দেশীয় মোবাইল ব্যাংকিং সেবা প্রতিষ্ঠান নগদের মালিকানার কেন এতো পরিবর্তন?
দেশীয় সেবা প্রতিষ্ঠান নগদের মালিকানায় বারবার বদল
বাংলাদেশে মোবাইল ফোনে অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে বর্তমানে খুব পরিচিত একটি নাম ‘নগদ’। কিন্তু নগদের মালিকানা ও ব্যবসায় পরিচালনা নিয়ে রয়েছে নানা জটিলতা।
নগদই একমাত্র আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠান যেটা মাত্র আড়াই বছরেই তুমুল প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে বাজারের বড় একটা অংশ নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে।
তবে চিন্তার বিষয়, এখনো নগদের মালিকানা ও ব্যবসা পরিচালনা সংক্রান্ত যেসব জটিলতা, সেগুলোর কোন সুরাহা হয়নি।
কর্তৃপক্ষ নিজেদের সরকারের ডাক অধিদপ্তর সেবা হিসেবে প্রচার করলেও প্রকৃতপক্ষে নগদের মালিকানায় ডাক অধিদপ্তরের কোনো অস্তিত্ব নেই। পক্ষান্তরে আবার তারা আর্থিক সেবা দিলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো চূড়ান্ত অনুমোদন কিন্তু নেই নগদের।
এমন অবস্থায় নগদের আর্থিক সেবাকে আইনি কাঠামোর আওতায় এনে একে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তর করা হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে এবং এর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
এরফলে নগদের ৫১ শতাংশ মালিকানা চলে যাবে ডাক অধিদপ্তরের কাছে। এবং বাকি ৪৯ শতাংশ থাকবে এখনকার মালিকদের কাছে।
নগদকে আইনি কাঠামোর আওতায় আনার লক্ষ্যে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক আপাতত এমন পরিকল্পনা করেছে বলে জানা গেছে।
এ সম্পর্কে বিশদ জানতে চাইলে ডাক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) সিরাজ উদ্দিন বলেন, নগদে আসলে ডাক অধিদপ্তরের মালিকানা নেই। তারা শুধুমাত্র ডাক অধিদপ্তরের ব্র্যান্ড ব্যবহার করছে। তাই নগদের ৫১ শতাংশ মালিকানা নেয়ার জন্য ডাক অধিদপ্তরের অধীনে একটি কোম্পানি গঠন করা হচ্ছে। এরপর ৯ সদস্যের একটি নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হবে। সেই পরিচালনা পর্ষদে চেয়ারম্যানসহ মোট ৫ জন পরিচালক হবেন সরকারের প্রতিনিধি।
সিরাজ উদ্দিন আরও জানান, ‘নগদের মালিকানা নিতে আমরা কোনো টাকা দেব না। কারণ নগদ শুরু থেকেই আমাদের ব্র্যান্ড ব্যবহার করছে। তার মূল্যমান হিসেবে সেবা প্রতিষ্ঠানটির ৫১ শতাংশ মালিকানা পাবে ডাক অধিদপ্তর।’
‘ইতোমধ্যেই এ জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের নিকট মতামত চাওয়া হয়েছে। আমরা আশা করছি চলতি বছরের মধ্যেই এ সংক্রান্ত সমস্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে যাবে। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধীনে থেকে অন্যান্য এমএফএস প্রতিষ্ঠানের মতো পরিচালিত হবে নগদ।’
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে মোবাইলে আর্থিক সেবা দেয়ার উদ্দেশ্যে গড়ে ওঠে থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস নামক একটি সেবা প্রতিষ্ঠান। যাতে নগদের প্রযুক্তি খাতের ব্যবসায়ী এবং বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর আহমেদের পাশাপাশি এর মালিকানায় আরও যুক্ত হন গ্রামীণফোন ও গুগলের সাবেক কর্মকর্তা কাজী মনিরুল কবির, সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল, মিজানুর রহমান ও সৈয়দ আরশাদ রেজা।
