মানচিত্রের কথা মনে করলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে একটি এলাকা, একটি দেশ, মহাদেশ কিংবা গোটা পৃথিবী। যাতে থাকে প্রাসঙ্গিক সব তথ্য এবং উপাত্ত। কিন্তু এই মানচিত্র কি এত সহজেই আমাদের সামনে এসেছে? না, মানচিত্র সৃষ্টির ইতিহাস বিরাট।
আমরা এখন কত সহজেই না মানচিত্র হাতের নাগালে পেয়ে যাই। বইয়ে কত সুন্দর সুন্দর সব মানচিত্র।
পুরো পৃথিবী, সাগর-মহাসাগর, দেশ-মহাদেশ থেকে শুরু করে বিভিন্ন এলাকার মানচিত্র এখন আমরা দেখতে পাই। আর ইন্টারনেটের যুগে এখন তো মানচিত্র পাওয়া আরও সহজ হয়ে গিয়েছে। হাতে থাকা মুঠোফোন দিয়ে ইচ্ছা করলেই আমরা দেখে আসতে পারি পৃথিবীর যেকোন দেশের যেকোন কোণ।
কিন্তু একবারও কি ভেবে দেখেছি- এইযে আজ আমরা এত্ত সহজে চোখের সামনে মানচিত্র পেয়ে যাচ্ছি তা তৈরি করতে কত কাঠখর পোড়াতে হয়েছিল?
আজ আমরা জানবো বিশ্ব মানচিত্র সৃষ্টির ইতিহাস সম্পর্কে-
পৃথিবীর প্রাচীনতম মানচিত্রের খোঁজ পেতে মরিয়া গবেষকরা। বিশেষ করে কেমন ছিল অতীতের পৃথিবী তা জানতে এমন একটি মানচিত্র চাই যা দেখে মিলবে অনেক অজানা তথ্য।
মানচিত্র একটি দেশ বা অংশের সীমানা, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড নির্দেশ করে। একেকটি দেশ বা ভূখণ্ড তথা সম্পূর্ণ বিশ্বের মানচিত্র আঁকার রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস।
‘প্রকৃতি মানে সংগ্রাম’- বিখ্যাত এই উক্তিটি চার্লস ডারউইন। প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে কেউ হয়েছে জয়ী, কেউবা পরাজয়ী।
মানুষ একসময় যুদ্ধে অর্জিত এই ভূখণ্ডের সীমানা নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। যাতে তারা তাদের সীমানা সম্পর্কে জ্ঞাত হয় এবং একে সুরক্ষা করতে পারে।
তবে সর্বপ্রথম গ্রিক জ্যোতিষী ও গণিতবিদ হিপারকাস মানচিত্রের চিত্রায়নের ধারণা দেন
যার দরুন আঁকা হয় মানচিত্র।
ইতিহাস:
মানচিত্র তৈরির ইতিহাস সভ্যতার ইতিহাসের মতোই সুপ্রাচীন এবং রহস্যেঘেরা।
মানচিত্র ইংরেজি হচ্ছে Map. যা একটি ল্যাটিন শব্দ থেকে এসেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ল্যাটিন শব্দ মাপ্পা বা Mappa থেকে ইংরেজি Map শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে।
মাপ্পা শব্দের অর্থ হচ্ছে কাপড়ের টুকরো। প্রাচীনকালে চিত্রকররা কাপড়ের ওপর মানচিত্র অঙ্কন করতো।
এছাড়াও সঠিক এবং ভূমির নিখুঁত পরিমাপ পেতে ভূগোলবিদরা এবং চিত্রকররা যুগে যুগে বহু মানচিত্র অঙ্কন করেছেন।
যার অনেক প্রমাণ মেলেছে। যেমন- খেজুর পাতার শিরার ওপর এবং ঝিনুক দিয়ে আঁকা মানচিত্রও পাওয়া গেছে মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ থেকে।
আবার অন্যদিকে বরফের দেশের এস্কিমোরা সীল মাছের চামড়া টানটান করে মেলে ধরে তার ওপর কাঠের টুকরা লাগিয়ে দ্বীপের অবস্থান বোঝানোর চেষ্টা করতো।
সবচেয়ে প্রাচীন মানচিত্রটি কে এঁকেছিলেন?
