পান আমাদের দেশের একটি প্রাচীন ঐতিহ্য। অতীতে অভিজাত শ্রেণীর মানুষদের মাঝে পান বিতরণ করা হতো। পান পাতা গাছ থেকে পাতা আহরণ করে খাওয়া হয় এই পাতাটি। সঙ্গে চুন,সুপারির মতো যোগ করা হয় আরও কিছু অনুসঙ্গ।
একটা সময় সুন্দরভাবে পান সাজিয়ে পানদানিতে রাখাকে লোকজ শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হতো।
ঐতিহ্যগতভাবে সামাজিক রীতি, আচার-আচরণ, ভদ্রতা, পবিত্রতার অংশ হিসেবে পানের ব্যবহার চলে আসছে। এক সময় অনুষ্ঠান বাড়িতে পান পরিবেশন করা হতো। কোথাও কোথাও এখনো এই চল বিদ্যমান।
নিশ্বাসকে সুরভিত করা এবং ঠোঁট ও জিহ্বা লাল করার জন্য মানুষ পান পাতা খায়। যদিও পান পাতায় কিছুটা মাদকতার আনন্দও রয়েছে। তাই অনেকে এটি নেশা হিসেবেও খেয়ে থাকে।
একসময় পান ছিল উৎসব, বিয়ে, পূজা-পার্বনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আজ আমরা পরিচিত হবো বাংলার ঐতিহ্যমন্ডিত উদ্ভিদ পান পাতা গাছ সম্পর্কে-
নামকরণ:
পান শব্দটি এসেছে সংস্কৃত পর্ণ থেকে। যার অর্থ পাতা।
প্রাচীনকালে আর্য এবং আরব জনগোষ্ঠী পানকে তাম্বুল নামে ডাকতো।
পানের ইংরেজী Betel leaf বা Betel Vine.
বৈজ্ঞানিক নাম:
পানের বৈজ্ঞানিক নাম Piper betel.
পরিবার:
পান পিপারাসি পরিবারের অন্তর্গত পিপার গণের একটি উদ্ভিদ।
প্রজাতি:
পানের বিভিন্ন প্রজাতি রয়েছে। পাতার আকার, কোমলতা, ঝাঁজ, মিষ্টতা, সুগন্ধ ইত্যাদির উপর নির্ভর করে এ প্রজাতিগুলোর নামকরণ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য কিছু হলো-
বারি পান, চালতা গোটা, মিঠা বা মিষ্টি পান, ঝাল পান, ভাবনা পান, রংপুরী পান, খাসিয়া পান, সন্তোষী পান, সাঁচি পান ইত্যাদি।
এসব পানের মধ্যেও আবার কিছু উপজাত পান রয়েছে। যেমন- বারি পান-১, বারি পান-২, বারি পান-৩ ইত্যাদি।
উৎপত্তির আদিস্থান:
পান গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের একপ্রকার গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ।
প্রধানত দক্ষিণ এশিয়া, উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশসমূহ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের পান পাতা গাছ জন্মাতে দেখা যায়।
প্রাপ্তিস্থান:
অতীতে বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলেই পানচাষ করা হতো। এখন তা অনেক কমে গেছে।
পান উৎপাদনের ক্ষেত্রে দিনাজপুর, রংপুর, সিলেট, মেদিনীপুর (পশ্চিমবঙ্গে), চট্টগ্রাম ইত্যাদি জেলা বিখ্যাত।
বাংলাদেশের মহেশখালীর পান খুবই বিখ্যাত।
আকার আকৃতি:
পানের অনেকগুলো প্রজাতি রয়েছে। আর প্রজাতি অনুসারে পানের আকার আকৃতি ও ওজনে প্রচুর ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। যেমন-
বারি পান-১ এর আকার ১২.৪৫ সেমি থেকে ১৫ সেমি পর্যন্ত হয়ে থাকে। এবং প্রস্থ ১০-১২ সেমি। আর ওজন হয় ৪-৫ গ্রাম।