তারপর ২০১৭ সালে এসে ডাক অধিদপ্তরের মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা দেয়ার কাজ নেয় এই থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস।
সবশেষে ২০১৯ সালের ২৬ মার্চ থেকে তাদের কার্যক্রম শুরু করে নগদ।
তবে নগদের কর্তৃপক্ষরা তাদের কার্যক্রম শুরু করার আগেই অংশীদারদের মধ্যে কেউ কেউ থার্ড ওয়েভের শেয়ার ছেড়ে দেন। এর মধ্যে কাজী মনিরুল কবির অংশীদারিত্ব ছেড়ে দিলে নগদের মালিকানায় যুক্ত হন ২ সাংসদ রাজী মোহাম্মদ ফখরুল ও নাহিম রাজ্জাক। এছাড়াও রেজওয়ানা নূর নতুন মালিকানায় যুক্ত হন।
যৌথ মূলধন কোম্পানি এবং ফার্মগুলোর পরিদপ্তরের (আরজেএসসি) হালনাগাদের তথ্য অনুসারে, থার্ড ওয়েভ টেকনোলজির নাম পরিবর্তন করে পরে নগদ করা হয়েছে। তারপর মালিকানায় যুক্ত হয়েছেন নতুন অনেকেই। আবার ছেড়েও দিয়েছেন কেউ কেউ।
আড়াই বছরে কার্যক্রমে দফায় দফায় একাধিকবার নগদের মালিকানায় পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে নগদের পরিচালক ৯ জন, যাঁরা বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে নিবন্ধিত একাধিক কোম্পানির প্রতিনিধি। যাদের মধ্যে যুক্তরাজ্য, কানাডা এবং সিঙ্গাপুরের ১ জন করে নাগরিকও রয়েছেন। বাকি ৬ জন বাংলাদেশি।
নগদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তানভীর আহমেদ নিজস্ব নামে থাকা সকল শেয়ার টেলিকম এশিয়া হোল্ডিং এবং অন্য পরিচালক শাফায়েত আলমের কাছে গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে হস্তান্তর করেছেন। প্রাইম ব্যাংকের সাবেক এমডি রাহেল আহমেদ ১ জুলাই থেকে ফিনক্লুশন ভেঞ্চারের প্রতিনিধি হিসেবে নগদের পরিচালক পদে নিযুক্ত রয়েছেন। একইসঙ্গে তিনি সেবা প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাও (সিইও)।
১ জুলাই থেকে রেজাউল হোসেন নগদের পরিচালক হয়েছেন ফিনটেক হোল্ডিংয় এর প্রতিনিধি হিসেবে।
সাফায়েত আলম ব্লু ওয়াটার হোল্ডিংয়ের প্রতিনিধি হিসেবে পরিচালক হয়েছেন। আবার তিনি নগদের নির্বাহী পরিচালকও।
মোহাম্মদ আমিনুল হক ও মারুফুল ইসলাম নগদের পরিচালক হিসেবে রয়েছেন টেলিকম এশিয়া হোল্ডিংয়ের মনোনীত প্রতিনিধি হিসেবে।
এর বাইরে নগদের ফিনক্লুশন ভেঞ্চারের পক্ষে সিঙ্গাপুরের নাগরিক ফয়সাল আহসান চৌধুরী এবং স্টালওয়ার্টে লিমিটেডের পক্ষে কানাডার নাগরিক তামজিদ রহমান পরিচালক হিসেবে রয়েছেন।
আর মিয়ার্স হোল্ডিংয়ের পক্ষ হয়ে পরিচালক নিযুক্ত হন ব্রিটিশ নাগরিক গিলস এলাস্টার জেমস ফার্লে, তাঁর কার্যালয় ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে।
নগদের এমডি তানভীর আহমেদ গত রবিবার রাতে বলেন, ‘যাঁরা এখন মালিকানায় রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে আমিসহ অধিকাংশই দেশীয় কোম্পানির। নগদে কর্মরত কর্মীদেরও এতে শেয়ার আছে।
আগে একটি কোম্পানি সিঙ্গাপুরে নিবন্ধিত ছিল। কিন্তু এখন সেখানে কোনো কার্যক্রম চলছে না। এর পাশাপাশি নগদে ৩টি বিদেশি কোম্পানির ৩ জন প্রতিনিধিও রয়েছেন।
নতুন করে যদি লকডাউন আর না হয় তবে চলতি বছরেই নগদ পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপ নেবে।’