ বাঘ বেশির ভাগ সময়ই রাতের বেলায় শিকার করে থাকে। এরা মুলত জলাশয়ের কাছে ঘন ঝোপের মধ্যে ওৎ পেতে লুকিয়ে থাকে। এরপর এরা নিঃশব্দে শিকারের পিছু নেয় আর আচমকা হামলা বা আক্রমণের মাধ্যমে শিকার করে।
বাঘের গতিবেগ প্রতি ঘণ্টায় ৫০-৬৫ কিলোমিটার পর্যন্ত হয়। তবে এ গতিবেগ খুব অল্প সময়ের জন্য। এছাড়া, প্রতি ঘন্টায় এদের সাঁতারের গতিবেগ ৩২ কি.মি. পর্যন্ত হয় যা অলিম্পিক এর সাঁতারুদের থেকেও বেশি। আর এ জন্য এরা খুব সহজেই পানিতেও শিকার করতে পারে।
শিকারের জন্য অস্ত্রঃ শিকারের জন্য এরা তাদের লম্বা দাঁত এবং ধারালো নখ ব্যবহার করে থাকে। এছাড়া, তরুণ বাঘের ক্যানাইন দাঁত ৪ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়। যা বিড়াল পরিবারের মধ্যে সবচেয়ে বড়। বাঘের কামড়ের জোর ১০৫০ পিএসআই পর্যন্ত হয়ে থাকে।
সেই সাথে এদের আছে গুটিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা যুক্ত ব্লেডের মত ধারালো বাঁকানো নখর। আর তাদের সামনের পায়ের নখর গুলো ৩ ইঞ্চিরও বেশি লম্বা হয়ে থাকে।

পারিবারিক জীবনঃ বাঘ সাধারণত একা থাকতেই ভালোবাসে। এরা কেবল জননের সময় বাঘিনীর সাথে মিলিত হয়। তবে বাচ্চা বাঘেরা জন্মের পর প্রথম ৪-৫ মাস মায়ের যত্নেই লালিত-পালিত হয় এবং প্রথম ২ বছর বয়স পর্যন্ত তারা মায়ের সাথেই থাকে। আকারঃ বাঘ পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বিড়াল প্রজাতি।
বাঘ বিড়াল প্রজাতির অন্য সকল প্রানী এমন কি সিংহ হতেও বড়। বাঘ লম্বায় ৩.৩ মিটার (১১ ফিট) এবং ওজনে ৩০০ কিলোগ্রাম (৬৬০পাউন্ড) পর্যন্ত হয়। তবে পুরুষ বেঙ্গল টাইগার গড়ে ২২১ কিলোগ্রাম ওজনের এবং স্ত্রী বাঘিনী গড়ে ১৩৭ কিলোগ্রাম ওজনের হয়।
এছাড়া, বাঘের আকার তাদের উপপ্রজাতি ভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে। যেমনঃ বেঙ্গল টাইগার ও সাইবেরিয়ান বাঘ আকারে অনেক বড় হয়। আর সুমাত্রান, বালির ও জাভা দেশীয় বাঘ আকার আকৃতিতে তুলনামূলক ভাবে ছোট হয়ে থাকে।
বর্ণসংকরঃ বিভিন্ন কারণে (বিশেষত পরিব্যক্তি) বাঘের পরিচিত চেহারার বাইরেও দেখা মেলে ভিন্ন ধরনের বাঘ। যেমনঃ সাদা বাঘ, কালো বাঘ, সোনালী বাঘ, মাল্টীজ বাঘ।
সাদা বাঘঃ সাদা বাঘ মূলত বাঘেরই এক মিউট্যান্ট। বিশেষ জিন মিউটেশন এর ফলে বাঘ সাদা হয়। তবে সাদা বাঘ মূলত রয়েল বেঙ্গল টাইগার এরই মিউট্যান্ট বলে অধিকাংশ বিজ্ঞানীরা মত দিয়েছেন। তাছাড়া, এই সাদা বাঘ পৃথিবীর অনেক চিড়িয়াখানায়ই দেখতে পাওয়া যায়।
কালো বাঘঃ কালো বাঘকে নিয়ে মনে করা হতো এদের গায়ের রং নাকি দাবানলের ফলে কালো হয়ে যায়। এছাড়া, কিছুদিন আগে উড়িষ্যার সিম্লিপাল বনে এই বাঘের দেখা পাওয়ার কথা জানা গেছে।
সোনালী বাঘঃ সোনালী বাঘ golden tabby বা Strawberry Tiger নামে পরিচিত। পৃথিবীতে এই বাঘের সংখ্যা ৩০-এরও কম। তবে বিংশ শতকের শুরুর দিকে এই বাঘ বনে পাওয়া যেতো বলে জানা যায়। এছাড়া, বাংলা বাঘ ও সাইবেরিয়ান বাঘের মধ্যেও এই পরিব্যক্তির কথা জানা গেছে।
মাল্টীজ বাঘঃ এই বাঘের গায়ের রং নীলচে এবং বেশিরভাগ মাল্টীজ বাঘ দক্ষিণ চীনের বাঘ উপ-প্রজাতীর বর্ণসংকর। এই বাঘ চরম বিপন্ন হওয়ায় ধরে নেওয়া হয়েছে নীলবর্ণসংকর সম্ভবত বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এছাড়া, এর আগে সাইবেরিয়ান বাঘদের মধ্যেও নীলবাঘের খবর পাওয়া গেছে। তবে অধিকাংশ বিজ্ঞানী মনে করেন, এরকম বর্ণসংকর হওয়া প্রায় অসম্ভব।
জীবনকালঃ বাঘের গড় আয়ু জঙ্গলে থাকা কালিন ১৫ বৎসর পর্যন্ত ধরা হয়। তবে বন্দি অবস্থায় তা ২২ পর্যন্ত হয়ে থাকে। কারণ, বন্দি অবস্থায় তারা নিয়মিত যত্নের ফলে এবং সময় মতো খাবার পেলে এদের আয়ু ৫-৭ বছর বৃদ্ধি পায়।
আরো পড়ুন –