বারি পান-২ এর দৈর্ঘ্য ১২-১৫ সেমি, প্রস্থ ১০-১৩ সেমি। এবং ওজন ৩-৪ গ্রাম হয়ে থাকে।
মিষ্টি পানের ওজন ৩.৬১ গ্রাম হয়ে থাকে।
ঝাল পানের দৈর্ঘ্য ১৫-১৬ সেমি, প্রস্থ ১০-১৩ সেমি. এবং ওজন ৩-৪ গ্রাম হয়ে থাকে।
এরকমই একেকটি পানের জাতে একেক আকার এবং ওজন হয়ে থাকে।
গঠন ও বৈশিষ্ট্য:
পান একটি গুল্ম জাতীয় লতানো গাছ। গাছে ফুল এবং পাতা হয়। এই পাতাই খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
পান পাতা মোটা ও ফলকটি সংকীর্ণ। পাতা সামান্য কটু স্বাদযুক্ত হয়ে থাকে।
পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী শাহী পান
পান পাতা গাছ বহুবর্ষজীবী, শক্ত এবং ঝুলন্ত আরোহী লতা। সাধারণভাবে পান পাতা গাছ ৫-২০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। একটি পান গাছ মোট ৮-১০ বছর পর্যন্ত ভালো পানের ফলন পাওয়া যায়।
এটি লতানো গাছ বিধায় অন্য গাছকে আশ্রয় করে বেড় ওঠে।
পান গাছের শাখাসমূহ স্ফীত পর্ববিশিষ্ট।
পান পাতা সরল, দৃঢ়। পাতার অবয়ব ডিম্বাকার-দীর্ঘায়িত, গোলাকার বা তির্যক। অনেকটা হৃৎপিন্ডাকার আকৃতির। পত্র বৃন্ত ১.০২.৫ সেমি পর্যন্ত লম্বা।
পান পাতা গাছে ফুল এবং ফলও উৎপন্ন হয়। তবে ফুলে পাপড়ি নেই।
আর ফল রসালো, ছোট এবং আকারে ডিম্বারকার বা গোলাকার হয়ে থাকে।
পান পাতা গাছে ফুল ও ফল ডিসেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত উৎপন্ন হয়।
পুষ্টিগুণ:
ভারতীয় উপমহাদেশে পান একটি অর্থকরী ফসল। এতে অনেক ভেষজ গুণও রয়েছে।
পান পাতায় গ্যাস্ট্রো প্রটেকটিভ, কার্মিনেটিভ এজেন্ট এবং অ্যান্টি-ফ্লটুলেন্ট রয়েছে যার কারণে পান চাবানোর সময় মুখে স্যালাইভা সৃষ্টি হয়। এটি খাবার হজম করতে সাহায্য করে।
প্রতি ১০০ গ্রাম পানে-
ভিটামিন এ ১.৯-২.৯ এমজি,
নিকোটিন এসিড রয়েছে ০.৬৩-০.৮৯ গ্রাম,
থায়ামিন ১০-৭০ মাইক্রোগ্রাম,
রিবোফ্লোভিন ১.৯-৩০ মাইক্রোগ্রাম, আয়োডিন ৩.৪
মাইক্রোগ্রাম এবং শক্তি রয়েছে ৪৪ কিলোক্যালরি।
পানচাষ:
প্রাকৃতিক ভাবে বেড়ে উঠলেও ভালো এবং অধিক পরিমাণে উন্নত মানের পান পেতে হলে পান পাতা গাছের চাষ করতে হয়।
উপযুক্ত মাটি এবং আবহাওয়া: উঁচু, বন্যামুক্ত, এটেল দোআঁশ বা বেলে দোআাঁশযুক্ত জমি পান চাষের উপযুক্ত।
এবং ছায়াযুক্ত নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু পান চাষের উপযোগী।
পানের বরজ তৈরি: পান পাতা চাষের জন্য সবচেয়ে বেশি জরুরি হলো বরজ। সাধারণ ক্ষেত-খামার বা খোলা মাঠে পান চাষ করা যায় না। এর জন্য বরজ তৈরি করে নিতে হয়।
বাঁশ, ছন, খুটি, কলা পাতা ইত্যাদি দিয়ে ছোট ঝোপ বা ঘড়ের মতো তৈরি করাকে বরজ বলে।
পানের বরজ তৈরি করতে পাকা বাঁশ বা খুঁটি, বাঁশের চটা, খড়, ছন বা কাশ জাতীয় গাছ প্রয়োজন হয়।
