আমাদের বিশ্বের পরিবেশবান্ধপ সাতটি মসজিদ –

আমাদের বিশ্বের পরিবেশবান্ধপ সাতটি মসজিদ -
আমাদের বিশ্বের পরিবেশবান্ধপ সাতটি মসজিদ -

 পরিবেশবান্ধপ সাতটি মসজিদ – পৃথিবীতে আমরা যারা মানুষ বসবাস করি তারা প্রত্যেকেই কোনো না কোনো ধর্ম পালন করে থাকি। তবে পৃথিবীতে এতো ধর্ম থাকা সত্ত্বেও সৃষ্টির শুরু থেকে ইসলামই হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধর্ম।

আর ইসলাম ধর্মের পবিত্র স্থানগুলোর মধ্যে একটি স্থান হচ্ছে মসজিদ। যাকে বলা হয় মুসলমানদের ইবাদতগার। যাকিনা মানসিক প্রশান্তির অত্যন্ত পবিত্র স্থান। তাই বেশির ভাগ মুসলমানই প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে জামায়াতের সঙ্গে আদায় করে থাকেন।

এছাড়া, মুসলিম ও অমুসলিম দেশ সহ বিশ্বের এমন কোনো দেশ নেই যেখানে মসজিদ দেখতে পাওয়া যায় না। মুসলিম দেশের পাশাপাশি অমুসলিম দেশ গুলোতেও লাখ লাখ মসজিদের মিনার থেকে প্রতিদিন উচ্চারিত হয় আজানের সুমধুর ধ্বনি।

বর্তমানে বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃদ্ধি পেয়েছে বৈশ্বিক উষ্ণতা, বিভিন্ন দূষণের মাত্রা ও বংশগত পরিবর্তন। এর ফলে পরিবেশ দূষণের শিকার হচ্ছে অসংখ্য মানুষ সহ উদ্ভিদ ও প্রাণী জাতি। এছাড়াও, গ্রিন হাউস অ্যাফেক্টের কারণে একটি চরম অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত হচ্ছে মানবসভ্যতা।

তাই প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও পরিবেশের সুরক্ষা বিবেচনা করে এখন বিশ্বে ভিন্ন আঙ্গিকে তৈরি হচ্ছে পরিবেশবান্ধব বাড়ি, মিল, কারখানা, অফিস, আদালত ইত্যাদি। আর এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে পরিবেশবান্ধব মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগও নিচ্ছে বিশ্বের অনেক দেশ।

এখানে, পরিবেশবান্ধব মসজিদ কথাটি দ্বারা এমন অবস্থাকে বোঝানো হয়েছে যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নয় অর্থাৎ, পরিবেশবান্ধব মসজিদের অবকাঠামো ও গঠনপ্রণালী এমন হবে, যা মুসল্লিদের সর্বোচ্চ পরিবেশগত উপকার সাধনে সক্ষম।

আর পরিবেশবান্ধব মসজিদের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো মদিনায় অবস্থিত আল্লাহর রাসুল হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর নির্মিত মসজিদে নববী। এছাড়া, বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থিত পরিবেশবান্ধব সাতটি মসজিদ  এর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা নিচে দেওয়া হলোঃ

১. কোবা মসজিদ, মদিনাঃ

সৌদি আরবের মদিনা শহর থেকে ছয় কিলোমিটার দূরের কোবা গ্রামে ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে এই মসজিদটি নির্মিত হয়। যা মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর নির্মিত ইসলামের প্রথম মসজিদ। সেই সাথে এটিই বিশ্বে প্রথম নির্মিত পরিবেশবান্ধব মসজিদ এবং এই কোবা মসজিদেই আল্লাহর রাসুল (সা.) সর্বপ্রথম জুমার নামাজ পড়েছিলেন।

এ মসজিদের দেয়াল তৈরী হয়েছিলো মাটির ইট এবং খেজুরগাছের গুঁড়ির সংমিশ্রণে। আর ছাদ নির্মাণ করা হয়েছিলো খেজুরপাতার সঙ্গে মাটি সংমিশ্রণে। পরবর্তীতে এই মসজিদ ভেঙে আবার নতুনভাবে নির্মাণ করা হয়। তাছাড়া, ইসলামের খলিফারা বিভিন্ন সময়ে কয়েকবার এই কোবা মসজিদের সংস্কার সাধন করেছেন এবং সর্বশেষ ১৯৮৪ সালে এই কোবা মসজিদ সংস্কার করা হয়েছিলো।

২. খলিফা আল-তাজির মসজিদ, দুবাইঃ

দুবাইয়ের বন্দর সাঈদ এলাকায় স্থাপিত এই মসজিদটিই হচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দেইরাতে অবস্থিত মধ্যপ্রাচ্যের প্রথম পরিবেশবান্ধব মসজিদ। যেটি নির্মাণের জন্য খলিফা আল তাজির ২০ মিলিয়ন দিনার দান করেছিলেন। তাই তাঁর নামানুসারেই এ মসজিদটির নামকরণ করা হয়েছিলো।

