গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ করে দেশ-বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে দেশের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জ।
প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে গোয়েন্দাদের সাম্প্রতিক তদন্তে পাহাড়সম নজিরবিহীন সম্পদের তথ্য উঠে আসে-যা দেখে রীতিমতো বিস্মিত খোদ গোয়েন্দারাই।
এমনকি তাদের এই সম্পদের পরিমাণ দেশের সীমারেখা ছাড়িয়ে ভিনদেশ পর্যন্ত চলে গিয়েছে।
জমি, রিসোর্ট, ফ্ল্যাট, প্লট, মদের বার ডিজে ক্লাব, ডিলারশিপ, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ- কী নেই এই প্রতিষ্ঠানের মালিকদের।
প্যারিস, পর্তুগাল, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, নেপালে রয়েছে একাধিক সুপারশপ, বার, রেস্টুরেন্ট এবং ক্যাসিনো।
তাদের বিপুল পরিমাণ সম্পদের বিবরণে চক্ষু চড়কগাছ অনুসন্ধানে নামা প্রতিটি কর্মকর্তার।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, ই-অরেঞ্জের মূল পরিকল্পনাকারী ডিএমপির একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকার পরিদর্শক পদমর্যাদার। ওই কর্মকর্তার স্ত্রী কোরিয়ান ক্লাব এর সাবেক ওয়েটার নাজনিন নাহার বীথি হলেন এই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মালিক।
এবং প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী হলেন তারই আপন বোন সোনিয়া মেহজাবিন জুঁই ও তার স্বামী বিকাশের ডিজিএম মাসুকুর রহমান সুমন উক্ত প্রতিষ্ঠানটির উপদেষ্টা।
এছাড়াওচিফ অপারেটিং অফিসার হিসেবে রয়েছেন আমানউল্লাহ। যার বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগে আগেও বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছিলো।
তদন্তের তথ্যানুসন্ধানের পর থেকে এদের প্রত্যেকের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
প্রথমে অভিযোগ উঠে ই-অরেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতারণা করে গ্রাহকের ১১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের। এই অভিযোগের পর গোয়েন্দারা তদন্ত করতে যেয়ে আরও ভয়ংকর সব তথ্য খুঁজে পান।
গোয়েন্দা সংস্থাটি এই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মালিক কর্মকর্তাদের আমলনামা তৈরি করে।
তাদের অনুসন্ধানের ভিত্তিতে টাকা আত্মসাতের মামলায় ইতোমধ্যে ই-অরেঞ্জের মালিকসহ আরও ৩ জন রয়েছেন কারাগারে।
গতকাল মঙ্গলবার সোনিয়া মেহজাবিন জুঁই, তার স্বামী মাসুকুর রহমান এবং চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) আমানউল্লাহকে ৫ দিন করে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। ঢাকা মহানগর হাকিম মোর্শেদ আল মামুন ভূঁইয়া এই রিমান্ডের নির্দেশ দেন।
গোয়েন্দা সংস্থাটির ওই প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে নানান অপরাধ ও সম্পদের বিবরণ।
ই-অরেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের মাস্টারমাইন্ড সেই কর্মকর্তার মোট সম্পদের বিবরণ দেখে অনেক কর্মকর্তার চোখ কপালে উঠে গেছে।
বর্তমানে তার বাসস্থান শাহজাদপুরের সুবাস্তু নজরভ্যালি টাওয়ার-৩, ফ্ল্যাট-১০, বি-১’তে। কাগজে-কলমে এখন পর্যন্ত তার ৩ স্ত্রীর সন্ধান পাওয়া গেছে।
