মাত্র ৮৩ দিনের নেতৃত্বকালে কি কি করেছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ?
মাত্র ৮৩ দিনের নেতৃত্বকালে কি কি করেছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ?
বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৫ই অগাস্ট ভোরে সপরিবারে হত্যা কাণ্ডের পর ওই দিন থেকেই রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব কাধে তুলে নেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ।
পূর্বে খন্দকার মোশতাক আহমেদ ছিলেন শেখ মুজিবের মন্ত্রিসভার বাণিজ্যমন্ত্রী।
কিন্তু স্বনির্বাচিত নব রাষ্ট্রপতি হিসাবে ক্ষমতায় ছিলেন মাত্র ৮৩ দিন। ৫ই নভেম্বর পর্যন্ত খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে একটি সেনা অভ্যুত্থানে তাকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়।
১৯৭৫ সালের ৬ই নভেম্বর পর্যন্ত তিনি অঘোষিতভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে ছিলেন।
কিন্তু যে কয়দিনই ক্ষমতায় ছিলেন শেখ মুজিব সরকারের অনেক কিছু পরিবর্তন করে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ।
গবেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমেদের মতে, ”আসলে সেসময় তাকে ক্ষমতায় বসানো হয়েছিল, কারণ খুনীচক্র তাকে বসিয়েছিল বলে। আমার ধারণা, তিনি অনেকটা শিখণ্ডির ন্যায় ছিলেন। তারপরও যেহেতু তার নেতৃত্বে সরকারটি গঠিত হয়েছিল এবং সরকারের সবাই আওয়ামী লীগের অধীন ছিলেন, তারা ১৫ই অগাস্টের আগের ও পরের অনেক কিছুই বদলে দিয়েছিলেন।”
উদাহরণ দিতে গিয়ে মি. আহমেদ বলেন, ”১৫ই অগাস্টের আগ পর্যন্ত বাকশাল ব্যবস্থা কার্যকর ছিল। একটি অর্ডিন্যান্স জারি করে তিনি বাকশালের একদলীয় ব্যবস্থা রদ করে দেন।
দ্বিতীয়ত, অনেকগুলো পত্রিকা অনেকদিন যাবৎ বন্ধ হয়ে ছিল, সেগুলো পুণরায় খোলা আরম্ভ করেন।
তৃতীয়ত, ব্যক্তি পুঁজির একটি সিলিং (উর্দ্ধসীমা) নির্ধারিত ছিল ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত। সেটাকে খন্দকার মোশতাক আহমেদ ১০ কোটি টাকায় উপনীত করেন এবং এগুলোর প্রাইভেটাজাইশনে একটা গতি আনার প্রচেষ্টা করেন।”
”বাংলাদেশে একটা সাম্প্রদায়িক আবহ, যেটা একাত্তরের যুদ্ধের পর থেকে মোটামুটি ধামাচাপা পড়ে ছিল- আমি বলবো, সেটা তিনি আরও উস্কে দেন। সবচাইতে বড় কথা হচ্ছে, আমাদের সকলের প্রিয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সম্পর্কে তার প্রশ্রয়ে একটা নেতিবাচক প্রচারণা চলতে থাকে।”
এই গবেষক আরও বলছেন, ”তার নেতৃত্বের ওই ৮৩ দিন যদি আরও দীর্ঘায়িত হতো, তাহলে হয়তো তিনি আরও অনেক কিছু করতেন। তবে তিনি তখন যেই সরকারের অংশ হিসেবে ছিলেন ১৫ই অগাস্টের আগ পর্যন্ত, ঠিক অনেকটাই তার বিপরীতধর্মী কাজগুলো তিনি ওই সময়ে করেছেন।”
ক্ষমতা নিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা
১৫ই অগাস্ট, তখনো ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের রক্তের দাগও শুকোয়নি, ঐ সময়েই খন্দকার মোশতাক আহমেদ নিজেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসাবে ঘোষণা করেন।
আর সেই নতুন সরকারকে সর্বপ্রথম স্বীকৃতি দেয় পাকিস্তান।
এমনকি শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের তিনি ‘জাতির সূর্য সন্তান’ বলে আখ্যায়িত করেন।
মেজর জেনারেল (অবঃ) মইনুল হোসেন চৌধুরী তাঁর ‘এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য: স্বাধীনতা প্রথম দশক’ শীর্ষক বইতে লিখেছেন, ”শেখ মুজিবের হত্যার পর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা এবং আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য খন্দকার মোশতাক বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ নেন। সরকার গঠন করে তিনি ‘জয় বাংলা’ ধ্বনির স্থলে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ ধ্বনি প্রচলন করেন। বাংলাদেশ বিরোধী ও পাকিস্তানপন্থী কিছু ব্যক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ উচ্চপদে বহাল করেন। এ সময় স্বাধীনতা বিরোধী চক্র রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অঙ্গনে বেশ তৎপর হয়ে উঠলো।”
