রঙ্গের জাদুকর বহুরূপী প্রাণী – গিরগিটি

রঙ্গের জাদুকর বহুরূপী প্রাণী - গিরগিটি
রঙ্গের জাদুকর বহুরূপী প্রাণী - গিরগিটি

সুসময়ের বন্ধু যখন কাজ শেষে পালায় তখন আমরা অনেকেই বলি, “কিরে গিরগিটি হয়ে গেলি” কিন্তু জানেন কি এই প্রবাদটি আমরা কেন বলি?

গিরগিটির অন্যতম এক অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য- তার দেহের রঙ পরিবর্তন। আর এর সঙ্গে সামঞ্জস্যতার কারণে আমরা এটাকে প্রবাদ হিসেবে ব্যবহার করে থাকি। যার অর্থ প্রয়োজন ফুড়ালে মানুষের স্বভাব-চরিত্র বদলে যাওয়াকে বুঝায়।

এবার আমরা জানবো রঙ্গের জাদুকর বহুরূপী প্রাণী গিরগিটি সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য।

নামকরণ:

সাধারণত এই প্রাণীকে গিরগিটি নামেই সকলে চিনে। তবে এর আরও একটি নাম রয়েছে; তক্ষক। সচরাচর কেও এটা ব্যবহার করে না।

গিরগিটির ইংরেজি chameleon.

বৈজ্ঞানিক নাম:

গিরগিটির বৈজ্ঞানিক নাম Calotes versicolor.

পরিবার:

টিকটিকি, কুমিরের মতনই একটি সরিসৃপ প্রজাতির কর্ডাটা পর্বের প্রাণী গিরগিটি।

প্রাপ্তিস্থান:

বিভিন্ন প্রজাতির গিরগিটির মধ্যে সবথেকে বেশি প্রজাতির গিরিগিটি বাস করে আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।

এছাড়াও পৃথিবীর প্রায় সবজায়গার বনে-জঙ্গলে এদের দেখা পাওয়া যায়।

প্রজাতি:

পৃথিবীতে সবমিলিয়ে প্রায় ১৬০ প্রজাতির গিরগিটি রয়েছে।

আকার-আকৃতি:

এদের আকৃতি সাধারণত ১ ইঞ্চি হয়ে থাকে।

তবে প্রজাতিভেদে এদের আকার এবং বৈশিষ্ট্যে প্রচুর ভিন্নতা রয়েছে। যেমন-

অস্ট্রেলিয়ার এক প্রজাতির গিরগিটির আকার ১ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। এগুলো হয় মাংশাসী।

আবার আফ্রিকার কিছু অঞ্চলে বাস করা আর্মাদিলো প্রজাতির গিরগিটিদের আকার ১৫-২০ সেমি পর্যন্ত হয়ে থাকে।

টেগু নামক আরেক প্রজাতির গিরগিটি ৪-৪.৫ ফুটের মতো লম্বা হয়ে থাকে। এবং এরা দেখতে কালো রঙের হয়।

গঠন ও বৈশিষ্ট্য:

গিরগিটি শীতল রক্তবিশিষ্ট সরিসৃপ প্রজাতির প্রাণী। অন্যান্য সরিসৃপের মতনই এরা পায়ের উপর ভর করে চলাফেরা করে।

গিরগিটিদের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের আচরণ লক্ষ্য করা যায়। তবে বেশিরভাগ সময় এরা শান্ত-সুন্দর, নিরীহ স্বভাবের হয়ে থাকে।

এরা আক্রমণাত্বক তো নয়ই বরং মানুষ বা অন্য যেকোন প্রাণী দেখলে ভয় পেয়ে যায়। এবং খুব সহজে এরা কামড়ও দেয় না। তবে তাদের আচরণ দেখে শত্রুরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।

  • অদ্ভুদ জিহ্বা:

সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে, প্রয়োজনবোধে এরা নিজেদের জিহ্বাকে তাদের শরীরের তুলনায় বেশি প্রসারিত করতে পারে।

নিজেদের জিহ্বাকে গিরগিটি শরীরের তুলনায় বেশি প্রসারিত করতে পারে
নিজেদের জিহ্বাকে গিরগিটি শরীরের তুলনায় বেশি প্রসারিত করতে পারে
  • আশ্চর্যজনক চোখ:

অদ্ভুদ সব বৈশিষ্ট্যের অধিকারী প্রাণী এই গিরগিটির আরও একটি চমকপদ বৈশিষ্ট্য হলো তারা তাদের মাথাটিকে না নাড়িয়েই তাদের চার পাশের সব কিছু দেখতে পারে। এমনকি তাদের পিছনের দিকের অংশও।

এই প্রাণী চোখের মণি ঘুরাতে পারে না। কোটর এবং মণিসহ সম্পূর্ণ চোখ ঘুরাতে পারে। একারণে তাদের চোখগুলি ৩৬০° অ্যাঙ্গেলে ঘুরে থাকে।

এই বৈশিষ্ট্যের কারণে গিরগিটি একটি চোখ দিয়ে সামনের দিকে দেখলে আবার একই সময় অপর চোখটি দিয়ে পেছনের দিকেও তাকাতে পারে।

একারণে তারা খুব সহজেই শিকার ধরতে পারে।

এদের যখন পানি পানের প্রয়োজন হয় তখন এরা পানি না খেয়ে শরীরের চামড়া এবং আঁশ ব্যবহার করে শরীরের ভেতরেই পানি উৎপন্ন করে তৃষ্ণা মিটিয়ে থাকে। এটি তাদের আরেকটি চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য।

  • গিরগিটি কিভাবে রঙ বদল করে:

খুবই ছোট প্রাণী হওয়ার সুবাদে যেকোন দুরহ পরিস্থিতে এরা দ্রুত যেখানে-সেখানে লুকিয়ে যেতে পারে। আর তাদের লুকানোর এক বড় অস্ত্র হলো শরীরের রঙ পরিবর্তন।

আমাদের এই পৃথিবীতে বহু আশ্চর্যজনক প্রাণী আছে। তবে গিরগিটি নামক এই প্রাণীটি তাদের সবার থেকে ভিন্ন।

এর এক বিশাল কারন হলো তাদের রয়েছে শরীরের রঙ পরিবর্তন করার এক দারুন ক্ষমতা। যা পৃথিবীর অন্য কোন প্রাণীর মধ্যে নেই।

নিজেকে লুকানো ছাড়াও এরা তাদের রাগ, ক্ষোভ ও ঝগড়াঝাটির সময়ও তাদের দেহের রঙ পরিবর্তিত করে থাকে।

যেকোন জিনিসের রঙ নিজের শরীরে ধারণ করতে পারে গিরগিটি
যেকোন জিনিসের রঙ নিজের শরীরে ধারণ করতে পারে গিরগিটি

প্রাণীটির এই আশ্চর্যজনক রঙ পরিবর্তনের ক্ষমতার মূল রহস্য আসলে, তাদের শরীরে থাকা ক্রোমাটোফোরস নামক একটি বিশেষায়িত কোষ। যার সাহায্যে এরা তাদের রঙ পরিবর্তন করে যেকোন পরিবেশের সঙ্গে নিজের শরীরকে খাপ খাইয়ে নেয়।

এই ক্রোমাটোফোরস কোষের মাধ্যমেই গিরগিটি যেকোন জায়গায় যেকোন সময় আশেপাশের যেকোন জিনিসের রঙ নিজের শরীরে ধারণ করতে পারে।

বাসস্থান:

গ্রাম্য অঞ্চলের বন-বাঁদাড়, ঝোপ-ঝাড়ে এদের দেখা পাওয়া যায় বেশি। মাটির নিচে গর্ত খুঁড়েও এরা বাসা বানিয়ে সেখানে দিনাতিপাত করে।

খাদ্যাভ্যাস:

গিরগিটি বিভিন্ন ধরণের শাক-লতাপাতা, বিভিন্ন পশুপাখির ডিম, ছোট ছোট প্রাণী যেমন-ফড়িং, ঘাসফড়িং, মাকড়সা বা এদের বাচ্চা ইত্যাদি খেয়ে থাকে।

প্রজননকাল:

এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাস গিরগিটির প্রজননকাল। এ সময় পুরুষ গিরগিটিদের দেহে প্রজননের রং খোলে।

প্রজনন মৌসুমে একটি পুরুষ গিরগিটির সামনের পা দু’টিসহ মাথা থেকে বুক পর্যন্ত অংশে কমলা-লাল রং ধারণ করে। লাল-কালো গলা ফুলিয়ে তারা স্ত্রী গিরগিটিকে আকর্ষণ করে। ডিম পাড়ার মাধ্যমে গিরগিটি তাদের বংশবিস্তার করে থাকে।

প্রজননের পর স্ত্রী গিরগিটি নরম মাটিতে কয়েক সেন্টিমিটার লম্বা গর্ত খুঁড়ে সেখানে একবারে ৬ থেকে ২০টি ডিম পাড়ে। ডিমগুলি সাদা, লম্বাটে ও নরম খোসাবিশিষ্ট হয়ে থাকে।

আরো পড়ুন:
সাগরতলের হিংস্র প্রাণী – হাঙ্গর মাছ 
মশা – অতি ক্ষুদ্র অথচ বিষ্ময়কর এক প্রাণী 
নিশাচর প্রাণী হিসেবে পরিচিত পেঁচা পাখি

৬-৭ সপ্তাহে ডিমগুলো ফোটে বাচ্চা বের হয়। সদ্যজাত বাচ্চা ৭.৫ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। সদ্য ফোটা গিরগিটির বাচ্চার রং হয় হালকা সোনালি-হলুদ থেকে বাদামি।

বছর খানেকের মধ্যেই গিরগিটি প্রাপ্তবয়স্ক হয়।

আয়ুস্কাল:

সাধারণত এরা ২০-২৫ বছর পর্যন্ত বাঁচে।

গিরগিটি কি সত্যিই রক্ত খায়?

অনেকেই মনে করেন গিরগিটি হিংস্র, এরা রক্তচোষা। কিন্তু আসলে এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা।

কিছু বিষাক্ত প্রজাতির গিরগিটি আছে ঠিকই, তবে তারা যে রক্ত খায় এই ধারণার কোন প্রমাণীত তথ্য নেই।

গিরগিটির দাম:

অনেকেই শখের বসে গিরগিটি পালে। তাই বাজারে এদের প্রচুর দাম রয়েছে।

প্রজাতিভেদে বিভিন্ন প্রকার গিরগিটির দামের তারতম্য রয়েছে। তবে এদের গড় দাম ২৫০০-২৫৪৫০ টাকার মধ্যে হয়ে থাকে।

এর থেকেও দামী গিরগিটি রয়েছে।

গিরগিটি খুবই নিরীহ প্রকৃতির এক প্রাণী। পৃথিবীতে এর অনেকগুলো প্রজাতি থাকলে বর্তমানে নির্বিচারে বন উজাড়ের কারণে এদের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে।

subscribe to our youtube channel 2

শেয়ার করুন -

উত্তর দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার নাম লিখুন