ইসরায়েলি স্পাইওয়্যার পেগাসাস এর টার্গেট ইমরান খান, ম্যাক্রঁসহ আরও এক ডজন নেতা
ইসরায়েলি স্পাইওয়্যার পেগাসাস এর টার্গেট ইমরান খান, ম্যাক্রঁসহ আরও এক ডজন নেতা
ইসরায়েলি স্পাইওয়্যার পেগাসাস, এই স্পাই সফটওয়্যার গোপনে মোবাইল ফোনে ঢুকিয়ে নজরদারি করা হয়।
কীভাবে এটি বিভিন্ন রাষ্ট্র নজরদারি করছে -তা নিয়ে আন্তর্জাতিক এক অনুসন্ধানের মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিভিন্ন তথ্য বেরিয়ে আসছে।
গোটা বিশ্বের প্রথম সারির সর্বমোট ১৭টি মিডিয়া এবং প্যারিস ভিত্তিক একটি এনজিও ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর যৌথ অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য সম্বলিত সর্বশেষ প্রকাশিত রিপোর্টগুলোতে পরিলক্ষিত যে, বিশ্বের ৩ জন প্রেসিডেন্ট, ১০ জন প্রধানমন্ত্রী এবং ১ জন রাজাকে এই ইসরায়েলি স্পাইওয়্যার পেগাসাস দিয়ে টার্গেট করা হয়েছে।
তবে অবাক করা বিষয় এই ১৪ জনের কেউই তাদের ব্যাক্তিগত মোবাইল ফোন সেট অনুসন্ধানকারী সাংবাদিকদের কিংবা তাদের সহযোগী বিশেষজ্ঞদেরও হাতে তুলে দেননি।
যারফলে, পেগাসাস স্পাইওয়্যারটি তাদের মোবাইল ফোনে ঢোকানো সম্ভব হয়েছিল কিনা অথবা যদিও ঢোকায়- ঢোকানোর পর তা দিয়ে আদৌ তাদের ওপর নজরদারি করা হয়েছিল কিনা -তার কোনরূপ ফরেনসিক বিশ্লেষণ করা এখনো সম্ভব হয়নি।
কয়েক মাস ধরে চালানো এই অনুসন্ধানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ব্যবহার করা প্রায় ৫০ হাজারেরও অধিক মোবাইল ফোনের নম্বর ইতোমধ্যে পরীক্ষা করা হয়েছে।
তাদের মধ্যে রয়েছেন প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, বিজ্ঞানী এমনকি ভারতের সুপ্রিম কোর্টের বিচারকও।
৩ জন প্রেসিডেন্ট, ১০ জন প্রধানমন্ত্রী এবং ১ জন রাজা
যে ১৪ জন রাষ্ট্র এবং সরকার প্রধান ইসরায়েলি স্পাইওয়্যার পেগাসাস এর টার্গেট হয়েছেন বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন ৩ জন ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট- ফ্রান্সের ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ, দক্ষিণ আফ্রিকার সিরিল রামাফোসা ও ইরাকের বারহাম সালিহ।
১০ জন প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে ৩ জন এখনও ক্ষমতায় রয়েছেন। তারা হলেন- পাকিস্তানের ইমরান খান, মিশরের মোস্তাফা মাদবউলি এবং মরক্কোর সাদ-এদিন আল ওথমানি।
যে ৭জন সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতায় থাকা অবস্থাতেই নজরদারি করার জন্য যাদের টার্গেট করা হয় তারা হলেন – ফ্রান্সের এডওয়ার্ড ফিলিপে, বেলজিয়ামের চার্লস মিশেল, ইয়েমেনের ওবায়েদ বিন দাঘর, লেবাননের সাদ হারিরি, উগান্ডার রুহাকানা রুগুন্ডা, কাজাকস্তানের বাকিতজান সাগিনতায়েব ও আলজেরিয়ার নুরুদিন বেদুই।
পেগাসাসের টার্গেটে একজন রাজাও রয়েছেন। তিনি – মরক্কোর রাজা ষষ্ঠ মোহামেদ।
যে মোবাইল ফোন নম্বরগুলো পরীক্ষা করে এইসব স্পর্শকাতর তথ্যগুলো পাওয়া গেছে সেগুলো যে বর্তমান ও সাবেক সব সরকার এবং রাষ্ট্রপ্রধানরা ব্যবহার করতেন তা সেসব দেশের ভেতরে থেকে বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্রে এবং সরকারি নথি হতে নিশ্চিত হওয়া গেছে বলে ওয়াশিংটন পোস্ট এর এক রিপোর্টে বলা হয়েছে।
পত্রিকাটি দাবি করছে তারা নিজেরাও কয়েকটি নম্বরে ফোন করে ব্যবহারকারীর পরিচয় পরীক্ষা করেছে।
কোন দেশ কোন নেতাকে টার্গেট করেছে
লন্ডনের বিখ্যাত গার্ডিয়ান পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে যে ভারত থেকে টার্গেট করা হয়েছে তার আলামত অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ সেইসাথে তার সরকারের ফ্রান্সের ১৪ জন মন্ত্রীসহ কয়েকজন ডজন কর্মকর্তার মোবাইল ফোনে হ্যাকিংয়ের প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। এগুলোকে মরক্কো থেকে টার্গেট করা হয়েছে।