প্রথম স্ত্রীর নাম মোমেনা মাসুম। তাদের এই সংসারে সামিরা সুবহা নামে একটি কন্যাসন্তান রয়েছে।
কিন্তু ইস্পাহানি গ্রুপে কর্মরত মোমেনা মাসুমের সঙ্গে ১০ বছর যাবৎ কোনো সম্পর্ক নেই তার।
জানা গেছে একজন অভিনেত্রীর সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ওই অভিনেত্রী বাস করেম আফতাবনগরে।
তার দ্বিতীয় স্ত্রী ডল পিউ। অরেঞ্জ বাংলাদেশের সাবেক মালিক তিনি।লন্ডনে পড়তে গিয়ে ডল পিউর সঙ্গে পরিচয় হয় তার।
প্রথমে অরেঞ্জ নামের এই কোম্পানিটি লন্ডনে ছিল।
পরবর্তীতে তার মৃত্যুর পর অরেঞ্জ বাংলাদেশের মালিক হন ওই কর্মকর্তার দ্বিতীয় বোন সোনিয়া মেহজাবিন জুঁই।
তার তৃতীয় স্ত্রীর নাম হলো নাজনিন নাহার বীথি। তৃতীয় স্ত্রী বীথি এক সময় কোরিয়ান ক্লাবের ওয়েটার ছিলেন।
সেই কর্মকর্তা দেশের অভিজাত আমেরিকান ক্লাব, কোরিয়ান ক্লাবে এবং জার্মান ক্লাবেরও মেম্বার।
ওই পুলিশ কর্মকর্তার ছোট বোন হলেন সোনিয়া মেহজাবিন জুঁই। তিনিই ই-অরেঞ্জের প্রধান নির্বাহী। তার সব ধরণের ব্যবসার তদারকিই করেন সোনিয়া।
সোনিয়া মেহজাবিন জুঁইয়ের স্বামী মাসুকুর রহমান সুমন বেসরকারি মানি ট্রান্সফার প্রতিষ্ঠান বিকাশের ডিজিএম। একইসঙ্গে তিনি ই-অরেঞ্জের প্রধান উপদেষ্টা এবং পরিচালক।
গোয়েন্দাদের প্রতিবেদনে উঠে আসা তার সম্পদের তথ্যের একাংশ-
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ওই কর্মকর্তার রাজধানী ঢাকার শাহজাদপুরের সুবাস্তু নজরভ্যালি টাওয়ার-৩ এ রয়েছে আলিশান এক ফ্ল্যাট। এছাড়া নিকেতনে তার আরও ২টি ফ্ল্যাট আছে। বিটিআই ল্যান্ডমার্ক এর ৫ম ফ্লোরের সামনের অংশের বাম পাশে রয়েছে কমার্শিয়াল অফিস স্পেস।
টিঅ্যান্ডজি নামের প্রতিষ্ঠানের ২টি ব্রাঞ্চ। একটির অবস্থান উত্তরা ১৩নং সেক্টরের গরিবে নেওয়াজ এভিনিউতে। আর অপরটি গুলশান-২ ডিসিসি মার্কেটের দোতলায়। এছাড়াও পূর্বাচল ৩নং সেক্টরের ১৭নং প্লট। একটি অভিজাত এলাকায় প্লট এমনকি ফ্ল্যাটও আছে। এর বাইরে খাগড়াছড়িতে তিনি রিসোর্টের জন্য জায়গা কিনেছেন। তাছাড়া নিজ জেলায় প্রায় ৫০০ বিঘার ওপরে জমি রয়েছে। এবং গুলশানে বিভিন্ন পণ্যের ডিলারশিপ নিয়েছেন তিনি।
থাইল্যান্ডের পাটায়ায় জমি, ফ্ল্যাট এবং সুপারশপ রয়েছে। হিলটন হোটেলের পাশে ফাইভ স্টার হোটেল তৈরির উদ্দেশে জন্য মোটা অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করেছেন তিনি।
পর্তুগালের লিজবনে বার, সুপারশপ ও রেস্টুরেন্টে প্রায় ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন।
প্যারিসে আছে রেস্টুরেন্ট ও বার।
ফিলিপাইনে ম্যানিলা পি বরগুজ স্ট্রিট-এ বার রয়েছে।
নেপালের কাঠমান্ডুর থামিলে ছোট বার, ক্যাসিনো রয়েছে।
এবং এসব ব্যবসায় প্রতিনিয়তই তিনি কয়েক’শ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন।
এ বিষয়ে ওই কর্মকর্তার বক্তব্য জানতে তার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন কল রিসিভ করেননি।
যে তিনজন রিমান্ডে:
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন ও তার স্বামী মাসুকুর রহমানসহ ৩ জনকে টাকা আত্মসাতের মামলায় ৫ দিন করে রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দিয়েছে আদালত। ঢাকা মহানগর হাকিম মোর্শেদ আল মামুন ভূঁইয়া রিমান্ডের আদেশ জারি করেন।
রিমান্ডে যাওয়া অন্য আসামি হলেন ই-অরেঞ্জের চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) আমানউল্লাহ।
