মসজিদের নগরী কিংবা রিকশার শহর দুটো নামেই প্রসিদ্ধ আমাদের রাজধানী ঢাকা শহর। আবার যানজটের শহরও বলে থাকেন অনেকে। কিন্তু এই শহরেরও যে হাজারো বছরের ইতিহাস রয়েছে, তা সম্পর্কে আমরা কয় জন জানি? ঢাকা সৃষ্টির ইতিহাস কিংবা ঢাকা কিভাবে রাজধানী শহর হয়ে উঠলো তাইবা কতজন জানি?
আজ আমরা জানবো সেই সুপ্রাচীন ইতিহাস। ঢাকা সৃষ্টির ইতিহাস সম্পর্কে।
ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী এবং ঢাকা বিভাগের প্রধান শহর। এটি একটি মেগাসিটি ও দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম শহর।
বাংলাদেশের বৃহত্তম এই শহরটি বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। একসময় যেটি দলুয়া বা ধোলাই নদী নামে পরিচিত ছিল।
এই শহরের জনসংখ্যা প্রায় ২ কোটি ১০ লক্ষ। এটি বিশ্বে নবম বৃহত্তম শহর। একই সঙ্গে ঢাকা বিশ্বের সর্বাপেক্ষা জনবহুল শহরগুলোর মধ্যে একটি।
ঢাকা নামকরণের ইতিহাস:
ঢাকা শহরের নামকরণ দিয়ে ব্যপক মতভেদ প্রচলিত রয়েছে।
কথিত রয়েছে যে সেন বংশের রাজা বল্লাল সেন বুড়িগঙ্গা নদীর তীরবর্তী এলাকায় ভ্রমণকালে সন্নিহিত জঙ্গলে হিন্দুদের দেবী দূর্গার একটি বিগ্রহ খুঁজে পান।
দেবীর দূর্গার প্রতি শ্রদ্ধাসরূপ রাজা বল্লাল সেন ঐ এলাকায় একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।
যেহেতু দেবী দূর্গার বিগ্রহটি ঢাকা বা গুপ্ত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল তাই মন্দিরের নাম রাখা হয়েছিল ঢাকেশ্বরী মন্দির।
আর এই মন্দিরের নাম হতেই কালক্রমে অঞ্চলটির নাম ঢাকা হয়ে উঠে।
আবার অনেক ঐতিহাসিকের মতে, মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর যখন ঢাকাকে সুবাহ বাংলার রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেন তখন সুবাহদার ইসলাম খান আনন্দের বহিঃপ্রকাশসরূপ শহরে ঢাক বাজানোর নির্দেশ দেন।
এই ঢাক বাজানোর ইতিহাস লোকমুখে কিংবদন্তীর রূপ নেয়। এবং তা থেকেই শহরটির নাম ঢাকা হয়ে যায়।
বর্তমানে ঢাকা ইংরেজিতে Dhaka নামে পরিচিত। তবে ১৯৮২ সালের পূর্বে একে Dacca লিখা হতো।
তবে ঢাকার পূর্ব নাম ছিল জাহাঙ্গীর নগর। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের নামানুসারে এই নামকরণ করা হয়।
১৬১৩ সালে মৃত্যুর পূর্বে সুবেহদার দলুয়া বা ধোলাই নদীর যেটা বর্তমানে বুড়িগঙ্গা নামে পরিচিত- নদীর তীরে একটি দুর্গ প্রতিষ্ঠা করেন। তার নাম ছিল “কেল্লা-ই-জাহাঙ্গীর”।
ঢাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্য:
ঢাকা সৃষ্টির ইতিহাস যেমন পুরাতন তেমনি এর ইতিহাস ও ঐতিহ্যের জুড়ি মেলা ভার। ধারণা করা হয কালের পরিক্রমায় ঢাকা প্রথমে সমতট, পরে বঙ্গ ও গৌড় প্রভৃতি রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিলো।
ঢাকা সৃষ্টির ইতিহাস:
ঢাকার বয়স ৪০০ বছর বলা হলেও কার্যত এই নগরের বয়স আরও অনেক বেশি।
ঠিক কবে নগরী ঢাকার গোড়াপত্তন হয়েছে এনিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে রয়েছে নানা ধারণা।
বিভিন্ন ইতিহাস ঘেটে জানা যায় ৭ম শতক থেকে ঢাকায় মানুষ বসবাস করতে শুরু করে।
খ্রিষ্টীয় তেরশ শতাব্দির শেষের দিকে মুসলমানরা ঢাকা দখল করে। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের ফরমান অনুযায়ী ১৬ই জুলাই ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকাকে সুবাহ বাংলার রাজধানী ঘোষণা করা হয়।
সম্রাট জাহাঙ্গীরের নামানুসারে তখন এই শহরের নাম রাখা হয় জাহাঙ্গীরনগর। সম্রাট জাহাঙ্গীরের জীবনকাল পর্যন্ত এই নাম বজায় ছিলো।
এর আগে সম্রাট আকবরের আমলে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার প্রাদেশিক রাজধানী ছিলো বিহারের রাজমহল।
সুবাহ বাংলায় তখন চলছিল স্বাধীন বারো ভুঁইয়ার রাজত্ব। বারো ভুঁইয়ার নিয়ন্ত্রণ থেকে বাংলাকে করতলগত করতে ১৫৭৬ থেকে ১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বার বার চেষ্টা চালানো হয়।
এরপর সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসণামলে ১৬০৮ খ্রিষ্টাব্দে ইসলাম খান চিশতিকে রাজমহলের সুবাহদার নিযুক্ত করা হয়।
তিনি ১৬১৯ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার ভৌগলিক অবস্থান বিবেচনা করে রাজধানী রাজমহল থেকে সরিয়ে ঢাকায় স্থানান্তর করে।
মূলত ইসলাম খান চিশতির ঢাকায় আগমন এবং একে রাজধানী ঘোষণা করার সময়কালের উপর নির্ভর করে ঢাকার বয়স পেরিয়েছে ৪টি শতাব্দি।
সুবাহদার ইসলাম খান চিশতি দায়িত্ব নেবার মাত্র ৫ বছরের মাথায় বারো ভুঁইয়ার পতন ঘটে। চট্টগ্রামের কিছু অংশ বাদে পুরো সুবাহ বাংলা মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনের চলে আসে।
তবে ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা সুবাহ বাংলার রাজধানী হলেও সুবাহ বাংলার রাজধানী বার বার পরিবর্তন করা হয়েছে।
১৬৫০ খ্রিষ্টাব্দে সুবাহদার শাহ সুজা রাজধানী আবার রাজমহলে স্থানান্তর করেছিলেন। শাহ সুজার পতনের পর ১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দে সুবাহদার মীর জুমলা আবার রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তর করেন।
এরপর বেশ কিছুকাল নির্বিঘ্নে ঢাকা রাজধানীর মর্যাদা ভোগ করার পর ১৭১৭ খ্রিষ্টাব্দে সুবাহদার মুর্শিদকুলি খাঁ রাজধানীকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করেন।
এরপর ঢাকায় মুঘল শাষনামলে সুলতান নায়েবে নাজিমদের শাসন যা চলেছিল ১৭৯৩ সালে ব্রিটিশ শাসনের আগ পর্যন্ত।