আল তাজির মসজিদের দুটি মিনারের প্রতিটির উচ্চতা ২৫ মিটার এবং ৪৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে নির্মিত এই মসজিদে প্রায় তিন হাজার ৫০০ মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন।

৩. মসজিদ আল-জিকরা, ইন্দোনেশিয়াঃ

ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিম জাভা প্রদেশের পাহাড়ি শহর সেনটুলে অবস্থিত এই আল-জিকরা মসজিদটির ভবনের অভ্যন্তরস্থ স্বাস্থ্য পরিবেশ, বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা, পানি সংরক্ষণ, নির্মাণসামগ্রী সহ সকল কিছুই পরিবেশবান্ধব কৌশলে স্থাপিত হয়েছে। এই মসজিদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো পানির পুনর্ব্যবহারোপযোগী ব্যবস্থা।

এ ব্যবস্থাটির ফলে পানির অপচয় রোধ হওয়ার পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহারও হ্রাস পেয়েছে। এছাড়া, মসজিদের বাইরের উন্মুক্ত ৪০ শতাংশ এলাকার পুরোটিই সবুজ ঘাসে ঢাকা। এতে করে যেমন মসজিদের শোভা বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি অনেকাংশ ক্ষেত্রেই কমেছে পরিবেশ দূষণের মাত্রাও।

৪. ডিজনি বড় মসজিদ, মালিঃ

ডিজনির ২৬তম মুসলিম শাসক কওই কুনবরো এর নির্মিত এই মসজিদটি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর বৃহত্তম একটি মাটির তৈরি মসজিদ। মালির এই ডিজনি মসজিদটি আফ্রিকার জন্য একটি বিস্ময় এবং এটি তিনবারে নির্মিত হয়ে বর্তমান অবস্থায় এসেছে বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়।

যা কওই কুনবরো ১৩ শতকে প্রথমবার নির্মাণ করেছিলেন। এ দিকে, মসজিদটি একটি নদীর তীরে অবস্থিত হওয়ায় ষোলো শতকে এক প্রলয়ঙ্করী বন্যায় ডিজনি শহর সহ বড় মসজিদের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় মসজিদটি দ্বিতীয়বারের মতো পুনর্নির্মাণ করা হয়।

এরপর, ১৯০৭ সালে তৃতীয়বারের মতো এই মসজিদটির নির্মাণকাজ শেষ হয়। এছাড়া, স্বল্প ব্যয়ে নির্মিত ১০ ফুট উচ্চতার এই মসজিদটি মাটি ও গাছের ডাল দিয়ে নির্মিত এবং এটি হাতে তৈরি মাটির মসজিদ হওয়ায় পরিবেশ দূষণের পরিমাণ এখানে প্রায় শূন্য। মালির এই ডিজনি মসজিদে রয়েছে তিনটি মিনার।

৫. রাজা ফয়সালবিল্লাহ মসজিদ, মালয়েশিয়াঃ

মালয়েশিয়ার সিলানগার সাইবারজয়া এলাকায় ১০০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া বিশ্বের অন্যতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘মালয়েশিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়’ এলাকায় এই রাজা ফয়সালবিল্লাহ সাইবারজয়া মসজিদটি স্থাপিত হয়েছে।

অত্যাধুনিক ও পরিবেশবান্ধব এই মসজিদ ১১ হাজার ১৬৮ বর্গমিটার এলাকাজুড়ে নির্মাণ করা হয়েছে। দ্বিতল এই মসজিদে আট হাজার ৩০০ মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন। তাছাড়া, পানির চাহিদা মেটানোর জন্য মসজিদটিতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ এবং তা পুনর্ব্যবহারের প্রযুক্তি স্থাপন করা হয়েছে।

সেই সাথে মসজিদে প্রাকৃতিকভাবে বায়ু চলাচলব্যবস্থাকে এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, যাতে বৈদ্যুতিক পাখা এবং শীতাতপ মেশিনের খুব একটা প্রয়োজন না পড়ে। এর বাইরেও মসজিদটিতে স্থাপন করা হয়েছে বয়স্ক মুসল্লিদের ব্যবহারের জন্য একটি অ্যালাভেটর এবং এতে রয়েছে অক্ষম শিশুদের জন্য একটি খেলার মাঠ।

৬. কেমব্রিজ কেন্দ্রীয় মসজিদ, যুক্তরাজ্যঃ

কেমব্রিজ শহরের রোমসি এলাকার মিল রোডে স্থাপিত এই মসজিদটি যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বড় পরিবেশবান্ধব মসজিদ। ২০০৮ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজের লেকচারার ড. টিমোথি উন্টার এই মসজিদ প্রকল্পের উদ্যোগ গ্রহণ করে এর তহবিল জোগাড় করার চেষ্টা চালান।

