দেখতে একদম উটের মতো, তাই পাখিটির নাম উট পাখি। মাজার বিষয় হলো এটি এমন এক পাখি যে উড়তে পারে না। তবে খুব জোড়ে ছুটে বেড়াতে পারে। কিন্ত তারপরও এই প্রাণীটিকে পাখি হিসেবে ধরা হয়।
কেন পাখি হওয়া সত্ত্বেও উট পাখি উড়তে পারে না? এ বিষয়ে আজ সবিস্তারে জানবো। তাছাড়াও অদ্ভুদ এই পাখিটির জীবন বৈচিত্র্য সম্পর্কেও জানবো জানা অজানা নানা তথ্য।
নামকরণ:
এই পাখিটি দেখতে অনেকটাই উটের মতো। তাই এর নাম দেওয়া হয়েছে উট পাখি।
বিভিন্ন জায়গায় এটি কিউয়ি, রিয়া, কেসোয়ারি, এমু বা ইমু পাখি নামেও পরিচিত।
ইংরেজি নাম Ostrich, Common Ostrich.
বৈজ্ঞানিক নাম:
উট পাখির বৈজ্ঞানিক নাম Struthio camelus.
পরিবার:
উট পাখি Struthionidae গোত্র বা পরিবারের অন্তর্গত, Struthio গণের অন্তর্ভূক্ত একটি পাখির প্রজাতি।
উৎপত্তির আদিস্থান:
প্রাকৃতিক ভাবে উট পাখি আফ্রিকার বনাঞ্চলের প্রাণী। আফ্রিকার উত্তর-দক্ষিণের সাভানা এবং সাহেল অঞ্চলে এদের দেখা মেলে।
গবেষণায় জানা গেছে আগে এশিয়ায়ও এদের পাওয়া যেতো।
এমনকি প্রত্নতাত্বিক দপ্তরের এক গবেষণায়- ২৫ হাজার বছর আগে ভারতের রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও গুজরাটেও নাকি উটপাখি পাওয়ার ৯২% জীনগত প্রমাণ পাওয়া গেছে।
প্রাপ্তিস্থান:
বর্তমানে আরব, অস্ট্রেলিয়ায় এরা বসতি স্থাপন করেছে। তাছাড়া এশিয়া মহাদেশেও তারা বাস করতে শুরু করেছে। এশিয়ার মাইনরে এদের দেখা যায়।
বিভিন্ন দেশের চিড়িয়াখানাতে গেলেও এদের দেখা পাওয়া যায়।
আকার-আকৃতি:
উচ্চতায় উট পাখি প্রায় ৩ মিটার। এদের বিশাল পাখা রয়েছে। সম্পূর্ণ পাখা মেলে ধরলে তার দৈর্ঘ্য দাড়ায় প্রায় ৭ ফুট।
এই প্রজাতির পাখির পা ১০-১৬ ফুট দীর্ঘ।
পাখিটির দেহের ওজন ১৫০-১৭০ কেজি বা এরও বেশি হতে পারে।
গঠন ও বৈশিষ্ট্য:
বিশ্বের সবথেকে বড় পাখি হলো উট পাখি। সাধারণত এরা সাদা-কালো রঙের হয়ে থাকে। তবে স্ত্রী পাখি বাদামী রঙের হয়।
উট পাখির ঠোট অনেক শক্ত।
পাখি পরিবারের অন্তর্ভূক্ত হলেও এরা ওড়ার ক্ষমতাবিহীন। বিশাল পাখার জন্যই মূলত উট পাখি উড়তে পারে না। এছাড়াও তাদের উড়তে না পারার আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে পাখার তুলনায় এদের দেহের ওজন অনেক বেশি।
পুরুষ এবং স্ত্রী পাখির পাখার রঙে বিশেষ বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। একটি পুরুষ পাখির পাখার রঙ কালো হয়ে থাকে। এর সঙ্গে একটি সাদা লেজও থাকে। অন্যদিকে স্ত্রী পাখির পাখার রঙ ধূসর বাদামী রঙের হয়।
অন্যান্য ডিমের তুলনায় উট পাখির ডিম অনেক বড়
উড়তে না পারলেও এরা ভীষণ জোড়ে ছুটতে পারে। আর এদের সবচেয়ে ভয়ংকর অস্ত্র হচ্ছে তাদের পা। এই পায়ের আঘাতে মানুষসহ বিভিন্ন প্রাণী মারাও যায়। তাদের দৌড়ের বেগ প্রতি ঘন্টায় ৭০ কিলোমিটার মতো।
উট পাখির আরেকটি মজার এবং স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অন্যান্য যেকোন প্রাণীর মতো এই প্রাণীটির দাঁত নেই।
পুরুষ পাখি সিংহের মতো গর্জন করতে পারে। আবার হিস হিস করেও আওয়াজ করে।
