কত অসুবিধায় পরতে হতো তখন কিছু লিখতে গেলে। এইসব অসুবিধা থেকে পরিত্রাণ পেতেই পেন্সিল তৈরি হয়।
আজকের দিনে আমরা যখন লিখতে বসি তখন হাতের কাছে কত কিছুই না পাই! কলম, রঙ করার জন্য পেন্সিল, কত কি!
আমাদের জীবনকে সহজ করে তুলতে মূলত লেখালেখির জন্যই প্রথম পেন্সিলের উদ্ভাবন হয়। একে একে তৈরি করা হয় নানান রকমের পেন্সিল।
আজ আমরা জানবো কীভাবে পেন্সিল তৈরি করা হয় সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য।
পেন্সিল সম্পর্কে কিছু তথ্য:
পেন্সিল হলো এমন একটি বস্তু যা লেখা বা ছবি আঁকার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এটি একটি সরু খোলকে মাঝে কঠিন রঞ্জক পদার্থ দ্বারা তৈরি বস্তু।
কাগজ বা যেকোন মসৃণ বস্তুর সাথে সেই রঞ্জক পদার্থের ঘর্ষণের মাধ্যমে দাগ ফুটে ওঠে।
এবার জেনে নিই পেন্সিলের নামকরণ সম্পর্কে।
পেন্সিল একটি ইংরেজি শব্দ। যা ফারসি পিন্সেল অথবা ল্যাটিন শব্দ পেনিসিলাস থেকে এসেছে। এর আক্ষরকি অর্থ হচ্ছে ‘ছোট লেজ’।
প্রাচীন কালে মানুষ আঁকাআঁকির জন্য ব্রাশ হিসেবে উটের চুল বা লেজের পশম ব্যবহার করতো। ধারণা করা হয়, সেই আদি লিখন পদ্ধতিকে স্মরণ করেই পেন্সিলের এমন নামকরণ করা হয়েছে।
কীভাবে পেন্সিল তৈরি হয়?
পেন্সিলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো এর সীস। যেটা দিয়েই মূলত আমরা লিখি কিংবা আঁকাআঁকি করি। ইংরেজিতে একে Lead বলা হয়।
Lead বা সীস তৈরি:
Lead’এ কার্বনের রুপভেদ গ্রাফাইট আর কাদামাটির সংমিশ্রণ থাকে।
প্রথমে এ সীস তৈরির প্রক্রিয়াটিই জেনে নেয়া যাক।
সবার আগে অনেকগুলো গ্রাফাইটের খন্ড এবং কাদামাটি একটি বিশালাকৃতির ঘূর্ণনশীল ড্রামে রাখা হয়। যখন ড্রামটি ঘুরতে থাকে তখন সেখানে আগে থেকে রাখা পাথরের সঙ্গে ঘর্ষণের ফলে গ্রাফাইট আর কাদামাটি একদম চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পাউডারে পরিণত হয়ে যায়। এরপর এ মিশ্রণে পানি মিশিয়ে ৩-৪ দিনের জন্য শুকানোর জন্য রেখে দেয়া হয়।
মিশ্রণটি শুকিয়ে যাওয়ার পর আরেকটি মেশিনের সাহায্যে একে আবার পাউডারে পরিণত করা হয়। এরপর আবার অল্প পানি মিশিয়ে মিশ্রণটিকে নরম করা হয়।
এই নরম এ মিশ্রণগুলি ধাতব টিউবের ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়া হয় সীসের আকার নেবার জন্য। যেখানে তাদের চিকন রডের আকৃতি দেয়া হয়।
এরপর সেই রড আকৃতির সীসগুলোকে মেশিনের সাহায্যে পেনসিলের সমান আকারে কাটা হয়।