এ প্রসঙ্গে আদালত পুলিশের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা এসআই মো. আলমগীর সাংবাদিকদের জানান, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গুলশান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আমিনুল ইসলাম আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের উদ্দেশে গত ১৯ আগস্ট ১০ দিন করে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেছিলেন। ওই দিনই বিচারক রিমান্ড শুনানির জন্য ২৩ আগস্ট তারিখ ধার্য করে দেন।
গতকাল রিমান্ড শুনানিতে আসামিদের কারাগার হতে আদালতে হাজির করানো হয়। আসামী পক্ষের আইনজীবীরা রিমান্ড বাতিল ও জামিন আবেদন করেন।
মামলা সূত্রে জানা গেছে, গত ১৭ই আগস্ট তাহেরুল ইসলাম নামক এক ব্যক্তি রাজধানীর গুলশান থানায় ই-অরেঞ্জের ৫ মালিক-পরিচালকের বিরুদ্ধে১ হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলা করেন।
মামলা হওয়ার পর ই-অরেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন এবং তার স্বামী মাসুকুর রহমান আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন।
বিচারক জামিন নাকচ করে তাদেরকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। মামলায় সোনিয়া, মাসুকুর ও আমানউল্লাহ ছাড়াও বীথী আকতার, কাওসারসহ ই-অরেঞ্জের অন্যান্য সকল মালিকদেরই আসামি করা হয়েছে।
আরো পড়ুন: প্রায় ১৮ মাস পর সেপ্টেম্বরে খুলছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, ছুটি বাড়ছে স্কুলের তালেবান সাম্রাজ্যে হঠাৎ আসা মূর্তিমান আতঙ্ক আহমেদ মাসুদ – কে এই মাসুদ! পদ্মা সেতুতে গ্যাস পাইপ লাইন বসানোর কাজ চলছে পুরোদমে
তবে উক্ত কোম্পানির মালিকানায় সঠিক কতজন রয়েছেন তা উল্লেখ করা হয়নি। ১৮ আগস্ট রাতে গুলশান এলাকা থেকে আমানউল্লাহকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, গ্রাহকের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে আসামিরা পণ্য সরবরাহ করে না, বরং ১ লাখ গ্রাহকের সর্বমোট ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। দীর্ঘ সময় ধরে পণ্য বুঝে পায় না কাস্টমাররা। এর পূর্বেও ১৬ আগস্ট দিনভর ই-অরেঞ্জের গুলশান কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেন গ্রাহকরা।
এদিকে আবার পাওনা আদায়ের দাবিতে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালত চত্বরে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের প্রতারণার শিকার শতাধিক গ্রাহক মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছেন।
গতকাল সকাল থেকে প্রতারণার শিকার এসব গ্রাহকরা আদালত প্রাঙ্গনে প্লাকার্ড-ব্যানার হাতে বিভিন্ন দাবিতে এ কর্মসূচি পালন করেন।
মানববন্ধনে তারা বলেন, আমাদের টাকা ই-অরেঞ্জকে ফেরত দিতে হবে। এবং আমরা তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
আদালত চত্বরে সরেজমিনে দেখা যায়, সকাল থেকেই শতাধিক গ্রাহক মানববন্ধনে অংশ নিয়েছেন। এবং মামলার শুনানির সময় তারা আদালতের এজলাসের সামনে অবস্থান নেন। শুনানি শেষ হলে সিএমএম আদালতের নিচে তারা বিভিন্ন স্লোগান দেন এবং প্লাকার্ড হাতে বিক্ষোভ করেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের শান্ত থাকতে নির্দেশ দেন।