তৎকালীন একটি পত্রিকায় খন্দকার মুশতাকের রাষ্ট্রপতি ঘোষণার খবর
১৯৭৫ সালের ২০শে আগস্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ সামরিক আইন জারি করলেন। এবং তারপর নিজেই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব নিলেন।
ক্ষমতা গ্রহণ করার সময় খন্দকার মোশতাক আহমেদ প্রধানমন্ত্রীর পদ বিলুপ্ত করে দেন। যে কারণে তার নবগঠিত সেই সরকারে ১২ জন মন্ত্রী এবং ১১ জন প্রতিমন্ত্রী থাকা সত্ত্বেও সেখানে কোন প্রধানমন্ত্রী পদ ছিল না।
এই মন্ত্রিসভায় যুক্ত থাকা অধিকাংশ মানুষই ছিলেন আগের মন্ত্রিসভার সদস্য।
খন্দকার মোশতাক আহমেদ নিজে রাষ্ট্রপতি পদ গ্রহণের পরেই উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্ধারণ করেন শেখ মুজিব সরকারের ভূমিমন্ত্রী মোহাম্মদ উল্লাহকে।
গ্রেপ্তার অভিযান
আনোয়ার উল আলম তার রচিত ‘রক্ষীবাহিনীর সত্য-মিথ্যা’ বইয়ে লিখেছেন, ”খন্দকার মোশতাক আহমেদ ক্ষমতা গ্রহণ এবং মন্ত্রিসভা গঠন করেই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রেপ্তার করতে থাকেন। ২৩শে অগাস্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামারুজ্জামান, আবদুস সামাদ আজাদসহ শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মধ্যে যারা তাকে সমর্থন করতে এবং তার মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে অস্বীকার জানান, তিনি তাঁদের বন্দী করেন।”
মেজর জেনারেল (অবঃ) মইনুল হোসেন চৌধুরী তার ‘এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য, স্বাধীনতার প্রথম দশক’ নামক বইতে লিখেছেন, ”ক্ষমতায় এসেই এই সরকার বেশ তাড়াহুড়ো করেই সামরিক বাহিনীতে পরিবর্তন আনে। জেনারেল ওসমানীকে (এমএজি ওসমানী) একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রীর পদমর্যাদায় রাষ্ট্রপতির সামরিক উপদেষ্টা তৈরি করা হলো। উপ-সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান নির্ধারণ করা হলো। আর পূর্বতন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ কে অব্যাহতি প্রদান করে তার চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হলো। রাষ্ট্রদূত পদে নিয়োগের জন্য।”
”মেজর রশিদ, ফারুক এবং তাদের অন্যান্য সহযোগীদের হাবভাব ও চালচলন দেখলে মনে হতো, দেশ এবং সেনাবাহিনী দুটোই তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। মেজর ফারুক বঙ্গভবনের নির্ধারিত একটি কালো মার্সিডিজ গাড়িতে চড়ে গোটা শহর ঘুরে বেড়াত। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন লোকজনদের কাছ থেকে জোরপূর্বক অর্থ আদায় এবং অন্যান্য অনিয়মের অভিযোগও পাওয়া গিয়েছিল।
খন্দকার মোশতাক আহমেদ এদেরকে তার নিজের নিরাপত্তার কারণে বঙ্গভবনেই থাকতে উৎসাহিত করতেন।” নিজের বইতে লিখেছেন মইনুল হোসেন চৌধুরী।
খন্দকার মোশতাক আহমেদ ক্ষমতা দখল করার পর থেকেই হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তা এবং নতুন সরকারের সকল সদস্যদের জন্য বিরাট এক উদ্বেগের কারণ হয়ে দাড়িয়েছিল রক্ষীবাহিনী।
তাই চলতি অগাস্ট মাসেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে, রক্ষীবাহিনী বিলুপ্ত করে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে একীভূত করে ফেলা হবে।
আর সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে খন্দকার মোশতাক আহমেদের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা এম এ জি ওসমানী রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তাদের ডেকে এই কথা জানিয়ে দেন।
জয় বাংলার বদলে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পূর্ব থেকেই জয় বাংলা কথাটি অনেকটা জাতীয় শ্লোগান হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছিল। স্বাধীনতার পরে সর্বক্ষেত্রে এই শ্লোগানটিই ব্যবহার করা হতো।