তারপর মসৃণ ও শক্ত করে তোলার জন্য সীসগুলোকে ওভেনে ১৮০০ ডিগ্রী ফারেনহাইট তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করা হয়।
পেন্সিলেরকাঠেরখোলকতৈরি:
বেইস বা খোলক তৈরিতে পেন্সিলের জন্য এমন কাঠ বেছে নেওয়া হয় যা নিয়মিত কাটাকাটির ধকল সহ্য করতে পারে। এজন্য এরস কাঠ ইংরেজিতে ceder wood বা সীডার গাছের কাঠ পেন্সিল তৈরির খোলকে ব্যবহার করা হয়। এটি সুগন্ধযুক্ত এর আকারও সহজে বিকৃত হয় না।
প্রথমে সীডার গাছের কাঠ কেটে নেওয়া হয়। এবং বিভিন্ন দরকারি প্রক্রিয়াজাতকরণ করা জয়। তারেপর একে ব্লকের আকার দেওয়া হয়।
কাঠের ব্লকটি কেটে একে চিকন চিকন অনেকগুলো খণ্ডে বিভক্ত করা হয়। ইংরেজিতে যাকে স্ল্যাট (Slat) বলা হয়। এই স্ল্যাটগুলো ৭.২৫ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য, ২.৭৫ ইঞ্চি প্রস্থ ও ০.২৫ ইঞ্চি পুরুত্বের হয়ে থাকে।
তবে বিভিন্ন কোম্পানিভেদে এ মাপ ভিন্নও হতে পারে।
এবার কাঠের স্ল্যাটগুলোকে কনভেয়ার বেল্টে তুলে দেওয়া হয়।
তারপর স্ল্যাটের তল মসৃণ করা হয়।
কনভেয়ার বেল্টে থাকা অবস্থাতেই স্ল্যাটে অর্ধবৃত্তাকার খাঁজ কাটা হয়, যেখানে সীসগুলো জুড়ে দেওয়া হবে। এই খাঁজগুলোর পুরুত্ব সীসের পুরুত্বের অর্ধেক পরিমাপে কাটা হয়।
উপরের কাজগুলি যখন চলছিলো তখন আরেকটি কনভেয়ার বেল্ট অন্য আরেক ব্যাচ কাঠের স্ল্যাট কেটে বহন করে আনছিলো। এই স্লাটগুলোর আকার-আকৃতি, খাঁজের ধরণ সবই পূর্বোক্ত স্ল্যাটের মতোই।
তবে শুধুমাত্র সেগুলোতে আঠা লাগানো থাকে না। আর খাঁজগুলোতে কোনো সীসও রাখা থাকে না।
একসময় এই সীসব্যতীত স্ল্যাটগুলো সীস এবং আঠাযুক্ত স্ল্যাটগুলোর উপর বসিয়ে দেয়া হয়। এই পদ্ধতিটিকে স্যান্ডউইচ বলা যেতে পারে। বসানোর পর স্যান্ডউইচগুলোর উপর হাইড্রোলিক প্রেসের সাহায্যে চাপ দেয়া হয়, যাতে স্লেটের দুইপাশ শক্ত করে আটকে যায় এবং বাড়তি আঠা চারপাশ দিয়ে বেরিয়ে আসে।
এরপর স্যান্ডউইচগুলোকে ক্ল্যাম্পে শুকানোর জন্য আটকে রাখা হয়। শুকিয়ে গেলে গায়ে লেগে থাকা বাড়তি আঠাগুলো ছেঁটে ফেলা হয়।
এবার স্যান্ডউইচগুলো পাঠিয়ে দেয় কাটিং মেশিনে। যেখানে দ্রুত ঘুর্ণায়মান বিরাট স্টিল ব্লেডের সাহায্যে এগুলো কোম্পানিভেদে বৃত্তাকার কিংবা ষড়ভূজ আকারে কাটা হয়। একটি মেশিনের সাহায্যেই প্রত্যেকটি স্ল্যাট থেকে ৬-৯টি পর্যন্ত আলাদা আলাদা পেন্সিল কাটিং করা যায়।
এরপরের কাজ হলো পেন্সিলকে মসৃণ করা এবং বার্নিশ করা। সর্বশেষ শুকানো। এ কাজগুলোও মেশিনের সাহায্যে করা হয়। নির্ধারিত রঙ,পানি, পিপারমেন্ট ইত্যাদির মিশ্রণে পেন্সিলগুলোকে কাঙ্খিত রঙ দেওয়া হয়।