সবচেয়ে প্রাচীন মানটিত্রটি কে এঁকেছিলেন তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
তবে ইতিহাস খুঁজে জানা যায়, পৃথিবীর সবচেয়ে পুরানো মানচিত্রটি ব্যাবিলনের। যার নাম ইন্ডিগো মুন্ডি।
এই মানচিত্রটি পাওয়া যায় আনুমানিক খ্রিস্টপূ্র্ব ৬০০ সালে।
আশ্চর্যের ব্যাপার হলো- মানচিত্রটি হাতে আঁকা হয়নি। এটি ছিল একটি পোড়ামটির ফলক।
কিন্তু সবচেয়ে প্রাচীন মানচিত্র হলেও তা ছিল শুধুমাত্র ব্যাবিলনের মানচিত্র।
পৃথিবীর সবচেয়ে পুরানো ব্যাবিলনের ইন্ডিগো মুন্ডি মানচিত্র
পৃথিবীর প্রথম মানচিত্র:
প্রথম পৃথিবীর মানচিত্র আঁকার চেষ্টা করেন দার্শনিক ‘অ্যানাক্সিম্যাণ্ডার’।
মিলেটাস দ্বীপের এ বাসিন্দা মানচিত্রের যে চিত্রটি এঁকেছিলেন তাতে চারদিকে সমুদ্রঘেরা। বর্তমানের তিনটি মহাদেশ- এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের কিছু অংশও ছিল।
তার আঁকা সেই মানচিত্রটিকে আরেকটু উন্নত করেন হেক্টিয়াস অব মিলেটাস।
তিনি এশিয়ার শেষ প্রান্ত ভারতের অবস্থানও সেই মানচিত্রে দেখিয়েছিলেন। এমনকি মিসরের অবস্থানও ছিল তার আঁকা মানচিত্রে।
এরপর আলেকজান্ডারের আমলে তার সম্পূর্ণ সাম্রাজ্যের একটি মানচিত্র অঙ্কন করেন রাতোসথিনেস।
আর মানচিত্র অঙ্কন ইতিহাসের আদিমযুগ সবশেষ মানচিত্র আঁকিয়েছিলেন টলেমি। তখন সময়টি ছিল ১৫০ খ্রিস্টপূর্ব।
টলেমির আঁকা সেই মানচিত্র দীর্ঘদিন যাবত ভবিষ্যৎ মানচিত্রকরদের অনুপ্রাণিত করেছে।
পৃথিবীর প্রথম গোলক বা গ্লোব:
পৃথিবীর প্রথম গোলক বা গ্লোব তৈরি করে গ্রিকরা। কিন্তু আজ আর তার কোন ইয়ত্তা নেই।
মহাকালের স্রোতে ভেসে যে গোলকটি এখনো আমাদের সামনে টিকে রয়েছে সেটি তৈরি করেন মার্টিন বেহারিম নামে একজন জার্মানী।
তিনি বেশ কিছুকাল পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে ছিলেন।
১৪৯০ সালে মার্টিন বেহারিম নিজের দেশ জার্মানিতে ফিরে যান। এবং নুরেমবার্গ-এ বসে একটি গ্লোব তৈরি করেন।
যেটি এখনো রয়েছে। এর পরিধি ৫০ সেন্টিমিটার।
মার্টিন বেহারিমের তৈরি আর্থ অ্যাপল গ্লোব
চামড়ার ফালিতে আঁকা মানচিত্র টুকরো টুকরো করে সেঁটে দেওয়া হয়েছিল সেই কাঠের গোলকের উপর।
মার্টিন গোলকটির নাম দেন আর্থ অ্যাপল বার বিশ্ব আপেল।
পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মানচিত্র:
পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মানচিত্রটির নাম ‘লিও বেলজিকাস’। লিও বেলজিকাস শব্দটি আসে ‘বেলজি’ শব্দ থেকে। যা এখনকার বেলজিয়ামকে বোঝানো হয়।
অস্ট্রিয়ান চিত্রশিল্পী মাইকেল অ্যাতজিঞ্জার ১৫৮৩ সালে অদ্ভুত সুন্দর এই শিল্পকর্মটি সৃষ্টি করেন।