উটপাখির ঘুমকে ‘স্লো ওয়েভ স্লিপ’ বলে ডাকা হয়। এরা যখন খুব ক্লান্ত থাকে তখন সোজাভাবে দাড়িয়ে, ঘাড় সোজা রেখে, চোখ মেলে এক জায়গাতেই ঘুমিয়ে পরে। আর অদ্ভুত হলেও সত্য এই প্রাণীরা ঘুমের মধ্যেও সজাগ থাকে।
দেখতে ভিষণ বড় হলেও কিন্তু উট পাখি একদমই হিংস্র স্বভাবের নয়। এরা শান্তিপ্রিয় প্রাণী। সবসময় নিরবে-নিভৃতে থাকাই এদের অভ্যাস।
তবে বিপদে কোণঠাসা হয়ে পড়লে এরা শক্তিশালী পা দিয়ে লাথি দেয় নয়তো ঠোট দিয়ে ঠোকর দেয়।
আর বিপদে পড়লে সাধারণত উট পাখি শুয়ে লুকিয়ে পড়ে নাহলে দৌড়ে পালিয়ে যায়।
খাদ্যাভ্যাস:
উট পাখির প্রধান খাদ্য হচ্ছে বিভিন্ন রকম শস্য দানা। তবে এরা পোকামাকড়ও খেয়ে থাকে। এদের দেহের অভ্যন্তরে ৩টি পাকস্থলী রয়েছে।
দাঁত না থাকায় এদের সম্পূর্ণ খাবার গিলে খেতে হয়। যা হজমে কিছুটা সমস্যা সৃষ্টি করে।
কিন্তু এই সমস্যা থেকে বাঁচতে তারা খাবার খাওয়ার সময় কিছু পাথরও খেয়ে নেয়। যা তাদের হজমে সাহায্য করে। পাকস্থলীতে এই পাথরগুলো খাদ্যদানা পেষার কাজটি করে।
একটি পূর্ণাঙ্গ উট পাখি তার পাকস্থলীতে ১ কেজি পরিমাণ পাথর খেয়েও ছুটে বেড়াতে পারে।
বংশবিস্তার:
ডিম পাড়ার মাধ্যমে এরা বংশবিস্তার করে থাকে। উট পাখির বিশালাকৃতির মতোই এদের ডিম অনক বড়। পৃথিবীতে যেসব প্রাণী ডিম পাড়ে তাদের তুলনায় উট পাখির ডিম সবচেয়ে বড় ডিম।
আকারে এদের ডিম প্রায় একটি ফুটবলের সমান। একেকটি ডিমের ওজন প্রায় ১.৫ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে।
ডিমের খোলসও হয় প্রচুর শক্ত। ডিমের রঙ সাদা এবং বাদামী হয়ে থাকে।
জুন থেকে জুলাই মাসে এরা ডিম পাড়ে। ডিম থেকে বাচ্চা ফুটতে সময় লাগে ৩৫-৪০ দিন।
এরা খুব বেশি ডিম পাড়ে না। একবারে তারা ততটাই ডিম পাড়ে ঠিক যত ডিম তারা তাদের শরীর দিয়ে ঢেকে রাখতে পারবে। যাতে তাদের এত বিশাল ডিমে তা দিতে সুবিধা হয়।
আয়ুষ্কাল:
গড়ে এই পাখি ৪০-৫০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে।
উপকারিতা:
জোড়ে ছুটতে পারার জন্য এই পাখিদের দিয়ে দৌড় প্রতিযোগীতা হয়। যা দর্শনার্থীদের কাছে দারুণ আনন্দময়।
উটপাখির ডিম খাওয়া যায়। ডিমে প্রোটিনের পরিমাণ কম থাকলেও প্রচুর পরিমাণে আয়রন এবং ম্যাগনেসিয়াম থাকে। আর এটি খাওয়ার সবচেয়ে উপকারী দিক হলো এই ডিমে কোলেস্টেরলের পরিমাণ কম।
তাই বিদেশে অনেকেই এই পাখির ডিম খেয়ে থাকে।
ডিমের খোলস শক্ত থাকায় এগুলো দিয়ে বিভিন্ন শিল্পকর্ম তৈরি করা যায়। পাত্র থেকে শুরু করে শৌখিন অনেক জিনিসও বানানো হয় এই খোলস দিয়ে।
উট পাখির ডিমের খোলস দিয়ে তৈরি শিল্পকর্ম
বিশ্ববাজারে এই পাখির চামড়া, মাংস, পালক, ডিম ইত্যাদির প্রচুর চাহিদা। তাই এই পাখিটি বর্তমান বিশ্বে একটি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় এদের বসবাস শুরু হলেও বিগত কয়েক দশক ধরে এদের সংখ্যা ক্রমশই কমে যাচ্ছে। তবে এখনো আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছায়নি।
একারণে আই.ইউ.সি.এন. পাখির এই প্রজাতিটিকে নূন্যতম বিপদগ্রস্ত বলে ঘোষণা দিয়েছে।