যদি রবারযুক্তর পেন্সিল তৈরি করা হয় তবে সবার শেষে এসব পেন্সিলের পেছনে আঠা অথবা ধাতব কাঁটারের সাহায্যে ধাতব কেস লাগানো হয়। তারপর এসব কেসের ভেতরে ছোট্ট ইরেজার বসিয়ে দিলেই একেকটি পেন্সিল তৈরি হয়ে যায়।
বিভিন্নরকমেরপেন্সিল:
প্রয়োজন অনুসারে বিভিন্ন রকম পেন্সিল তৈরি করা হয়। কোন পেন্সিল তৈরি হয় শুধুমাত্র লিখার জন্য। আবার কোন পেন্সিল তৈরি হয় আঁকাআঁকির জন্য। তবে আঁকার জন্য তৈরি করা পেন্সিলগুলোর বিভিন্ন রকমফের থাকে।
এছাড়াও বাজারে বিভিন্ন আকারে, বিভিন্ন রকম পেন্সিল পাওয়া যায়।
গ্রাফাইট পেন্সিল:
যেসব পেন্সিল আমরা রোজ ব্যবহার করি সেগুলোই হচ্ছে গ্রাফাইট পেন্সিল। কাঠের কেসে নির্দিষ্ট পরিমাণ গ্রাফাইট এবং কাদামাটির সংমিশ্রণে এগুলো তৈরি করা হয়।
পেন্সিল তৈরিতে এসব মিশ্রণের অনুপাত নির্ভর করে দাগ কতটুকু গাঢ় হবে তার উপর।
গাঢ় দাগের পেন্সিল তৈরি করতে চাইলে কাদার পরিমাণ থেকে গ্রাফাইটের পরিমাণ বেশি দেওয়া হয়। এধরণের পেন্সিলগুলোর সীস থাকে একদম নরম। যেমন- F, 4B, 3B ইত্যাদি।
অপর দিকে গ্রাফাইট থেকে কাদার পরিমাণ বেশি থাকলে দাগ অপেক্ষাকৃত হালকা এবং সীস অনেক শক্ত হয়। যেমন- H, 2H, 3H, HB, 2B, 4B ইত্যাদি। মূলত এগুলোই আমরা লিখার জন্য ব্যবহার করি।
কেসবিহীন পেন্সিল:
এটাও গ্রাফাইটের তৈরি পেন্সিলই। কিন্তু এই পেন্সিল তৈরিতে কাঠ বা অন্যকিছুর কেস ব্যবহার করা হয় না। শুধু গ্রাফাইটই থাকে।
কাঠকয়লা পেন্সিল:
এই পেন্সিলগুলো কাঠি আকারের। কাঠকয়লা দিয়ে এসব পেন্সিল তৈরি করা হয়। সাধারণত ছবি আঁকার জন্য এগুলো ব্যবহৃত হয়।
কার্বন পেন্সিল:
পেন্সিলের সাথে কাঠকয়লা এবং গ্রফাইট মিশিয়ে গাঢ় বা হালকা রঙের করা হয়।
রঙ পেন্সিল:
এগুলো রঙিন পেন্সিল, রঙ করার কাজে ব্যবহৃত হয়। মোমের সঙ্গে সঠিক অনুপাতে রঙের মিশ্রণ করে এর শিস তৈরি করা হয়। এবং কাঠের কেসে ভরে রঙ পেন্সিল তৈরি করা হয়।
জলরং পেন্সিল:
এগুলোও রঙ পেন্সিলের মতোই। পার্থক্য হলো- এর উপাদানগুলো পানিতে মিশে যেতে পারে। এবং শীসের মিশ্রণে মোম দেওয়া হয় না।
কাঠমিস্ত্রির পেন্সিল:
শক্ত গ্রাফাইট দিয়ে এইসব পেন্সিল তৈরি হয়। কিছুটা ডিম্বাকৃতির হয়ে থাকে।
প্লাস্টিক পেন্সিল:
এগুলো প্লাস্টিকের তৈরি পেন্সিল। অত্যন্ত নমনীয় প্রকৃতির, চাইলে বাঁকিয়ে ফেলা যায়ম তবে ভাঙবে না।
১৯৬০ সালে গ্রসম্যান প্রথম এমন পেন্সিল তৈরি করেন।
এছাড়াও আরও বিভিন্ন ধরণের পেন্সিল বাজারে পাওয়া যায়।