ফরাসি এক জনপ্রিয় দৈনিক ল্য মঁদ, যারা এই অনুসন্ধান প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার, এক রিপোর্টে বলেছে, মি. ম্যাক্রঁর এমন একটি ফোন মরক্কোর গোয়েন্দা সংস্থা টার্গেট করে যেটি তিনি ২০১৭ সাল থেকে ব্যবহার করে আসছেন।
বলা হচ্ছে যে, বেলজিয়ামের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মিশেল, ডব্লিউ এইচ ও প্রধান এবং ইটালির সাবেক প্রধানমন্ত্রী রোমানো প্রদি সহ আরও ১০ হাজারের মত গণ্যমান্য ব্যক্তির ফোন নম্বর হ্যাকিংয়ের জন্য টার্গেট করা হয় মরক্কো থেকে।
ইরাকের প্রেসিডেন্ট সালিহ এবং লেবাননের সাদ হারিরি কে টার্গেট করেছে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত হতে।
দক্ষিণ আফ্রিকার রামাফোসা ও উগান্ডার রুগুন্ডা কে টার্গেট করা হয়েছে রুয়ান্ডা থেকে।
মঙ্গলবার এসব তথ্য ফাঁস এবং তারপর তার প্রকাশ হওয়ার পর তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে ফ্রান্সে।
ফরাসি প্রেসিডেন্টের অফিস থেকে এক বিবৃতির মাধ্যমে বলা হয়েছে, “পত্রিকায় প্রকাশিত এসব তথ্য রিপোর্ট যদি সত্যি হয় তাহলে তা খুবই গুরুতর।”
আরও বলা হয়েছে, সরকার সবকিছু তলিয়ে দেখবে
এনএসও গ্রুপের আত্মপক্ষ সমর্থন
ইসরায়েলি স্পাইওয়্যার পেগাসাস বিক্রয় করা হয় এনএসও গ্রুপে। যেটি একটি ইসরায়েলি কোম্পানি। গত ২ দিন ধরে এর বিক্রেতা ক্রমাগত বলে চলেছে তাদের সফটওয়্যার নিয়ে এসব অভিযোগ মনগড়া, অসত্য।
ফাঁস হওয়া ৫০ হাজার মোবাইল ফোনের নম্বর যে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, সেগুলো যে নজরদারির টার্গেট ছিল বা রয়েছে তা তারা মানতেই নারাজ।
পেগাসাস স্পাইওয়্যার বিক্রয় করা হয় ইসরায়েলি কোম্পানি- এনএসও গ্রুপে
কিন্তু ওয়াশিংটন পোস্ট এবং গার্ডিয়ান পত্রিকা বলছে, অ্যামনেস্টির সিকিউরিটি ল্যাবে এসকল নম্বর সম্বলিত ৬৭টি স্মার্টফোনের ফরেনসিক পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে নিশ্চিত হওয়া গেছে সেগুলোর ৩৭টির মধ্যে হয় পেগাসাস সফটওয়্যারটি ঢোকানো হয়েছিল অথবা ঢোকানোর চেষ্টা করা হয়েছিল।
এনএসও গ্রুপ জানিয়েছে পুরো বিশ্বের ৪০টি দেশের ৬০টি সরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের ক্রেতা। এবং ইসরায়েলি এই কোম্পানির দাবি তারা শুধুমাত্র সন্ত্রাসী এবং শিশু যৌন নির্যাতনকারী, মাদক ব্যবসায়ী বা মানব পাচারকারীদের মত গুরুতর অপরাধীদের নজরদারি করার শর্তেই এই সফটওয়্যারগুলো বিক্রি করে।
এনএসও বলছে যে রাজনীতিক সহ ‘নিরপরাধ সাধারণ জনগণকে’ এই সফটওয়্যার দিয়ে টার্গেট না করার শর্তে এগুলো ক্রেতাদের দেয়া হয়। এবং সেই শর্ত ভাঙলে এবং তার প্রমাণ পেলে এই সফটওয়্যার বন্ধ করে দেয়া হয়।
কিন্তু শর্ত ভাঙার দায়ে এনএসও গ্রুপ কোনো দেশে তাদের সার্ভিস বন্ধ করেছে তার কোনো প্রমাণ এখনো মেলে নি।
ইসরায়েলি স্পাইওয়্যার পেগাসাসের বিস্তার
এই অনুসন্ধানের তালিকায় থাকা ৩৪টি দেশের ৬০০ সরকারি কর্মকর্তা এবং রাজনীতিকদের ফোন নম্বর রয়েছে।
যে ১৪টি দেশের শীর্ষ রাজনীতিক এবং নেতাদের টার্গেট করা হয়েছে তারা ছাড়াও আরো যেসব দেশের কর্মকর্তারা পেগাসাস সফটওয়্যারের টার্গেট হয়েছেন তাদেরর মধ্যে রয়েছে : আফগানিস্তান, আযারবাইজান, বাহরাইন, চীন, ভুটান, কঙ্গো, হাঙ্গেরি, ভারত, নেপাল, কাতার, সৌদি আরব, টোগো, ইরান, কাজাকিস্তান, মালি, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট এবং ব্রিটেন।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে কোনো কোনো নেতার ফোনে একাধিকবার পেগাসাস ঢোকানো হয়েছে। শুধু তারাই নয়, তাদের বন্ধু, স্বজন এবং কর্মচারীদের ফোনও হ্যাক করা হয়েছে বা চেষ্টা হয়েছে।
যেমন, মেক্সিকোতে ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে প্রেসিডেন্ট অন্দ্রেস ম্যানুয়েল লোপেজ অবরাডরের স্ত্রী, সন্তান, তার গাড়িচালক এবং এমনকি তার একজন চিকিৎসকের ফোনও নজরদারির জন্য টার্গেট করা হয়েছে।