প্রথমে বাঁশের খুঁটি নির্দিষ্ট জমির চারদিকে পোঁতা হয়। তারপর তার উপরে খড়, বাঁশের চটা দিয়ে ছাউনি দেওয়া হয়। এরপরে খেজুর পাতা, কলাপাতা কিংবা সুপাড়ি পাতা দিয়ে বেষ্টনী অর্থ্যাৎ বেড়া দিয়ে দেওয়া হয়।
পান গাছ লতানো বিধায় এই ছাউনির ভেতরে পানের চারা রোপনের পর প্রয়োজনমতো কাঠি বেঁধে দেওয়া হয়।
চারা রোপন: বর্ষা কাল বা আষাঢ় মাস পান পাতা গাছের চারা রোপনের উপযুক্ত সময়। কাটিং পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন করা হয়।
বরজের ভেতর সারিবদ্ধ ভাবে পানের চারা রোপন করা হয়। সারির প্রতিটি লাইনের মাঝে ৩০ সেমি, দূরত্ব রাখতে হয়। আর প্রতিটি গাছের মাঝে ৮-৯ সেমি. দূরত্ব রাখা হয়।
একেকটি পানের বরজে প্রায় ৪০০-৫০০ টি চারা রোপন করা হয়।
পান পাতা তোলা: একটি পান পাতা সম্পূর্ণরূপে পরিণত হতে ৬-৭ সপ্তাহ প্রয়োজন। কচি পাতার চেয়ে পরিণত কিন্তু সবুজ পাতার চাহিদা বেশি।
পানের চারা রোপন করা ৫-৬ মাস পর থেকেই পাতা তোলা শুরু করা যায়।
গাছের গোড়া অর্থ্যাৎ নিচের দিক থেকে পাতা আগে তুলতে হয়। তবে গাছে কমপক্ষে ১২-১৬ টি পাতা অবশিষ্ট রাখতে হয়।
প্রচলিত ধারণা:
অনেকে স্থানে মনে করা হয় পান পাতা শুভ চিহ্নের প্রতীক। তাই বিয়ে-শাদি, পূজা-পার্বণ বা যে কোন শুভ কাজে পান রাখা হয়। বুড়ি-বুড়ি থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষই শুভ প্রতীক হিসেবে এটি খেয়ে থাকে।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা পূজায় নৈবেদ্য হিসেবে পান নিবেদন করে।
পানের বরজ নিয়েও অনেক রকম প্রচলিত ধারণা রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি যেটি শোনা যায় সেটি হচ্ছে, পানের বরজে লক্ষ্মী বা যেকোন শুদ্ধ আত্মা বাস করে। তাই পানের বরজে প্রবেশ করার সময় সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে ঢুকতে হয়। তা নাহলে নাকি পান পাতা গাছ আর বৃদ্ধি পায় না, এবং খুব দ্রুত গাছ মরে যায়।
খাবার পদ্ধতি:
পান খাওয়ার বিভিন্ন প্রকরণ রয়েছে। সাধারণত চুন এবং সুপারির সঙ্গে পান খাওয়া হয়। অনেকে এর সাথে তামাক, জর্দা, খয়ের দিয়ে খায়।
তবে অনুষ্ঠান বাড়িতে এর সঙ্গে বিভিন্ন রকম মসলা যোগ করা হয়। এগুলোকে বলা হয় পান মসলা বা শাহী পান।
এসকল মসলায় বাদাম, জিরা, কিসমিস থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রকার তেল, তিল, ধনিয়া, মিষ্টি জাতীয় উপাদান, নারিকেল, মধু, খেজুর, কিসমিস, মিষ্টি জিরা, জর্দা, লং, গোলমরিচ ইত্যাদি অনেক রকম উপাদান দেওয়া হয়।
মসলা দেওয়ার পর পানের নাম হয় মসলা পান। বিভিন্ন রকম মসলা দেওয়ায় পানের স্বাদ আরও বেড়ে যায়। এটিও খুবই প্রসিদ্ধ একটি খাবার।
পুরান ঢাকার শাহী পান খুবই সুস্বাদু এবং এতিহ্যবাহী একটি খাবার। এর প্রচুর জনপ্রিয়তা রয়েছে।
অন্যান্য উপকারিতা:
পান শুধু খেতেই সুস্বাদু নয়। এটি খুব উপকারিও। যেমন-