এরপর ২০০৯ সালে মসজিদের এক একর জায়গা ক্রয় করা হয় এবং এটি ক্রয়ের জন্য চার মিলিয়ন ইউরো খরচ করে পরবর্তীতে এর নির্মান কাজ শুরু করা হয়। এছাড়া, স্থাপত্য প্রকৌশলী মার্কস বারফিল্ড, প্রফেসর কেইথ ক্রিটিচলো এবং প্রখ্যাত ইসলামিক গার্ডেন ডিজাইনার ইমমা ক্লার্ক মিলে মসজিদের ডিজাইন তৈরি করেন।

অপূর্ব সুন্দর এই মসজিদটির অনবদ্য নির্মাণশৈলীর কারণে বছরজুড়ে এর ভেতরে সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারে। তাছাড়া, এর ছাদে সংযুক্ত করা হয়েছে বৃষ্টির পানির জলাধার এবং পানির পুনর্ব্যবহারোপযোগী প্রযুক্তিও।

তাই সব মিলিয়ে বলা যায় এই কেমব্রিজ কেন্দ্রীয় মসজিদটি ইউরোপের একটি বিরল পরিবেশবান্ধব মসজিদ। আর এতে একসঙ্গে প্রায় এক হাজার মুসল্লি নামাজ পড়তে পারেন এবং এই অসাধারণ মসজিদটি দেখার জন্য প্রতিনিয়ত ভিড় করে থাকেন অসংখ্য পর্যটক।

৭. দ্বিতীয় হাসান মসজিদ, আফ্রিকাঃ

আফ্রিকার মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম মসজিদের মধ্যে একটি হচ্ছে মরক্কোর কাসাব্লাংকায় অবস্থিত এই দ্বিতীয় হাসান মসজিদ। মসজিদটি আটলান্টিক সাগরের তীরে এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে, যার একটি অংশ সাগরের পানির ওপরে রয়েছে।

এতে করে নামাজ পড়ার পাশাপাশি মুসল্লিরা ইচ্ছা হলেই অনায়াসে আটলান্টিকের অপরূপ শোভা উপভোগ করতে পারেন। তাছাড়া, সাগরের ঢেউ যাতে মসজিদের কোনো ক্ষতি করতে না পারে সে জন্য গ্রহণ করা হয়েছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও।

এ দিকে, এই হাসান মসজিদের স্থপতি ছিলেন ফরাসি স্থাপত্যবিদ মাইকেল পিনসাউ এবং রাজা দ্বিতীয় হাসানের উদ্যোগে ১৯৮৬ সালের ১২ জুলাই ২২ একর জমির ওপর স্থাপিত হওয়া এই মসজিদটির কাজ শুরু হয়। এরপর দুই হাজার ৫০০ জন শ্রমিক মিলে সাত বছর ধরে দিন-রাত ২৪ ঘন্টা মসজিদটির নির্মাণের কাজ করে ১৯৯৩ সালে এর কাজ শেষ করে।

এছাড়া, এর বাইরেও প্রায় ১০ হাজার শিল্পী ও কারিগর কাজ করেছিলো এই বিশাল মসজিদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও নির্মাণের জন্য এবং মসজিদটি নির্মাণের জন্য ব্যয় হয়েছিল ৫৮৫ মিলিয়ন ইউরো। অন্যদিকে, মূল মসজিদটি লম্বায় ৬৬০ ফুট, প্রস্থে ৩৩০ ফুট এবং এর মিনারের উচ্চতা ৬৮৯ ফুট হওয়ায় এটি বিশ্বের মধ্যে সর্ববৃহৎ একটি মসজিদ।

তাছাড়া, মসজিদটির অনন্য আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো এখানে আরো বেশ কয়েকটি স্থাপনা যুক্ত করা হয়েছে। যেমনঃ ৫২ হাজার ১০০ বর্গফুট এলাকাজুড়ে একটি অত্যাধুনিক মাদরাসা নির্মাণ করার পাশাপাশি এতে আছে মরক্কোর দীর্ঘ ইতিহাস নিয়ে গঠিত একটি অনবদ্য মিউজিয়াম ও একটি বিশাল লাইব্রেরি।

আর মসজিদ চত্বরে রয়েছে পারিবারিক বনভোজন করার জন্য উপযুক্ত স্থাপনাসহ ৪১টি ঝরনা। যা সম্পূর্ণ পরিবেশকে আরো মনোমুগ্ধকর করে তুলেছে। এছাড়াও, দ্বিতীয় এই হাসান মসজিদের ভেতরের অংশে ২৫ হাজার এবং বাইরের অংশে ৮০ হাজার মুসল্লি মিলে মোট এক লাখ পাঁচ হাজার মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ পড়তে পারেন।

আর গরমের দিনে বড় বড় জানালা দিয়ে সাগরের নির্মল বাতাস সহজে মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করায় সবসময় এর পরিবেশটি খুব মনোরম থাকে। তাই সব মিলিয়ে দেখা যায় মরক্কোর দ্বিতীয় হাসান মসজিদ বিশ্বের পরিবেশবান্ধব মসজিদগুলোর মধ্যে অন্যতম।

আমাদের ইউটিউব চ্যানেল – 

আর পড়ুন –

প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর প্রিয় খাবার সমূহ
শেয়ার করুন -

উত্তর দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার নাম লিখুন