তৎকালীন একটি পত্রিকায় খন্দকার মুশতাকের রাষ্ট্রপতি ঘোষণার খবর
কিন্তু খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা দখল করেই তার প্রথম বক্তব্য থেকেই ‘জয় বাংলা’র বদলে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ বলতে শুরু করেন।
পরবর্তীতে বাংলাদেশ বেতারের নাম তিনি পরিবর্তন করে দেন। রেডিও পাকিস্তানের অনুকরণে বাংলাদেশ বেতারের নামও ‘রেডিও বাংলাদেশ’ নির্ধারণ করেন।
জাতীয় পোশাক
সেই সময়কার বিভিন্ন পত্রপত্রিকার খবর থেকে জানা যায় যে, ৬ই অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পোশাক হবে খন্দকার মোশতাক আহমেদ সবসময় যে পোশাক পরে থাকতেন তাই। সেই আচকান এবং শেরওয়ানি।
কোন কোন গবেষক বলেছেন, মোশতাক যে টুপিটি মাথায় পরতেন, সেই টুপিটিকেও জাতীয় টুপি হিসেবে ঘোষনা করা হয়।
এবং বলা হয়, গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কর্মকর্তাদের যেকোনো রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করার সময় এই টুপি ও পোশাক পরে যোগদান করতে হবে।
৪ঠা অক্টোবর থেকে বাংলাদেশ সরকার মারফত পাকিস্তানের সঙ্গেও কূটনৈতিক যোগাযোগ করা শুরু হয়।
ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যাতে কোন আইনি পদক্ষেপ বা বিচার-ব্যবস্থা করা না যায়, সেই দায়মুক্তি দিয়ে ২৬শে সেপ্টেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন।
পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালে, যখন জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি ছিলেন তখন বাংলাদেশের সংসদে সেই অধ্যাদেশ অনুমোদন করা হয়। ফলে এরপর থেকে সেটি একটি আনুষ্ঠানিক আইন হিসাবে অনুমোদিত হয়।
১৯৭৯ সালের ৭ই জুলাই বাংলাদেশের সংবিধানে ৫ম সংশোধনী করা হয়। এবং সেটি সংশোধিত সংবিধানেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর ফলশ্রুতিতে হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পার হয়ে যাবার পরও হত্যাকারীদের কারও কোন বিচার হয়নি।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার পুনরায় ক্ষমতাসীন হবার পর ১২ই নভেম্বর ইনডেমনিটি আইন বাতিল করে বাংলাদেশ পার্লামেন্ট। পরবর্তীতে ২০১০ সালে এসে ৫ম সংশোধনী সংবিধানকে অবৈধ ঘোষণা করে বাংলাদেশের হাইকোর্ট।
জেল হত্যা
তেসরা নভেম্বর ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী অবস্থায় যে জাতীয় ৪ নেতার হত্যাকাণ্ড করেছিল একদল সেনা সদস্য- আসলে সেই হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছিল তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদেরই নির্দেশে।
২০১০ সালে সে ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার আমিনুর রহমান বলেছেন, “আমাদেরকে টেলিফোন করে বলা হলো প্রেসিডেন্ট কথা বলবে আইজি সাহেবের সঙ্গে। তখন আমি এক দৌড়ে গিয়ে আইজি সাহেবকে সে খবর দিলাম। কথা শেষ হলে আইজি সাহেব আমাদের বললেন যে প্রেসিডেন্ট সাহেব ফোনে বলছেন আর্মি অফিসাররা যেটা চায়, সেটা তোমরা কর।”
তার নির্দেশ পেয়েই ৪ নেতাকে একটি কক্ষে একত্রিত করার পর গুলি করে হত্যা করে সেই সেনা সদস্যরা।
১৯৭৫ সালের ৫ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সেনাবিদ্রোহের দ্বারা মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অপসারিত হন। ৬ই নভেম্বর তিনি গ্রেফতার হন।
অবশ্য জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর পরবর্তী বছরেই তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান।
এসব কারণে খন্দকার মোশতার আহমেদ জাতীয় বেইমান হিসেবে সর্বজন নিন্দিত। এমনকি বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে হত্যার পিছনে তিনিও জড়িত ছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।