সুন্দরবনের সুন্দরী গাছের জানা অজানা নানা তথ্য  

সুন্দরবনের সুন্দরী গাছের জানা অজানা নানা তথ্য  
সুন্দরী গাছ

বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে আমাদের সুন্দরবন। আর এই সুন্দরবনের প্রধান বৃক্ষ হলো সুন্দরী গাছ। বিশাল এই বনের নামকরণ ‘সুন্দরবন’ হওয়ার একমাত্র কারণ এই সুন্দরী গাছ।

সুন্দরবন এলাকার প্রায় ৭০ ভাগ জুড়ে এই গাছের বিস্তৃতি।

নাম:

বাংলাদেশ এবং ভারত উভয় স্থানেই এই উদ্ভিদ সুন্দরী নামে সুপরিচিত।

বৈজ্ঞানিক নাম:

সুন্দরী গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Heritiera fomes.

পরিবার:

সুন্দরী মালভেসি পরিবারের অন্তর্ভূক্ত এক প্রকার সমুদ্র-উপকূলীয় বৃক্ষ। উপকূলবর্তী লোনা এলাকায় এদের বেশি দেখা যায়।

প্রজাতি:

সুন্দরী গাছের প্রধান প্রজাতির নাম Heritiera fomes. সুন্দর বনের প্রায় ৭০ শতাংশ এলাকাজুড়ে এই গাছ জন্মে।

তবে এর পশ্চিমাংশে আরেক প্রজাতির সুন্দরী গাছ জন্মে। যেটির নাম H. littoralis.

উৎপত্তির আদিস্থান:

এই উদ্ভিদের উৎপত্তির আদিস্থান ঠিক কোথায় তা এখনো জানা যায়নি। সবসময় এদের সমুদ্র উপকূলবর্তী লোনা এলাকায় জন্মাতে দেখা যায়।

প্রাপ্তিস্থান:

সুন্দরী গাছ মূলত এক প্রকার লবণাম্বু উদ্ভিদ। তাই সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলের কর্দমাক্ত এবং লবণাক্ত মাটিতে এই উদ্ভিদ জন্মায়।

পৃথিবী-বিখ্যাত একইসঙ্গে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় লোনা বন (mangrove forest) সুন্দরবনে এদের আধিক্য বেশি পাওয়া যায়।

আকার-আকৃতি:

একটি প্রাপ্তবয়স্ক সুন্দরী গাছের গড় উচ্চতা ৭৫ ফুট।

তবে সুন্দরী গাছের অন্য প্রজাতি H. littoralis এর আকৃতি প্রায় ২৫ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে।

গঠন ও বৈশিষ্ট্য:

যেখানে লবণাক্ত পানিতে কোন গাছ জন্মাতেই থাকতে পারে না, সেখানে সুন্দরী গাছ দিব্যি জন্মায় এবং ভালো মতো দীর্ঘদিন বেঁচে থাকে। এটা অবশ্য এই উদ্ভিদের আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্যের জন্য হয়ে থাকে।

আর তা হলো অভিযোজনগত বৈশিষ্ট্য। এটা এমন এক ধরণের বৈশিষ্ট্য যার মাধ্যমে গাছ লবণাক্ত পানিতেও জীবনধারণ করতে পারে। যা থাকে মূলে।

মুল:

সমুদ্র উপকূলের মাটি লবণাক্ত থাকে। একারণে এখানকার যেকোন উদ্ভিদের মূল মাটির গভীরে প্রবেশ করে না। গাছের মূল মাটির সামান্য নীচে বিস্তৃত থাকে।

  • শ্বাস মূল: সমুদ্রের আশেপাশের মাটি হয় কর্দমাক্ত ও রন্ধ্রবিহীন। তাই ওই মাটিতে অক্সিজেন সরবরাহ করা খুব কঠিন এবং কম সম্ভপর হয়। তাছাড়া এরকম অঞ্চল অধিকাংশ সময়েই জলপ্লাবিত থাকে ।

আবার মাটিতে প্রচুর পরিমাণে অজৈব লবণ দ্রবীভুত অবস্থায় থাকে। একারণে এখানকার উদ্ভিদগুলোর কিছু শাখা-মূল অভিকর্ষের বিপরীত দিকে ধাবিত হয় এবং মাটির উপরে উঠে আসে।

সুন্দরবনের শ্বাসমূল
সুন্দরবনের শ্বাসমূল

এইসব মূলের উপরিভাগ অসংখ্য সূক্ষ্ম শ্বাস ছিদ্রযুক্ত অর্থ্যাৎ প্রচুর ‘নিউম্যাটোফোর’ থাকে। যে ছিদ্রের মাধ্যমে উদ্ভিদের মূলগুলি বায়ুমন্ডল থেকে অক্সিজেন শোষণ করে। এই ধরণের মূলকেই শ্বাসমূল বলা হয়।

  • ঠেস মূল: এসব অঞ্চলের গাছগুলি ভিষণ নরম ও কর্দমাক্ত মাটিতে জন্মানায়। যার ফলে, গাছগুলো যাতে সহজেই পড়ে না যায়, এজন্য গাছের কান্ডের গোড়ার দিক থেকে এক ধরণের অস্থানিক মূল বেরিয়ে মাটিতে প্রবেশ করে। এই মূলগুলিই ঠেস মূল নামে পরিচিত।

