ত্রিফলার অন্যতম ফল – বহেড়া গাছ

ত্রিফলার অন্যতম ফল - বহেড়া গাছ
ত্রিফলার অন্যতম ফল - বহেড়া গাছ

বহুকাল থেকেই ভেষজবিদদের গবেষণায়  মহাষৌধি হিসেবে পরিচিত ত্রিফলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফল বহেড়া। আজ এই ফলের গাছ অর্থ্যাৎ বহেড়া গাছ সম্পর্কে কিছু তথ্য জানবো।

দক্ষিণ এশিয়ার ঔষধি ফল বহেড়া। এই ফলটি প্রাচীনকাল থেকে ব্যবহার হয়ে আসছে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায়।

নাম:

বহেড়া নামেই এটি সর্বত্র বিস্তৃত। অনেক এলাকায় বয়রা নামেও পরিচিত।

বহেড়া ফলের ইংরেজি Bohera, bahera অথবা beleric কিংবা bastard myrobalan.

আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে বহেড়াকে বিভিতকী নামে ডাকা হয়।

বৈজ্ঞানিক নাম:

বহেড়ার বৈজ্ঞানিক নাম Terminalia balerica.

পরিবার:

এটি Combretaceae পরিবারের অন্তর্গত Terminalia গণের একটি বৃক্ষজাতীয় উদ্ভিদ।

প্রজাতি:

এই উদ্ভিদের পৃথক কোন প্রজাতি নেই।

উৎপত্তির আদিস্থান:

বহেড়া গাছ দক্ষিণপূর্ব এশিয়া এবং উত্তর অস্ট্রেলিয়ার প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো গাছ।

প্রাপ্তিস্থান:

বহেড়া গাছ প্রধাণত ভারতের ছোট নাগপুর, বিহার, হিমাচল প্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশে জন্মে।

বাংলাদেশের ঢাকা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার অরণ্যেও জন্মে। আবার ভাওয়াল অঞ্চলের মধুপুর গড়, গাজীপুর, বগুড়া, দিনাজপুর, রামগড়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়ও এই গাছের দেখা পাওয়া যায়।

বিশ্বব্যাপী এই গাছের বিস্তিৃতি রয়েছে। এবং এটি বেশ সুপরিচিতও।

আকার-আকৃতি:

একটি বহেড়া গাছ উচ্চতায় প্রায় ৬০ থেকে ১০০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়।

পাতা ৩-৭ বা ৮ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়।

গঠন ও বৈশিষ্ট্য:

বহেড়া গাছ খুবই বড় গাছ। তাই এই গাছের গুড়িও অনেক লম্বা। তবে ছাল খুব বেশি পুরু নয়।

  • পাতা:

    বাহেড়া গাছের পাতা দেখতে অনেকটা ছোট আকারে বট পাতার ন্যয়।

বহেড়া গাছ পর্ণমোচী বৃক্ষ। অর্থ্যাৎ নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর পাতা ঝড়া বৃক্ষ।

শীতকালে এই গাছের সমস্ত পাতা ঝড়ে যায়। এবং বসন্তকালে আবার নতুন করে পাতা গজায়।

  • বহেড়া ফুল:

বহেড়া গাছে ফুল ফোঁটে। ফুলগুলো ছোট। দেখতে অনেকটা নাকছাবির মতো। এই ফুল পুষ্পদণ্ডের চারদিকে সাজানো অবস্থায় থাকে।

নভেম্বর মাসে গাছে ফুল আসে।

  • বহেড়া ফল:

ফুলে পর এর থেকে বহেড়া গাছে ফল ধরে। এটিই মূলত ঔষধ হিসেবে বেশি ব্যবহার করা হয়। ফল ও ফলের শাস ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও বাকল তো রয়েছেই।

এই গাছে দু’রকমের ফল জন্মায়।

-এক প্রকার গোল এবং আরেকটি ডিম্বাকৃতির। তবে এদের প্রজাতি একই।

শীত কালে বহেড়া ফল পুষ্ট হয়। তারপর নিজ আপনা-আপনিই গাছ থেকে খসে পড়ে।

কাচা অবস্থায় ফলের রঙ থাকে সবুজ। পাকলে লাল রঙ ধারণ করে। এবং শুকালে ক্রমশ বাদামী থেকে খয়েরী রঙ ধারণ করে।

প্রতিটি ফলে একটি মাত্র বীজ থাকে। তার ভেতরে বাদামের মতো মজ্জা রয়েছে। এটিও চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।

বহেড়ার ফুল ও ফল ধারণ ঘটে মার্চ থেকে নভেম্বর মাসে।

শুকনো অবস্থায় বহেড়া ফল
শুকনো অবস্থায় বহেড়া ফল

বংশবিস্তার:

বীজের মাধ্যমে বহেড়া গাছ জন্মায়।

তবে এই গাছ লাগানো বা রোপণ করার প্রয়োজন হয় না। পতিত জমি ও মাঠের ধারে বীজ পড়ে আপনা-আপনিই জন্মে থাকে।

সাধারণত স্যাঁতস্যাঁতে পর্ণমোচী অরণ্য এবং সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে কম উঁচু চিরসবুজ বনে এদের জন্ম হয়।

পুষ্টিগুণ:

গবেষকদের মতে বহেড়ায় রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টিব্যাক্টিরিয়াল উপাদান।

উপকারিতা:

ত্রিফলার গুরুত্বপূর্ণ একটি ফল হচ্ছে বহেড়া। এর গুণের শেষ নেই।

ঔষধী গুণ প্রবল বলে যুগ যুগ ধরে আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় এর ব্যবহার হয়ে আসছে। বিভিন্ন ধরণের রোগ নিরাময়ে এটি প্রচুর কার্যকর।

কথিত রয়েছে বহেড়া আয়ুবর্ধকও। খালি পেটে বহেড়া ভিজানো পানি পান করলে শরীর-স্বাস্থ্য থাকবে রোগমুক্ত।

 ভেষজগুণ: বহেড়ার ফল, বীজ ও বাকল বিশেষভাবে পরিশোধিত হয়ে আসছে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে এবং চিকিৎসাশাস্ত্রে।

  • হজমশক্তি বাড়াতে: বহেড়া হজমশক্তি বাড়াতে অত্যন্ত কার্যকর। হজমশক্তি বৃদ্ধি করতে এ ফলের খোসা ভালো করে গুঁড়ো করে নিন। তারপর পানির সাথে গুঁড়ো মিশিয়ে দিনে ২ বার নিয়মিত খেয়ে যান। ক্ষুধামান্দ্য তাড়াতেও একই পদ্ধতি প্রয়োগ করতে পারেন।

  • আমাশয় দূরীকরণে: প্রতিদিন সকালে বহেড়ার গুঁড়ো মেশানো পানি খেলে আমাশয়ে উপকার পাওয়া যাবে।

  • শ্লেষ্মা নিরাময়ে: প্রথমে বহেড়ার ফল পিষে এর সঙ্গে গরম ঘি মিশিয়ে আবার গরম করে, সবশেষে মধু দিয়ে খেলে শ্লেষ্মা নিরাময় হয়। এর পাশাপাশি সর্দি-কাশি তাড়াতেও বহেড়া বেশ উপকারী।

  • হাঁপানি থেকে মুক্তি: হাঁপানি থেকে মুক্তি পেতে বহেড়া বীজের শাঁস ২ ঘণ্টা অন্তর চিবিয়ে খাওয়া যায়। তবে এই পদ্ধতি অব্যশই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী মেনে চলতে হবে।

  • ডায়রিয়া প্রতিকারে: ডায়রিয়া হলে বহেড়ার খোসা পানির সঙ্গে মিশিয়ে খেলে উপকার পাওয়া যাবে।

  • ফোলা কমাতে: শরীরের যেকোনো অংশের ফোলা কমাতে বহেড়ার ছাল বাটা একটু গরম করে ফুলে যাওয়া স্থানে প্রলেপ দিন। ব্যথা এবং ফোলা দুটোই কমে যাবে।

  • শ্বেতি থেকে বাঁচতে: বহেড়ার বিচির শাঁসে যে তেল থাকে সেই তেল শ্বেতি স্থানে প্রলেপ দেওয়া যেতে পারে। অল্প দিনের মধ্যে শরীরের রঙ স্বাভাবিক হয়ে আসবে।

  • কৃমি নাশ: বহেড়া ‍কৃমিনাশক হিসেবে কাজ করে।

  • চুল পাকা প্রতিরোধে: অকালে চুল পাকা প্রতিরোধে ১০ গ্রাম পরিমাণ বহেড়ার ছাল পানি মিশিয়ে থেঁতো করে তা ১ কাপ পরিমাণ পানিতে ছেঁকে নিন। এবার এই পানি দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলুন। তাহলে চুল পাকা প্রতিরোধ হবে।

  • অনিদ্রা রোগে: বহেড়া অনিদ্রা রোগ দূর করতে প্রচুর সহায়ক।

অন্যান্য ব্যবহার:

বহেড়ার গাছের কাঠ বেশ শক্তপোক্ত হয়ে থাকে। এবং এই কাঠ সহজে পানিতে পচে যায় না। তাই নৌকা তৈরিতে বহেড়া কাঠের ব্যবহার করতে দেখা যায়।

আরো পড়ুন:
ত্রিফলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফল- হরিতকী গাছ 
ত্রিফলার অন্যতম ফল আমলকি গাছ পরিচিতি 
বাসক গাছ – বাংলার অতি পরিচিত ভেষজ উদ্ভিদ

এছাড়াও প্যাক-বাক্স, কফিন-বাক্স, কাঠের ভেলা, শস্যমাপন যন্ত্র, লাঙ্গল প্রভৃতি তৈরিতে বহেড়া গাছের কাঠ ব্যবহার করা হয়।

তবে এই ফল অত্যন্ত উপকারী হলেও বেশি মাত্রায় এর ব্যবহারে হুমকি দিয়েছেন গবেষকরা। কারণ মাত্রাতিরিক্ত বহেড়া সেবনে মাতাল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও শারিরীকভাবে আরও বিভিন্ন ক্ষতি দেখা যায়।

তাই অত্যন্ত সতর্কভাবে এটি গ্রহণ করতে হবে।

subscribe to our youtube channel 2

শেয়ার করুন -

উত্তর দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার নাম লিখুন