  • অধিমূল: সুন্দরী গাছের গুঁড়ির নীচের দিকে চারপাশ থেকে কিছু চ্যাপ্টাকৃতি এবং তক্তার মতো অংশ বের হয়ে মাটির অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। তক্তার মতো এইসব অংশগুলি অধিমূল। এই অধিমূলগুলির কারণেই সুন্দরী গাছের গুঁড়ি মূলত সোজাভাবে দন্ডায়মান থাকতে পারে।

কান্ড: সুন্দরী গাছের কান্ড খর্বাকার এবং গম্বুজাকার। এই কান্ড সাধারণত দৃঢ় এবং শাখা-প্রশাখাযুক্ত হয়।

আরেকটি চমকপ্রদ ব্যাপার হচ্ছে এই কান্ডে যান্ত্রিক কলা ও সংবহন কলা সুগঠিত।

এছাড়াও কান্ডের ত্বকে থাকে পুরু কিউটিকল। আবার অনেক সময় উদ্ভিদের ত্বক মোমযুক্ত একধরণের পদার্থ দ্বারা আবৃত থাকে ।

পাতা: সুন্দরী গাছের পাতা স্থুল, রসালো কিন্তু খসখসে। পাতার আকার ডিম্বাকৃতির এবং ছোট। পাতার ত্বক পুরু এবং কিউটিকলযুক্ত।

পাতার প্যালিসেড কলা সুগঠিত ও সাধারণত কোশান্তর-রন্ধ্র অনুপস্থিত থাকে। আর পত্ররন্ধ্রগুলি নিম্নত্বকের ভিতরের দিকে অবস্থিত।

আরো পড়ুন:
বাংলার ঐতিহ্যমন্ডিত উদ্ভিদ – পান পাতা গাছ 
কালোজিরা গাছ – মহৌষধী গুণ সমৃদ্ধ এক উদ্ভিদ 
বাসক গাছ – বাংলার অতি পরিচিত ভেষজ উদ্ভিদ

এই উদ্ভিদের পাতার অন্যতম বিশেষত্ব হচ্ছে পাতাগুলো চকচকে হয়, কারণ পাতার ফলকে মোমের আবরণ থাকে। মূলত বাষ্পমোচন রোধের জন্য প্রাকৃতিকভাবেই পাতা এমন অভিযোজন ক্ষমতাসম্পন্ন।

ফুল:

সুন্দরী গাছে ফুল হয়। এই ফুল ঘন্টাকৃতির। খুবই ছোট। আকারে এগুলো প্রায় ৫ মিমি. পর্যন্ত চওড়া হয়। ফুলের রঙ হয় হলুদ রঙের।

তবে H. littoralis প্রজাতির গাছের ফুলের রঙ কমলা বা গোলাপী রঙের।

ফল:

ফুলের পর গাছে আসে ফল। ফলগুলো গুচ্ছাবদ্ধ অবস্থায় থাকে। এবং পেকে গেলে গাছ থেকে আপনাআপনি ঝরে পরে।

বীজ:

ফলের পর গাছে আসে বীজ।

বংশবিস্তার:

বীজের মাধ্যমে এই গাছের বংশবিস্তার হয়।

বীজগুলো যখন পেকে গাছ থেকে কর্দমাক্ত লোনা জলে পড়ে তার কিছুদিন পরেই এর থেকে শ্বাস বের হয়।

উপকারিতা:

সুন্দরী গাছের প্রচুর উপকারিতা রয়েছে। এই গাছের কাঠ শক্ত এং লাল। তাই গাছের কাঠ থেকে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখা যায়। সুন্দরী কাঠের বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ২ লক্ষ ৫০ হাজার ঘনফুট।

এছাড়াও সুন্দর বনের আশেপাশের অঞ্চলগুলোর মানুষের জীবিকা নির্বাহ হয় এই কাঠের মাধ্যমে।

সুন্দরী কাঠ শক্ত এবং লাল। তাই এই কাঠ ব্যবহৃত হয় নানা কাজে। প্রধানত নৌকা, আসবাবপত্র, হার্ডবোর্ড ইত্যাদি তৈরি করা হয়। এছাড়াও এই কাঠ থেকে উন্নতমানের কাঠ কয়লায় পাওয়া যায়।

তবে এত সুন্দর এবং উপকারিতা সত্ত্বেও এটি এখন বিপর্যয়ের মুখে রয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য সুন্দরীরা এখন আর ভালো নেই।

জলবায়ুর পরিবর্তন, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, মানুষের আগ্রাসন, সমুদ্রের লবণাক্ততা বৃদ্ধিসহ নানা কারণে গাছটি এখন হুমকির মুখে।

আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে সুন্দরী গাছের সংখ্যা। গত ২৫ বছরে বনের পরিমাণ প্রায় ২৫ শতাংশ কমে গেছে।

শুধু উদ্ভিদই নয়। এই ভয়াল করাল গ্রাসের শিকার সুন্দরবনের সকল উদ্ভিদ এবং প্রাণী।

তাই আমাদের সময় থাকতে বন রক্ষার্থে সোচ্চার হওয়া উচিত। যথাযথ কর্তৃপক্ষের উচিত সুন্দরবনের সুন্দরী গাছের জানা অজানা নানা তথ্য যথাসময়ে সমুচিত কৌশল গ্রহণ করে বনকে বাঁচিয়ে রাখা।

কিউরিয়াস চ্যানেল লিংক 

শেয়ার করুন -

উত্তর দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার নাম লিখুন